নিঃসঙ্গ জীবনে বই তাদের একমাত্র সঙ্গী
রফিক সরকার || রাইজিংবিডি.কম
আব্দুল আলী সেবাশ্রম-বৃদ্ধাশ্রম
ঈদ বা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিনসমূহে স্বজনদের কেউ পাশে না থাকলেও মানবিক সম্পর্কের টানে কাছে আসা মানুষের কোনো অভাব হয় না। মানুষ হিসেবে মানুষের খোঁজ-খবর নিতে আসেন অনেকেই। হাতে মেহেদী পরাতে আসেন, ফল বা রান্না করা খাবার নিয়ে আসেন মুখে তুলে দিতে। বলছিলাম গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার টোক ইউনিয়নের ‘আব্দুল আলী সেবাশ্রম-বৃদ্ধাশ্রম’-এর কথা। যেখানে সমাজের সহায়-সম্বলহীন মানুষ থাকেন।
তাদের মধ্য থেকে একজন করোনা মহামারির এসময়ে চোখের চিকিৎসা করাতে ঢাকায় থাকছেন। সুযোগ পেয়ে করোনার টীকাও নিয়েছেন। কিন্তু তার সঙ্গে থাকা অন্যান্য বয়স্ক মানুষের টীকার ব্যাপারে অনেক আগ্রহ। তার দাবি, আশ্রমে থাকা অনেকেরই হয়তো জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। রেজিস্ট্রেশন বা টীকা কেন্দ্রে যাওয়ার সক্ষমতা নেই। তাদের টীকাদান নিশ্চিতের ব্যাপারে সরকারকে অনুরোধ করেছেন।
যাদের সঙ্গে পরষ্পর পরষ্পরের কোনো দিন উঠাবসা বা পরিচয় ছিল না, আজ তাদের সাথেই একত্রে বসবাস, যেন আত্মার আত্বীয়। তাদের ঈদ, পার্বন এখন পারিবারিক ও সামাজিক গণ্ডি ছেড়ে মানবতার গণ্ডিতে ছড়িয়ে পড়েছে। জীবনের দুঃখ-গ্লানি ছাপিয়ে করোনা মহামারির এ সংকটেও তারা বেশ ভালো আছেন।
একটা সময় তাদের মধ্যে কেউ ব্যবসা, কেউ রাজনীতি, আবার কেউবা চাকরি করতেন, এখন অবসর। আবার কেউবা স্বামী হারা বয়োবৃদ্ধ। গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার টোক ইউনিয়নের ‘আব্দুল আলী সেবাশ্রম-বৃদ্ধাশ্রম’ বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রই যেন তাদের আমৃত্যু ঠিকানা। তাদের অনেকেই এখন আর জীবনের পেছনের কথা স্মরণ করতে চান না। বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের আদর ভালোবাসা যেন প্রত্যেকেরই অটুট থাকে, সেটা চান।
চাঁদপুর জেলা সদরের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব শামসুল হুদা একটি দুর্ঘটনায় পঙ্গু জীবনে প্রবেশ করেন। তিনি যাদের জীবনের বোঝা বহন করেছেন পঙ্গু হয়ে তিনি তাদেরই বোঝা হয়ে ওঠেন। তিনি প্রিয়জনদের জীবনের বোঝা বহন করলেও এখন তার বোঝা কেউ বহন করতে চান না। এখানে না আসলে হয়তো তাকে ভিক্ষা করতে হতো। অবশেষে মানুষের ভালোবাসায় নিজের পঙ্গুত্ব বিলীন হয়ে গেছে। এখানে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নেই। ধর্মীয় পরিচয় বড় হয় না। ধর্ম নিরপেক্ষতাই এখানে মূখ্য। তার মতো ভিন্ন ঘটনার শিকার হওয়া মানুষের সঙ্গেই এখন তার বেঁচে থাকা।
ষাটোর্ধ্ব সুশান্ত সেনগুপ্ত নারায়ণগঞ্জের একটি কাপড়ের দোকানে চাকরি করতেন। তিনি বলেন, দুনিয়াতে আমার কেউ নাই। শরীরের একপাশ অকার্যকর। লাঠি ভর করে হাঁটতে হয়। তবে এবয়সে আমার বন্ধুরা খোঁজ-খবর নেন। যেখানে এখন বেঁচে আছি, এটাই আমার আমৃত্যু এবং শেষ ঠিকানা। বৃদ্ধাশ্রমকেই আমি আপন করে নিয়েছি।
কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়ার আছিয়া খাতুন (৮৫)। তিনি বলেন, আমার দুই মেয়ে বেঁচে আছে। কিন্তু কেউ খোঁজ নেয় না। দুনিয়াতে কেউ না থাকলেও মানুষ আছে, এলাকাতেও মানুষ আছে। সেই মানুষই আরও মানুষের কাছে এনে দিয়েছে। মানুষ মানুষের সঙ্গে বেঁচে থাকবে, এটাইতো নিয়ম।
আরেকজন হলেন শামসুল হুদা। তার পরিচয় জানতে গেলে বলেন, দুঃখ স্মরণ করে কী লাভ? এটাই আমার জীবন এবং এখানেই আমার শেষ ঠিকানা। যাদের আঙুল ধরিয়ে হাঁটতে শিখিয়েছি, আঙুল ছোট হওয়ায় হয়তো তারা এখন আঙুল ছেড়ে দিয়েছে।
নতুন প্রজন্মের জন্য তিনি বলেন, প্রজন্মের কাছে আমার বার্তা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বই-পুস্তক, গণমাধ্যম সব জায়গা থেকেই শেখানো হচ্ছে। সবখানেই পিতা-মাতার প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নির্দেশনা দেওয়া আছে। স্র্রষ্টার পরে কাউকে সেজদা করার বিধান থাকলে পিতা-মাতার প্রতি তা কার্যকর থাকত। সেই শিক্ষা কাজে লাগেনি। তবে এর আগে মানুষ হতে হবে, মানুষের হৃদয় থাকতে হবে। আমারও হয়তো ভুল হয়েছে। কিন্তু এ বয়সে আমার থেকে প্রতিশোধ নেওয়াটা উচিত কেন?
মহারাজ বেগম (৯০) নামে যেমন, চিন্তাও তেমন। তিনি মনে করেন, তাকে সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য স্বজনেরা হাসপাতালে রেখে গেছেন। যেদিন সুস্থ হবেন, সেদিন বাড়ি ফিরে যাবেন। মাঝে মধ্যে সন্তান ও নাতিরা তাকে দেখতে আসেন। উল্টো তাদের বুঝিয়ে দেন সুস্থ হলেই বাড়ি ফিরবেন, তার জন্য যেন কেউ দুশ্চিন্তা না করে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও স্কুল শিক্ষক মমতাজ উদ্দিন বলেন, বয়ষ্ক মানুষজন তারও প্রতিবেশী। তিনিও নিয়মিত বৃদ্ধদের খোঁজ খবর রাখেন। অনেকটা শিশু সুলভ আচরণ তাদের। প্রতি সপ্তাহে দুদিন একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক ‘আব্দুল আলী সেবাশ্রম-বৃদ্ধাশ্রম’ বয়ষ্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে এসে বৃদ্ধদের চিকিৎসা সেবা দেন। স্থানীয় বহিরাগতদেরও এদিন বিনামূল্যে ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হয়।
আব্দুল আলী সেবাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা ড. মো. শাহজাহান দেশের বিভিন্ন জায়গায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), জেলা প্রশাসক (ডিসি), যুগ্ম সচিব, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করেছেন। ২০০৬ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসরে যান। অবসরের এককালীন অর্থ দিয়ে গড়ে তোলেন মানুষের জন্য সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধাশ্রম। বাবা আব্দুল আলীমের নামে নামকরণ করেন আব্দুল আলী সেবাশ্রম। নারী পুরুষ মিলে বর্তমানে ২০ জন বয়োবৃদ্ধ অবস্থান করছেন এ বৃদ্ধাশ্রমে। তাদের বেশিরভাগ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন।
তিনি জানান, ২০১১ থেকে পুরোদমে প্রথমে ৪/৫ জন দুস্থ মানুষকে সেবাদানের মাধ্যমে তার আশ্রম চালু করেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ সমাজের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তার সন্তান ও জামাতারা অবস্থান করছেন। তার তিন কন্যাসহ স্বজনেরা এ আশ্রমে সাহায্য সহযোগিতা করেন। তার দর্শন, মানুষের সেবার মধ্যেই বেহশত নিহিত। মসজিদ-মন্দির নির্মাণে বেহেশতি সনদ রয়েছে কিনা তা নিশ্চিত নয়। কিন্তু মানুষের সেবার মধ্যে বেহেশত নগদে পাওয়া যায়। সমাজের মানুষের প্রতি তার বার্তা-আলাদা করে পিতা-মাতার প্রতি সেবা বা শ্রদ্ধা প্রদর্শনের প্রয়োজন থাকবে কেন? মানুষের প্রতি ভালোবাসা থাকলেই পিতা-মাতার প্রতি ভালোবাসা চলে আসবে।
প্রায় ২৫টি কম্পিউটার রয়েছে তার আশ্রমে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুসজ্জিত ল্যাবে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীরা বিনামুল্যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারেন। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড অনুমোদিত ৬ মাস মেয়াদী প্রশিক্ষণ শেষে সনদও প্রদান করা হয়।
গাজীপুর/মাহি
আরো পড়ুন