ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

নিভৃতে মৃত‌্যুর পথে মেহেরপুরের মুক্তিযোদ্ধা ছাদেক হোসেন

মহাসিন আলী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:২৯, ৬ ডিসেম্বর ২০২১  
নিভৃতে মৃত‌্যুর পথে মেহেরপুরের মুক্তিযোদ্ধা ছাদেক হোসেন

মুক্তিযোদ্ধা ছাদেক হোসেন ও তাঁর স্ত্রী রাবেয়া

দীর্ঘ সাত বছর তিন মাস ধরে বিছানায় পড়ে আছেন এক সময়ে রণাঙ্গণের বীর মুক্তিযোদ্ধা ছাদেক হোসেন (৮৮)। সবার চোখের আড়ালে নিভৃতে খানিকটা অবহেলায় চির বিদায়ের পথে পা বাড়িয়ে রেখেছেন এই যোদ্ধা। যুদ্ধে দেশ স্বাধীন হলেও নিজের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়নি তাঁর। এমনকি চিকিৎসার জন‌্য পাননি সরকারি সহায়তাও।

মেহেরপুরের যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ছাদেক হোসেনের খোঁজ এখন আর কেউ রাখে না। ৮নং সেক্টরের লড়াকু সৈনিক ছিলেন ছাদেক হোসেন। 

মুক্তিযোদ্ধা ছাদেক হোসেন বলেন, ‘‘বাংলা ১৩৯৩ সালের ১৮ পৌষ শনিবার বহুল প্রচারিত একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা প্রকাশ হয়। সেই তালিকায় আমার নাম ৫ নম্বরে লিপিবন্ধ আছে। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার মুক্তিবার্তা লাল বইয়ে আমার মুক্তিযোদ্ধা নং ০৪১০০১০৪৫৪। আইডি নং ০৪০৮০১০৩৩৭। মুক্তিযোদ্ধা ভোটার নং ৪২৪। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সনদ নং ম-৪৯৭৩। 

‘সাবেক জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বশির আহম্মদ এই মর্মে সনদপত্র দিয়েছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আমার সব তথ্য পাঠিয়েছেন। ২০১৫ সালে মেহেরপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য, জনপ্রশাসন মন্ত্রাণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক ফরহাদ হোসেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো আবেদনে ছাদেক হোসেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এই মর্মে সুপারিশ করেছেন। আমার নাম ২নং তালিকায় ক্রমিক নং ৩৯২ ও পরিচিতি নং২৫৮ প্রকাশ করা হয়।” 

১৯৪৮ সাল থেকে ছাদেক হোসেন আনসার কমান্ডার ছিলেন। তার ওস্তাদ ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সেনাবাহিনীর হাবিলদার মোস্তাক খান। তিনি ১৯৭১ সালে মেহেরপুর মহকুমা স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান ডাক্তার সামসুজ্জোহা কোরাইশীর অধীনে ড্রাইভার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন বসন্ত নির্মূল অভিযানের ল্যান্ড রোভার জীপ গাড়ি (নং-ঢাকা-ব-৯৬)। 

স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিচারণে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “পাক সেনা ও তাদের দোসরদের অত্যাচারে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। পাক সেনারা মেহেরপুর সদর উপজেলার যাদবপুর গ্রামসহ কয়েকটি গ্রাম মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি সন্দেহে জ্বালিয়ে দিয়েছিল। অনেক মা-বোনের ওপর অত্যাচার, নিপিড়ন করেছিল। তাদের প্রতিহত ও মেহেরপুর থেকে পাক সেনাদের নির্মূল করার প্রতিজ্ঞা করে আমার সাত ভাই, পাঁচ ভাতিজা ও তিন ভাগ্নেসহ সদর উপজেলার বন্দর গ্রামের ৬৪ জন আনসার সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে স্বপরিবারে ভারতের নদীয়া জেলার তেহট্টো থানার লালবাজারে চলে যাই। 

‘সেখানে ইয়্যুথ ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। আমার পারদর্শিতা দেখে সেখান থেকে ১৪ দিন পর লালবাজারের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন ইয়ার আযম চৌধুরীর কার্যালয়ে মেডিক্যাল টিমে কাজ করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। ওই মেডিক‌্যাল টিমের প্রধান ছিলেন ডাক্তার আব্দুল মান্নান। রণাঙ্গণে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবার কাজে নিয়োজিত হই। বাংলাদেশের সীমান্তে পাক সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র, গুলি, ওষুধ ও খাদ্য সামগ্রী সরবরাহ করতাম। মাঝে মাঝে মুখামুখি যুদ্ধে অংশগ্রহণও করেছি। 

‘গুলিবিদ্ধ আহত মুক্তিযোদ্ধাদের গাড়িতে করে ভারতের শক্তিনগর হাসপাতালে ভর্তি করাতাম। এছাড়া ক্যাপ্টেন ইয়ার আযম চৌধুরীকে কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন মিশনে নিয়ে যেতে হতো। একদিন ভারতের চাপড়া মুক্তিযোদ্ধা মেডিক্যাল টিমে গিয়ে কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের মেডিক্যাল টিমের জেনারেল সেক্রেটারি ডাক্তার সামসুজ্জোহা কোরাইশের সন্ধান পাই। তারপর থেকে সেখানে কাজ করতে শুরু করি।”

স্মৃতিচারণে তিনি আরও বলেন, ‘‘এর আগে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ মেহেরপুর মহাকুমা প্রশাসক তৌফিক-ইলাহী ও স্থানীয় এমপি মরহুম ছহিউদ্দিনের নির্দেশে ঢাকা থেকে আসা এমপি আশরাফুল ইসলামকে জিপ গাড়িতে করে মেহেরপুরের ইছাখালী সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের বেতাই উঠি। সেখানে একটু বিশ্রাম নিয়ে কৃষ্ণনগর হয়ে কলকাতার মগবাজারের এক বাসায় তাকে পৌঁছে দিই। এসময় কয়েকজন সাংবাদিক আমাকে ঘিরে ধরে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। 

‘ভারতে যাওয়ার সময় আমার গাড়িতে আরও দুজন আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। এরা হলেন- মেহেরপুর শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মরহুম খাদেম আলী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম আশরাফুল হক ওরফে পটল মিয়া। সেখান থেকে ফিরে নিজ গ্রাম মেহেরপুর সদর উপজেলার বন্দর গ্রাম থেকে সহকর্মী ৬৪ জন আনসার সদস্যকে নিয়ে ৭১’র ৩১ মার্চ কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন ও জিলা স্কুলে পাকসেনাদের সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। এ যুদ্ধ পরিচালনা করেন মেহেরপুরের গাংনীর মহাম্মদপুর গ্রামের প্রাক্তন ক্যাপ্টেন এমপি নূরুল হক ও ক্যাপ্টেন ইয়ার আযম চৌধুরী। 

‘ভয়াবহ সেই যুদ্ধে অনেক আনসার, ইপিয়ার, মুজাহিদ ও পুলিশের প্রাণ ঝরে যায়। এই যুদ্ধে আমার আপন ভাগ্নে আনসার মুনসুর আলী পাকসেনাদের গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হয়। বাড়িতে নিয়ে আসার ৬ দিন পর চিকিৎসার অভাবে মারা যায় সে। রাষ্ট্রীয়ভাবে তার খোঁজ কেউ রাখেনি। তার কবরও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। 

‘ভাগ্নে মারা যাওয়ার ও পাকসেনাদের অত্যাচারে টিকতে না পেরে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাই। সেখানে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় আত্মনিয়োগ করি।” 

ভাগ্নে মুনসুর আলীর ছবি বুকে ধারণ করে এই মুক্তিযোদ্ধা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন- আর কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে চিকিৎসার অভাবে মরতে দেবেন না। কিন্ত তিনিই এখন চিকিৎসার অভাবে মৃত‌্যু পথযাত্রী। ডিসেম্বর মাস এলে ভাগ্নের স্মৃতি মনে পড়ে। তখন রাতের আঁধারে সবার অগোচরে গুমরে কাঁদেন। 

তিনি বলেন, ‘শান্তনার ভাষা খুঁজে পাইনি। বৃদ্ধ হয়ে গেছি। তবুও কোথাও মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশ হলে কষ্ট হলেও ছুটে যেতাম। সহকর্মীদের কাছে পেয়ে একটু শান্তি পেতাম। এখন আর নড়াচড়ার শক্তি নেই।’

তার স্ত্রী মঞ্জুয়ারা খাতুন রাবেয়া বলেন, ‘২০১৪ সালের ১৬ আগস্ট ভোরে নামাজের জন্য ঘর থেকে উঠানে নামেন উনি। বৃষ্টির পানিতে পা পিছলে পড়ে যান। ওই ঘটনায় তার ডান পাশে হিপ জয়েন্টের তিনটি হাড় ভেঙে যায়। চিকিৎসার জন্য ১৭ আগস্ট উনাকে ঢাকায় নেওয়া হয়। ধানমন্ডির নর্দান ইন্টারন্যাশনাল মেডিক‌্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ১৮ আগস্ট অপারেশন করা হয়। এতে শেষ সম্বল দুই লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়ে যায়। তারপরও তিনি সুস্থ হতে পারেনি।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিদিনের চিকিৎসার ব্যয় আর চালাতে পারছি না। অসহ্য ব্যথায় কাতরাতে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধ করে আমি আমরা পেলাম? এখন তিনি মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। সরকারি তত্ত্বাবধানে তার চিকিৎসা সেবা দেওয়া হলে হয়তো তাকে বাঁচিনো যেত।’

তার বড় ছেলে আবু লায়েছ লাভলু বলেন, ‘কোনো রকমে বাবার চিকিৎসা খরচ চালানোর চেষ্টা চালাচ্ছি। আফসোস হয়, বাবা এতদিন ধরে অসুস্থ কিন্তু কোনো মুক্তিযোদ্ধা বা সরকারের পক্ষ থেকে কেউ আজও কোনো খোঁজ নিলো না। বাবাকে দেখতেও এলো না।’

জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার আলতাফ হোসেন বলেন, ‘ছাদেক ভাই অসুস্থ শুনেছি। কিন্তু দীর্ঘদিন জেলা মুক্তিযোদ্ধাদের কমিটি না থাকায় আমরা তার জন্য কিছু করতে পারিনি।’

মেহেরপুর/সনি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়