ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

‘মৃত্যু নিশ্চিত করতে গেলে পাকসেনারা আমাকে গুলি করে’

মৌলভীবাজার প্রতিনিধি  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৫৭, ১১ ডিসেম্বর ২০২১  
‘মৃত্যু নিশ্চিত করতে গেলে পাকসেনারা আমাকে গুলি করে’

একাত্তরে টগবগে যুবক হিমেন্দ্র। একদিন হঠাৎ রাস্তায় তাকে আটকে ফেলে পাকসেনারা। কাদায় তাদের জিপ আটকে যাওয়ায় তারা তাকে গাড়ি উদ্ধারের কাজে লাগায়। একপর্যায়ে পাকসেনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে মনু নদীতে ঝাঁপ দেন তিনি। এরপর সাঁতরে নদী পার হয়ে বাড়ি ফেরেন। এই ঘটনার পর রাগে-ক্ষোভে হিমেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার সংকল্প করেন।

এখনো সেই ক্ষোভ এবং যুদ্ধদিনের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন একাত্তরের রণাঙ্গনের বীরসেনা হিমেন্দ্র শেখর দত্ত।

হিমেন্দ্র তখন কুলাউড়া কলেজে পড়ালেখা করতেন। একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে নবাব আলী সাফদার খানের ডাকে তার বাড়ি যান। সেদিনের  স্মৃতিচারণ করে হিমেন্দ্র বলেন, স্থানীয় রাজা সাহেবের বাড়িতে বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার সিকান্দার আলীর নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ চলছিল। দশ-বারো জন প্রশিক্ষণ নিচ্ছে দেখে আমিও তাদের দলে যুক্ত হয়ে যাই। 

রাজা সাহেব মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যে পরিশ্রম করেছেন তা অতুলনীয়। অথচ কেউ কোনোদিন তার নাম মুখে নেয়নি। ক্ষোভ প্রকাশ করে হিমেন্দ্র বলেন, এরপর আমরা আটাশ জনের একটি দল নিরাপত্তার জন্য ভারতের কৈলাশহর চলে যাই। কৈলাশহর বিমানবন্দরের উত্তর পাশে রাজা সাহেবের আরেকটি বাড়ি ছিল। সেখানেই আমরা ছিলাম। এরপর লোহাগড়া ট্রেনিং সেন্টারে চলে যাই উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য। 

হিমেন্দ্র শেখর দত্ত বলেন, ২১ দিনের ট্রেনিং শেষ করে প্রথম যুদ্ধে অংশ নেই শমসেরনগরে, এরপর কুলাড়ায়। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের বাংলোতে এসে আমাদের সব সেক্টরের ম্যাপ বুঝিয়ে দেন। আমাদের নিয়ে তিনি মিটিংও করেন। এরপরই শুরু হয় আমাদের অ্যাকশন। প্রথমে বোমা বিস্ফোরণে মৌলভীবাজারের চাঁদনীঘাটের সেতু উড়িয়ে দেই। শমসেরনগর বিমান বন্দর থেকে যাতে পাকসেনারা মৌলভীবাজার ঢুকতে না পারে সেজন্য চৈত্রঘাটের ব্রিজটিও উড়িয়ে দেই। এরপর থেকে পাকসেনারা বিমান থেকে নেমে অন্য কোনো উপজেলায় যেতে পারেনি। তখন বাধ্য হয়ে হাইল-হাওর দিয়ে পাক বাহিনীর খাদ্য ভর্তি  লঞ্চ যেত। আমরা পরিকল্পনা করি লঞ্চ উড়িয়ে দেয়ার জন্য। ভূমি জরিপ জানায় সহজে দুই দিকে দুটি আর্টিলারি ফিট করি। লঞ্চ আসা মাত্র শুরু হয় আক্রমণ। লঞ্চ ডুবিয়ে দিতে সেদিন আমাদের সময় লাগেনি। 

এরপর বর্তমান জুড়ী উপজেলার লাঠিটিলায় মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। এখানে পাকসেনারা বড় বড় বাঙ্কার তৈরি করে। তখন বিমান হামলা করে বাঙ্কারসহ সব উড়িয়ে দেয়া হয়। সেদিন শতাধিক পাকসেনা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। 

কথাগুলো বলতে বলতে আবেগ ও উত্তেজনায় কেঁপে উঠতে থাকেন হিমেন্দ্র শেখর দত্ত। তিনি বলেন, সেদিন পাহাড়ের ভাঁজে দুজন পাকসেনাকে দেখতে পাই। আমরা গুলি করি। একজন সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। আরেকজনের মৃত্যু হয়েছে কিনা দেখতে গেলে সে আমার উপর গুলি চালায়। পরে তাকে গুলি করলে সে মারা যায়। সেখানে থেকে আহত অবস্থায় সঙ্গীরা আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। 

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হিমেন্দ্র শেখর দত্তকে বিদেশে পাঠিয়ে পায়ের অপারেশনের ব্যবস্থা করেন। আঘাত পাওয়া পা আজও পীড়া দেয়। জীবনের শেষ মুহূর্তে এই মুক্তিযোদ্ধার ইচ্ছা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করা। 
 

সাইফুল্লাহ হাসান/তারা 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়