নগরবাড়ি ঘাট ইজারা নিয়ে উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা
পাবনা প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার হিসেবে খ্যাত পাবনার নগরবাড়ি ঘাটের ইজারা দেয়া নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
ইজারা পেতে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন এক ইজারাদার ব্যবসায়ী। উচ্চ আদালত সেই ব্যবসায়ীকে ঘাট বুঝিয়ে দিতে নির্দেশনা দিলেও, বিআইডব্লিউটিএ অন্য একটি পদ্ধতির জোরে ঘাট ইজারা দিয়েছে তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে। বিআইডব্লিউটিএ’র সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এমন রহস্যজনক আচরণে দ্বিধাবিভক্ত ব্যবসায়ীরা।
বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রতিষ্ঠানটির নিয়মনীতি মেনে টানা কয়েক বছর নগরবাড়ি ঘাটের ইজারা নিয়ে সরকারি শুল্ক আদায় করে আসছিলেন স্থানীয় মেসার্স ঈমান আলী নামের একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে ইজারার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। মহামারি করোনার কারণে বিপর্যস্ত পরিস্থিতির কারণে ইজারা প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ ২০২১-২০২২ অর্থ বছরের জন্য ইজারা প্রদান পদ্ধতির ৪ (১) নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নবায়নের মাধ্যমে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের ইজারাদারের অনুকূলে নির্ধারিত প্রাক্কলিত মূল্যে ইজারার মেয়াদ বর্ধিত হবে বলে নবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদনের নির্দেশনা প্রদান করে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
ওই নির্দেশনার প্রেক্ষিতে পূর্ববর্তী ইজারাদার মেসার্স ঈমান আলী বিআইডব্লিউটিএ’র নির্ধারিত অর্থে রাজি হয়ে ব্যাংক চালানে টাকা জমাদান পূর্বক যথাযথ প্রক্রিয়ায় আবেদন করেন। অজ্ঞাত কারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মেসার্স ঈমান আলীকে ২০২১-২০২২ অর্থ বছরের ইজারা সংক্রান্ত নবায়নের আবেদন নামঞ্জুর করে। এই আদেশের প্রেক্ষিতে মেসার্স ঈমান আলী নামের ওই ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে ৫৮৪০/২০২১ নং একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন।
উচ্চতর আদালত রিট পিটিশনটি আমলে নিয়ে এক মাসের স্থগিতাদেশ দেন। সরকারের রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ তখন তিনজন কর্মচারী নিযুক্ত করে শুল্ক আদায়ের (খাস কালেকশন) বিষয়ে সিন্ধান্ত গ্রহণ করে। ওই কমিটি ৩০ জুন ২০২১ থেকে ১ জুলাই পর্যন্ত শুল্ক আদায় করে। পরবর্তীতে মেসার্স ঈমান আলী নামের ওই প্রতিষ্ঠান খাস কালেকশনের উপর স্থগিতাদেশ চেয়ে আবেদন করেন। উচ্চ আদালত তার পক্ষে রায় দেন। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের প্রেক্ষিতে খাস কালেকশন বন্ধ হয়ে গেলে ইজারা প্রদান কর্তৃপক্ষ বিআইডব্লিউটিএ তখন ইজারা প্রদান পদ্ধতির ৩৩ (খ) (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘স্পট কোটেশন’ পদ্ধতিতে বেড়া উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ রেজাউল হক বাবুকে ৩০ জুলাই ২০২১ থেকে ২৮ আগস্ট ২০২১ পর্যন্ত নগরবাড়ি-কাজীরহাট-নরাদহ এলাকার লেবার হ্যান্ডলিং ঘাট/পয়েন্টটির ইজারার কার্যাদেশ প্রদান করে।
উচ্চ আদালতে রিটকারী মেসার্স ঈমান আলীর স্বত্ত্বাধিকারী আলহাজ ঈমান আলী বলেন, ‘বিআইডব্লিউটিএ’র কয়েকজন অসৎ কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী নেতার যোগসাজসে উচ্চ আদালতের আদেশকে অমান্য করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘দেশের আড়াইশ’র অধিক নৌবন্দর ও ঘাট একসঙ্গে ইজারা দেওয়া হয়েছে। অথচ শুধুমাত্র এই ঘাটের ইজারা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ টালবাহানা করছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মোতাবেক যথাযথ প্রক্রিয়ায় আমি আবেদন করেছি ইজারা নবায়নের জন্য। নির্ধারিত টাকাও পরিশোধ করেছি। কিন্তু আমাকে কার্যাদেশ না দিয়ে, নবায়ন না করে, অন্য একজনকে ইজারা দিয়ে আমাকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে।’
নগরবাড়ি ঘাটের ব্যবসায়ী জিলাল শেখ, শাহজাহান আলী, আব্দুর রহিম নান্নু বলেন, ‘হঠাৎ এই ঘাটের ইজারা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। কতিপয় স্বার্থন্বেষী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী এই ঘাটের পরিবেশ অস্থিতিশীল করতে অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। এখানকার ব্যবসা বাণিজ্য পরিবেশে নষ্ট হতে পারে। ব্যবসায়ীদের ও ঘাটের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে আইন মোতাবেক ঘাট পরিচালনা করার দাবি জানান তারা।’
নগরবাড়ি বণিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা বাবু এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘এই ঘাটের মাধ্যমে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার হয়েছে। সরকারের প্রায় ৬০০ কোটি টাকার নৌবন্দর নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে ঘাটের ইজারা প্রদানের বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত। আমরা ঘাটের পরিবেশ ভাল চাই। যাতে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা না হয়।’
স্থানীয় একাধিক ব্যবসায়ীর অভিযোগ, উচ্চ আদালত যেখানে একজনের পক্ষে রায় দিয়েছেন, ঘাট বুঝিয়ে দিতে নির্দেশনা দিয়েছেন। সেখানে বিআইডব্লিউটিএ আদালতের নির্দেশনা না মেনে, নিজেদের অন্য একটি পদ্ধতিগত আইন দেখিয়ে আরেকজনকে ঘাট ইজারা দিয়েছে কেন, সেটি বোধগম্য নয়।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সবুর আলী বলেন, ঘাটের ইজারা সংক্রান্ত বিষয়টি নিতান্তই বিআইডব্লিউটিএ’র। উপজেলা প্রশাসনের প্রধান হিসেবে আইন শৃংখলা দেখভাল ও সরকারের রাজস্ব আদায়ের বিষয়ে আমি তৎপর। তিনি আরও বলেন, ‘উচ্চ আদালত অবমাননা করা হলে ভুক্তভোগীরা পুনরায় আদালতের আশ্রয় নিতে পারেন।’
বেড়া উপজেলা চেয়ারম্যান ও জাতসাকিনী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি রেজাউল হক বাবু বলেন, ‘নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাকে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ এক মাসের শুল্ক আদায়ের কার্যাদেশ দিয়েছিল। সেটি আরও একমাস বাড়ানো হয়েছে।’ তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের রায় কি, সেটা আমার জানার বিষয় নয়। আইন অমান্য করার প্রশ্ন অবান্তর। যদি কোন ধরণের অমান্য হয়ে থাকে, তাহলে সে বিষয়টি বিআইডব্লিউটিএ’র।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষ আরিচা নদী বন্দরের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) এবং বন্দর ও পরিবহণ কর্মকর্তা মোহাঃ মাসুদ পারভেজের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আদালত অবমাননা হলে তারা তো আদালতে যেতে পারেন। আমাদের আইন উপদেষ্টা আছে তাদের পরামর্শে কাজ করা হয়েছে। এখানে কারো সাথে যোগসাজস করে কিছু করা হয়নি। আমাকে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন সেভাবে কাজ করেছি। আপনারা আমার কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেন। অনুমতি ছাড়া আমার কথা বলা নিষেধ আছে।
নগরবাড়ি ঘাট বণিক সমিতির সহ-সভাপতি ভুক্তভোগী আলহাজ ঈমান আলী বলেন, উচ্চ আদালতের আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আমি আবারও আইনি সহায়তার জন্য আদালতের দারস্থ হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
পাবনা/শাহীন রহমান/এমএম
আরো পড়ুন