ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কেন এত অস্থিরতা?

তারেকুর রহমান, কক্সবাজার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১৫, ২৬ অক্টোবর ২০২১   আপডেট: ১৫:০৮, ২৬ অক্টোবর ২০২১
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কেন এত অস্থিরতা?

১৯৭৮ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চার ধাপে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় আরও আট লাখ রোহিঙ্গা। পালিয়ে আসার মাস দুয়েক না যেতেই বেপরোয়া হয়ে উঠে তারা। আধিপত্য বিস্তার কিংবা দাম্ভিকতার জেরে প্রতিদিন সংঘাতে জড়াচ্ছে তারা।

রোহিঙ্গাদের কিছু গোত্র বা সংগঠনের কারণে ক্যাম্পে অপরাধ প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলছে। খুন, ধর্ষণ, মাদক পাচার, শিশু পাচার, ডাকাতি, অপহরণ, যৌন নিপীড়নসহ সব ভয়ঙ্কর অপরাধের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে এই রোহিঙ্গারা।

গত তিন সপ্তাহের ব্যবধানে কক্সবাজারের উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নৃশংসতম দুটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এরমধ্যে ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা ও আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’র (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহ এবং ২২ অক্টোবর ভোর রাতে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১৮ এর এইচ-৫২ ব্লকে অবস্থিত ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ’ মাদ্রাসায় ৬ রোহিঙ্গা খুন হন। 

প্রথমে পুলিশ ক্যাম্পে দু’গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের কথা বললেও পরে ক্যাম্পে দায়িত্বরত এপিবিএন পুলিশ মাদ্রাসায় হামলার কথা নিশ্চিত করেন।

রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা অপরাধ কর্মকাণ্ডে মিয়ানমারের সিম কার্ড ব্যবহার করে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে বলে সূত্রে জানা গেছে। শুধু তাই নয়, এ সমস্ত কার্যকলাপে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে স্থানীয়দের ওপর। কারণ ক্যাম্পে সন্ধ্যা নামলেই গ্রুপে গ্রুপে শুরু হয় সংঘর্ষ। এক গ্রুপ অন্য গ্রুপকে ধাওয়া করে। এতে করে আশপাশে বসবাসরত বাংলাদেশিরা সবসময় আতঙ্কগ্রস্ত থাকে। 

রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত ক্যাম্পে গড়ে উঠা কয়েকটি সংগঠন রোহিঙ্গাদের নেতৃত্ব দিতে বা তাদের ওপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য প্রভাব খাটাতে চায়। এরমধ্যে কোনো সংগঠন বা ব্যক্তি রোহিঙ্গা অভিভাবক হিসেবে কাজ করলেই শক্তিশালী সংগঠনের টার্গেটে পড়ে। এভাবে এক সংগঠন অপর সংগঠনকে টার্গেট করে এবং শীর্ষ নেতাদের শেষ করে দিতে চায়। ঠিক তেমনি প্রত্যাবাসনের কথা বলার কারণেই শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যা করেছে প্রত্যাবাসন বিরোধী সন্ত্রাসীরা। 

রোহিঙ্গা আসার গত চার বছরে ক্যাম্পে এরকম আতঙ্কজনক পরিস্থিতি আর কখনো তৈরি হয়নি। কেননা, তাদের অধিকার আদায় ও পক্ষে কণ্ঠ তোলার জন্য যে ব্যক্তি ছিলেন (শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ) তাকেও আততায়ীরা নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করে। এভাবে দিনের পর দিন ক্যাম্পে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

রোহিঙ্গারা বলছে, এই ঘটনার পর থেকে সন্ত্রাসী হামলার ভয়ে অনেক রোহিঙ্গা নেতা আত্মগোপনে চলে গেছেন। এমনকি তারা মোবাইল ফোনও বন্ধ রেখেছেন। 

উখিয়ার পালংখালীর ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘দিনের পর দিন রোহিঙ্গারা স্থানীয়দের ওপর হামলা করছে। এমনকি তাদের হাতে খুন হয়েছে স্থানীয় অনেক লোকজন। স্থানীয়দের গুম করে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে তারা। এ ছাড়া ক্যাম্পে আগুন ধরিয়ে দিয়ে অস্থির পরিবেশ সৃষ্টি তাদের কাজ। এ অবস্থা চলতে থাকলে ক্যাম্পগুলোর আশপাশে স্থানীয়দের বসবাস অযোগ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে।’

এ ব্যাপারে ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক এস নাইমুল হক রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে গেছে। বিশেষ করে তাদের নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার পর আরও একটি বড় ঘটনা ঘটে। ইতিমধ্যে কিছু অপরাধী ও অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছি। বাকিদেরও ধরার অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এপিবিএন পুলিশ সবসময় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে।’

কক্সবাজার জেলা পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে টেকনাফ ও উখিয়া থানায় ১৩টি অস্ত্র মামলা হয়েছিল। পরের বছর তা বেড়ে হয় ১৭টি। আর ২০২০ সালে ২৭টি। চলতি বছরের ৯ মাস ২৩ দিনে ১৫টি হয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের থেকে ১৪টি দেশীয় পিস্তল, ৪৪টি এলজি, তিনটি বিদেশি পিস্তল, ৩০টি একনলা বন্দুক, ২৫টি দেশি বন্দুক, চারটি পাইপগানসহ প্রচুর পরিমাণ ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ১২৩টি অস্ত্র পুলিশ উদ্ধার করেছে।
 
এদিকে, রোহিঙ্গাদের এমন অপরাধী কর্মকাণ্ড ও নিজেদের নিরাপত্তা চেয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছে দাবি জানিয়েছে স্থানীয় বাসিন্দা ও সচেতন মহল। তারা বলছেন, মানবতার খাতিরে জায়গা দিয়ে এখন নিজেরাই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। রোহিঙ্গাদের অন্তবিরোধ ও গোলাগুলিতে দেশে যেকোনো বড় ধরনের ঘটনা ও অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। 

স্থানীয়দের দাবি, কক্সবাজারের প্রতিটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রেইডব্লক দিয়ে ভেতরে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে অপরাধী ও তাদের অস্ত্রশস্ত্র জব্দ করতে হবে। অপরাধ দমনে প্রয়োজনে ক্যাম্পে স্পেশাল ফোর্স নিয়োগেরও আহ্বান জানান তারা।

আরও পড়ুন: রোহিঙ্গাদের সংঘর্ষ, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আতঙ্কিত স্থানীয়রা 

আধিপত্য বিস্তার নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংঘর্ষ: নিহত ৬, আটক এক

সন্ত্রাসীর গুলিতে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ নিহত

‘সন্ত্রাসীরা কোনো সুযোগ দেয়নি মুহিবুল্লাহকে’

রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার ঘটনায় মামলা

যেভাবে উত্থান রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর


 

কক্সবাজার/এনএইচ/এমএম

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়