ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

সারা দেশে উষ্ণতা ছড়াচ্ছে নয়ারহাটের শীতবস্ত্র

গাইবান্ধা প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৩১, ৯ নভেম্বর ২০২১   আপডেট: ১৫:৩৯, ৯ নভেম্বর ২০২১
সারা দেশে উষ্ণতা ছড়াচ্ছে নয়ারহাটের শীতবস্ত্র

প্রতিদিন খট খট শব্দে ঘুম ভাঙে তাদের। ঘুমাতে যান খট খট শব্দ শুনতে শুনতেই। মাঝে সারাটা দিন কাটে সোয়েটার, মোজা ও কার্ডিগানসহ নানা ধরনের শীতবস্ত্র তৈরি ও সুতা কাটার ব্যস্ততায়।

এভাবেই কেটে যাচ্ছে ফাতেমা, আয়শা, নাজমা, হামিদ মিয়া ও মহির মন্ডলের মতো শত শত নারী পুরুষের জীবন। কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মালিক, শ্রমিক, কারিগর, গৃহিনী থেকে শুরু করে সবাই কাজ করে হাতে পায়ে। তারপর তৈরী হয় সোয়েটার, মোজা, চাঁদর, হাত মোজাসহ নানান বাহারী শীতবস্ত্র। আর এই শীতবস্ত্র চলে যায় সারাদেশের হাটে বাজারে।

গাইবান্ধা শহর থেকে সোজা দক্ষিণে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার দুটি ইউনিয়নের নাম কোচাশহর ও মহিমাগঞ্জ। দুই ইউনিয়নেরর নয়ারহাট, ধারাইকান্দি, কানাইপাড়া, মহিমাগঞ্জের পুনতাইড়সহ অন্তত ১২টি গ্রাম জুড়ে অত্যাধুনিক শীতবস্ত্র তৈরীর শত শত কারখানা গড়ে উঠেছে। আর এসব কারখানার মালিকও গ্রামের বাসিন্দারা। 

এক সময় কেউ কেউ শ্রমিক থাকলেও এখন নিজেরাই ছোট বড় শীতবস্ত্র তৈরীর কারখানা গড়ে তুলেছেন । শীতকে সামনে রেখে পুরো গরম কাল জুড়ে কারখানা গুলোতে ব্যস্ততা শুরু হয়। 

ধারাইকান্দি গ্রামের আবুল কাসেম জানান, আমার জমি আছে। জমি চাষ করার পাশাপাশি বাাড়িতে হোসেয়ারী কারখানা দিয়েছি। বাড়ির মহিলা, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধরা মিলে দিনরাত কাজ করি। কেউ সুতা কাটি, মেশিনে লাগাই, কেউ সোয়েটার, হাত মোজা , মাফলারসহ অন্য শীতবস্ত্র তৈরী করি । পাশাপাশি শ্রমিকের প্রয়োজন হলে অন্যকে চড়া দামে কাজে লাগাই। হোসিয়ারী শিল্পের এই গ্রাম গুলোতে কেউ বসে থাকেনা বলেন জানালেন বৃদ্ধ আফসার আলী। তার বয়স অনেক। কাজ করতে না পারলেও বসে থাকেন না তিনিও। পাশে বসে সুতা লাগানোর কাজ করেন মেশিনে। তিনি বলেন, ‘আমরা আগে কাঠের তৈরী মেশিনে কাজ করেছি। কিন্তু এখন দিন বদলে গেছে। কাঠের মেশিন আর নাই। বাড়িতে বাড়িতে আধুনিক মেশিন চলে। মেশিনে তৈরী হয় আধুনিক শীতবস্ত্র।

মর্জিনা বেগম নামে এক গৃহিনী জানান, চার ছেলে  মেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে নিয়ে বাড়িতে মেশিন বসিয়েছেন দুটি । মেশিনে কোন শ্রমিক নিতে হয়না । স্বামী ছেলে মেয়েসহ ৬ জনই কাজে ব্যস্ত থাকে। এর ফাকেই চলতে থাকে সাংসারিক কাজ ও খাওয়া দাওয়া। সোয়েটার, মাফলার ,কার্ডিগানসহ নানান শীতবস্ত্র তৈরী করে বাড়িতে পিল দিয়ে রাখতে হয়। পাইকার এসে বাড়ি থেকে প্রয়োজনমত মালামাল কিনে নিয়ে যায়। 

শিল্পকারখানা গুলোর চাহিদার কারণে ওই এলাকাতে গড়ে উঠেছে বাজার ব্যবস্থাপনা। তারা হাটের নাম দিয়েছেন নয়ারহাট। প্রবীন একজন হোসিয়ারী ব্যবসায়ীর নাম অনুসারে এই হাটের নাম দেয়া হয়েছে । এই হাটে শত শত দোকান আছে। সব দোকানে গিজগিজ করে সাজানো আছে রং বেরং এর শীতবস্ত্র। 

কোচা শহর ইউপি চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন বলেন, দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ শীত বস্ত্র তৈরী হয় এখানে। এবার ছোট-বড় মিলিয়ে কয়েকশ কারখানায় বিক্রির অপেক্ষায় রয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার শীতবস্ত্র। এই শিল্প একদিকে যেমন দেশের মানুষকে প্রচন্ডশীতে উষ্ণতার পরশ দিয়েছে তেমনি দারিদ্রপীড়িত এই এলাকার শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের দিয়েছে আর্থিক স্বচ্ছলতা। 

একটি ছোট কাখানায় বছরে প্রায় ১০ হাজার পিছ সোয়েটার এবং তুলনামূলকভাবে বড় কারখানাগুলো ১ লাখ পিস সোয়েটার তৈরী হয়। বড়দের সোয়েটার প্রকারভেদে প্রতিপিছ ২০০ থেকে ৬০০ টাকা, মাফলার প্রতিপিছ ৫০ থেকে ১০০ টাকা, গার্ডিগান প্রকারভেদে প্রতিপিছ ৩০০ থেকে ৬০০ টাকায় পাইকারি বিক্রি হচ্ছে। 

নয়ারহাটে শীতবস্ত্র কিনতে আসেন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা। তারা এসব শীত বস্ত্র পাইকারি কিনে নিয়ে বিক্রি করেন বিভিন্ন দোকান বা শো রুম গুলোতে। হোসিয়ারী মালিক সমিতির সভাপতি মিজানুর রহমান জানান, আমরা অনেক ভালো শীতের পোষাক তৈরী করে থাকি। কিন্তু আমারা অবহেলিত এলাকার বাসিন্দা। তাই মূল্যায়ন হয়না। স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা এই কুটির শিল্পে সরকারি কোন পৃষ্ঠপোষকতা বা সুযোগ সুবিধা না থাকায় আশানুরূপ সাফল্য আসছেনা। বিদ্যুত বিল ঠিকই দেই কিন্তু নিয়মিত ও চাহিদা মতো বিদ্যুৎ পাই না । 

তিনি দাবী করেন, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কোচাশহর-নয়ারহাট কুটির শিল্প এলাকার মানুষের মধ্যে অভাব অনটনের লেশমাত্র নেই । কারণ তারা সবাই কর্মব্যস্ত জীবন কাটায়। ফলে একেক জন শ্রমিক দিনে কাজের মাধ্যমে অন্তত হাজার টাকা পর্যন্ত মজুরী পেতে পারে । 

গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ জানান, এই হোসিয়ারী শিল্প এখন দুই ইউনিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। এখনকার মানুষ সব সময় কাজে ব্যস্ত থাকে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকারি ক্রেতারা এসে বিপদে পড়েন। এখানে কোনো ব্যাংক নেই । প্রতিদিন কোটি টাকার কেনা বেচা হলেও তাদের যেতে হয় গোবিন্দগঞ্জ অথবা একটু দূরে। নয়ারহাটে ব্যাংক থাকলে আর্থিক নিরাপত্তা থাকতো ।  

দয়াল/ মাসুদ 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়