ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

যে কারণে বাউল মেহেদীর মাথা ন্যাড়া করে মাতব্বররা

এনাম আহমেদ, বগুড়া  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০০, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১  
যে কারণে বাউল মেহেদীর মাথা ন্যাড়া করে মাতব্বররা

বাউল শিল্পী মেহেদী হাসান

বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলায় বাউল শিল্পী মেহেদী হাসানের (১৬) মাথা ন্যাড়া করে দেওয়ায় তিন মাতব্বরকে আটক করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার (২১ সেপ্টেম্বর) রাতে শিবগঞ্জ সদর ইউনিয়নের জুড়ি মাঝপাড়া গ্রামে অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। এ ঘটনায় মেহেদী হাসান পাঁচজনের বিরুদ্ধে শিবগঞ্জ থানায় মামলা করেন।

ঘটনার শিকার বাউল শিল্পী মেহেদী হাসান বলেন, ‘বেশভূষা এবং বাউল গান করার কারণে আসামিরা বিভিন্ন সময় আমাকে কটু কথা বলতেন এবং হুমকি দিতেন। কিন্তু আমি তাদের সঙ্গে কখনও দ্বন্দ্বে জড়াইনি। তারা কিছু বললেও আমি মাথা নিচু করে চলে গেছি। এক পর্যায়ে গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে তারা বাড়িতে এসে দরজায় নক করে। দরজা খুলে দিলে ঘরে ঢুকে আমাকে বাইরে বের করে এনে মাথা ন্যাড়া করে দেয়। পাশাপাশি আমাকে সাদা পোশাক পরতে ও চুল বড় রাখতে নিষেধ করেন। তাদের কথা না শুনলে পরে আমাকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেন।’

মেহেদী হাসান আরও বলেন, ‘আমি ছোট থেকে গান বাজনা ভালোবাসি। বাউল গান করি। আমি কারও ক্ষতি করিনি। কিন্তু তারা আমার এই ক্ষতি করলো।’

মেহেদী জানান, ৪/৫ বছর হলো তিনি গান করেন। তার গুরু মতিউর রহমান মতিনের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে গানের অনুষ্ঠান করেন। প্রোগ্রাম থাকলে দিনে ৭০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত উপার্জন হয় তার। করোনার কারণে গানের অনুষ্ঠান বন্ধ থাকলেও সম্প্রতি চালু হয়েছে। মাসে ১৫ থেকে ২০ দিন কোথাও না কোথাও গান গাওয়ার সুযোগ হয় তার।

মেহেদী হাসান মাদ্রাসা এবং স্কুল মিলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। ষষ্ঠ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলে করোনার ছুটির পর থেকে লেখাপড়ার সঙ্গে আর সম্পর্ক নেই।

মেহেদী হাসান আরও বলেন, ‘বাউল গানের পাশাপাশি আমি ত্বরিকা চর্চা করি। যে কারণে সাদা পোশাক পরি এবং মাথায় লম্বা চুল রাখি। আমি পীর ইমরান চিশতীর মুরিদ। যে কারণে আসামিরা আমার ওপর বেশি রাগান্বিত ছিলো। আমার পরিবারকে সমাজচ্যুত করার হুমকি দেওয়া হয়। আমি নিজ এলাকায় আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকিত।’

মেহেদী হাসানের প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেহেদী হাসান মুসলিম হয়েও মাটি দিয়ে মূর্তিস্বরূপ কিছু একটা বানিয়ে ঘরের মধ্যে পূজা করতেন বলে স্থানীয় অনেকের ধারণা। তাকে এ ধরণের কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেন অনেকে।

এ বিষয়ে মেহেদী হাসান বলেন, ‘অনেকে মনে করেন  আমার ঘরের মধ্যে মূর্তি রয়েছে। কিন্তু আমার ঘরে কোনো মূর্তি নেই। আমি ঘরের ভেতর মোমবাতি ও আগরবাতি জ্বালিয়ে এবং তসবীহ নিয়ে সারা রাত জিকির করি। শুধু যেদিন গানের অনুষ্ঠানের জন্য বাইরে থাকতে হয়, সেদিন জিকির হয় না। আমি ইসলাম ধর্মের অনুসারী হয়ে পূজা করতে কেন যাবো? আমি আল্লাহ ও রাসুলকে স্মরণ করি।’

শিবগঞ্জ উপজেলার ধাওয়াগীর গ্রামের মতিন বাউল বলেন, ‘আমি আব্দুল কাদের জ্বিলানী (রহ.) পীরের ত্বরিকার ভক্ত। মেহেদী হাসান পীর ইমরান চিশতির ভক্ত। ত্বরিকার লোকদের সাধারণত গুরুকর্ম আছে। আল্লাহ, রাসুলের নামে দরুদ শরীফ পাঠ করা হয়। সুরা ক্বেরাত পাঠ করা হয়। আরও কিছু নফল ইবাদত আছে। যেগুলো সারা রাত ধরে হয়তো কেউ করে। মেহেদীর সঙ্গে যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা হয়তো গুরুকর্ম পছন্দ করে না; এজন্য তারা এ কাজ করেছে।’

শিবগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সিরাজুল ইসলাম জানান, আরও দুইজন পলাতক রয়েছেন। তাদেরও আটকের চেষ্টা চলছে। আটকরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে দোষ স্বীকার করেছেন এবং জানিয়েছেন- মেহেদী হাসান বাউল গান করেন ও ঘরের ভেতর মোমবাতি জ্বালিয়ে গুরুকে ভক্তি করেন, এ কারণে তারা এই ঘটনা ঘটিয়েছেন। তবে তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছেন।’

আরও পড়ুন: বগুড়ায় বাউল শিল্পীর মাথা ন্যাড়া করার অভিযোগে গ্রেপ্তার ৩ 

বগুড়া পুলিশ সুপার ‍সুদীপ চক্রবর্তী বলেন, মেহেদী হাসান যেহেতু বাউল, সেহেতু তার মধ্যে আধ্যাত্মিকতা নিয়ে আরাধনার একটি বিষয় আছে। এটি নিয়ে গ্রামের কারও কারও মধ্যে দ্বিমত আছে। এ কারণে অভিযুক্তরা ক্ষিপ্ত হয়ে তার বাসায় গিয়ে চুল কেটে দেয়।

পুলিশ সুপার বলেন, এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মেহেদী হাসান কিন্তু আরাধনা নিজ বাড়িতেই করতেন। ঘরের বাইরে বা কারো অসুবিধা করে কিছু করতেন না। ঘটনা জানার পরই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এই মামলার তদন্ত যথাযথভাবে করা হবে বলে জানান তিনি। 

/বকুল/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়