ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘ঘর বিক্রি করে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম’ 

নরসিংদী প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫০, ৩ ডিসেম্বর ২০২১   আপডেট: ১৬:৫৪, ৩ ডিসেম্বর ২০২১
‘ঘর বিক্রি করে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম’ 

ফারুক মিয়া রণাঙ্গনের বীরযোদ্ধা। পাকবাহিনীকে হটাতে বাংলার এই দামাল ছেলে দেশপ্রেম আর অসীম সাহসিকতা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। অংশ নিয়েছেন বেশ কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধে।

মুক্তিযুদ্ধের আগে ফারুক মিয়া ১১ মাস সেনাবাহিনীর ফোর বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকরি করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেনাবাহিনীতে যোগ দেননি। বর্তমানে ৮০ বছরের এই বৃদ্ধ পরিবার নিয়ে বাস করছেন নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার শ্রীরামপুর নিজ বাড়িতে।

ফারুক মিয়া যুদ্ধদিনের স্মৃতি রাইজিংবিডির পাঠকদের কাছে তুলে ধরেছেন:

১৯৭১ সালের মার্চে আমি সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলাম ঢাকায়। ২৪ মার্চ অফিসারদের কয়েকজন যুদ্ধের আশঙ্কার কথা বলছিলেন। তখনই আমরা বুঝতে পারি সামনের দিনগুলোতে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। আমি সেদিনই শ্রীরামপুর গ্রামে চলে আসি। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি সেনারা। রেডিও না থাকায় তখনই খবরটি জানতে পারিনি। তবে পরদিন বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দলে-দলে ঢাকা ছেড়ে লোকজন গ্রামে আসতে শুরু করে। তাদের মুখেই প্রথম যুদ্ধ শুরু হওয়ার খবর পাই।

এপ্রিল মাসের ১৬ তারিখ সিদ্ধান্ত নিলাম ভারত চলে যাব। শুরুতে পরিচিত বন্ধুদের কেউ যুদ্ধে যেতে রাজি হয়নি। পকেটে একটি টাকাও নেই। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম। প্রশিক্ষণ নেওয়ায় আত্মবিশ্বাস ছিল। আগে-পিছে না ভেবে একচালা ছোট একটি টিনের ঘর ১৭ টাকায় বিক্রি করে দিলাম। কারণ যে করেই হোক বর্ডার ক্রস করে ভারতে  যেতে হবে। বাবা-মা, স্ত্রীর সঙ্গে আমার শেষ কথা ছিল: যুদ্ধ শেষে বেঁচে ফিরলে দেখা হবে।

প্রথমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের আগরতলা চলে গেলাম। এরপর সেখান থেকে ত্রিপুরার ওমপিনগর ক্যাম্পে। আলফা, বিবি, চাওলি, ডালটা ও ইকো- পাঁচটি গ্রুপে ভাগ করে দেওয়া হতো প্রশিক্ষণ। আমি ছিলাম ইকোতে।

২৯ দিন পর প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে এলাম। শুরু হলো আমার যুদ্ধ। ৩ নম্বর সেক্টরের অধীনে রায়পুরা উপজেলার হাঁটুভাঙ্গা, ভৈরবের শৈকারচর, বেলাব নীলকুঠি অঞ্চলে কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছি। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর জেনারেল এ.এন.এম নূরুজ্জামান। আর গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন উপজেলার চরাঞ্চলের ভেলুয়ারচরের সিদ্দিকুর রহমান।

আমাদের সবচেয়ে সফল যুদ্ধ সংঘঠিত হয় হাঁটুভাঙ্গা (বর্তমান বুলেট চত্বর) রেল ব্রিজ এলাকায়। পাকিস্তানি ২৫ জন সেনাকে আমরা চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলি। শুরু হয় উভয়পক্ষের প্রাণপণ লড়াই। সেদিন যুদ্ধে আমাদের রাইফেলের গুলি ও মর্টারের আঘাতে ১৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। আহত একজন বাদে সবাই পালিয়ে যায়। পরে ওই পাকসেনা স্থানীয় জনগণের গণধোলাইয়ে মারা যায়।

সেদিন প্রায় সব নিহত সেনার পকেটে মিনি কোরআন শরীফ পেয়েছিলাম। আমি এখনও বুঝি না মুসলমান হয়ে ওরা কীভাবে আরেকজন মুসলমানের ওপর এতো বড় নির্যাতন, গণহত্যা চালিয়েছিল। আমরা যুদ্ধ করেছিলাম ন্যায়ের জন্য, স্বাধীনতার জন্য। যুদ্ধটা ওরা চাপিয়ে দিয়েছিল। যাই হোক, সেদিন বারেক, নুরু ও বেলাব উপজেলার একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীন হন। তবে আমাদের গ্রুপের সবাই ছিলাম সুরক্ষিত।

আজও ঘৃণায় মন বিষিয়ে ওঠে। আমাদেরই কিছু মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল। হাত মিলিয়েছিল পাকসেনাদের সঙ্গে। সায়েন চৌধুরীর নেতৃত্বে আনছার আলী মাস্টার ও আওয়াল ডাক্তার অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে পাকসেনাদের হাতে তুলে দিয়েছিল। রায়পুরা উপজেলার কোলনিতে ওরা ক্যাম্প করে। ক্যাম্পে আটক করে রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মম নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হতো। লাশগুলো ফেলে দিতো মেথিকান্দা স্টেশনের পাশে বধ্যভূমিতে। রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকসেনারা যুবতী মেয়েদের তুলে নিয়ে যেতো। গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, ধান, চাল লুট করে নিয়ে যেতো তারা। অগ্নিসংযোগ করতো হিন্দুদের বাড়িঘরে।

যুদ্ধের সেই স্মৃতি আজও আমাকে কাঁদায়। একদিন  পাকিস্তানি সেনারা কোলনির ক্যাম্পে শ্রীরামপুর গ্রামের হাফিজ মেম্বারকে ধরে নিয়ে যায়। মেজর মঞ্জুর তার পুরো শরীরে গরম লোহার সেক দিয়ে ঝলসে দিয়েছিল। হাফিজের গগণবিদারী আর্তচিৎকারে এলাকার মানুষের বুক কেঁপে উঠতো। কিন্তু পাকসেনারা এতে আনন্দ পেতো। এভাবেই তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে ওরা হাফিজকে মেরে ফেলে। বীভৎস সেই স্মৃতি মনে হলে বুক কেঁপে ওঠে। তখন ইচ্ছে করতো অত্যাচারী মেজর মঞ্জুর আলমের শরীরের মাংস কাঁচা খেয়ে ফেলি!

এ দুই চোখে কত মৃত্যু দেখেছি তার হিসাব নেই। আড়িয়াল খাঁ দিয়ে অসংখ্য পাকিস্তানি সেনা ও মুক্তিযোদ্ধার লাশ ভেসে যেতে দেখেছি। লাশের দুর্গন্ধে পানিতে তখন নামা যেত না। 
 

গাজী হানিফ মাহমুদ/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়