ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বন্ধ হয়ে গেছে বগুড়ার  ২০০ কোয়েলের খামার

এনাম আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩০, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২  
বন্ধ হয়ে গেছে বগুড়ার  ২০০ কোয়েলের খামার

বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি কোয়েল পাখির খামার

বগুড়ায় কোয়েল পাখি লালন পালন করে আর্থিক মন্দাভাব কাটিয়ে সচ্ছল হয়েছিলেন প্রায় দুই শতাধিক পরিবার। কিন্তু অসাধু মহাজন আর করোনার প্রভাবে পাখিগ্রাম হিসেবে পরিচিত জেলা সদরের সাবগ্রাম ইউনিয়নের আকাশতারা গ্রামে এখন আর একটিও কোয়েলের খামার নেই। 

খামারিরা বলছেন করোনার কারণে তাদের এমন অবস্থা হয়েছে। মহাজনদের মধ্যে অনেকেই খামারিদের টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছেন আবার কারো কাছে টাকা আটকে গেছে। পাখির খামার বন্ধ হলেও এ বিষয়ে কোনো খোঁজ রাখেনি জেলা প্রাণী সম্পদ দপ্তর। এমনকি দুই বছরে খামারগুলো পরিদর্শনেও আসেননি প্রাণী সম্পদ দপ্তরের কোনো কর্মকর্তা।

জানা গেছে, ২০১১ সালে জেবুন্নাহার নামের এক নারী উদ্যোক্তা ৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে আকাঁশতারা মধ্যপাড়া গ্রামে প্রথম কোয়েল পাখি পালন শুরু করেন। তার সাবলম্বী হয়ে উঠা দেখে ওই গ্রামের অন্য নারীরাও কোয়েল পালন শুরু করেন। তারা কোয়েলের ১ দিনের বাচ্চা জেবুন্নাহারের কাছ থেকেই নিতেন। এরপর ২০ দিন পালন করার পর জেবুন্নাহারকেই আবার তা দিয়ে দিতেন। এভাবেই জেবুন্নাহার একজন সফল উদ্যোক্তা হন। কোয়েল পালন এবং ২০০ খামারিদের পরিচালনা করে ১০ বছরে একটি ৫ তলা বিল্ডিং এবং ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে কোয়েলের বাচ্চা ফুটানোর ইনকিউবেটর কিনেছেন। গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ির নারীরাও কোয়েল পালন করে তাদের অভাব মোচন করেছিলেন। তবে করোনার প্রভাব এবং অসাধু মহাজনদের কারণে গ্রামটির কোয়েল খামারিরা কর্মহীন হয়ে অভাবের মুখে পড়েছেন। নতুন করে খামার করার পরিকল্পনাও নেই তাদের।

এই গ্রামের খামারি মনোয়ারা বেগম জানান, তিনি বিধবা। কোয়েল পাখি পালনের আগে তার আর্থিক অবস্থা খারাপ ছিলো।  তিনি মহাজনের কাছে ১ দিনের বাচ্চা প্রতিপিস ৬ টাকা করে কিনতেন। এরপর ২০ দিন পালন করে মহাজনের কাছে বিক্রি করতেন প্রতিপিস ১৮ টাকায়। এতে করে তিনি আয় উন্নতি ভালোই করেছিলেন। কিন্তু এখন ব্যবসা নেই। অভাবে পড়েছেন তিনি।

অপর খামারি হামিদা বেগম বলেন, পাখি পালনের পর টাকা ঠিকঠাক পাবেন এমন নিশ্চয়তা পেলেই পুনরায়  তিনি কোয়েল পাখির খামার পুনরায় চালু করতে চান। কারণ মাত্র ২০-২২ দিন কেয়েল পালন করলে লাভবান হওয়া যায়।

আকাশতারা উত্তরপাড়া গ্রামের খামারী লাদু মোল্লা জানান, ৭-৮ বছর আগে তিনি জমি এগ্রিমেন্ট রেখে খামারে ৫ হাজার কোয়েল পাখির বাচ্চা পালন শুরু করেছিলেন। ৫ হাজার বাচ্চা থেকে প্রতি মাসে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা লাভ হতো। কিন্তু করোনার সময় মহাজনদের কাছে বাচ্চা দেওয়ার পর তারা আর প্রতি বারের মতো বাচ্চা বিক্রির টাকা দেয়নি। যে কারণে নতুন করে তিনি আর কোয়েল পাখি পালন করেননি। খামারটি বন্ধ রেখেছেন।

খামারী শহিদুল ইসলাম সোহাগ জানান, এই গ্রামটি পাখি গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলো। অসাধু মহাজন আর করোনার কারণে প্রায় সবগুলো খামার এখন বন্ধ। পুরো গ্রামে ৫টি খামারও খুঁজে পাওয়া যাবে না যারা পাখি উঠিয়েছে। এই গ্রামটিতে দুই শতাধিক কোয়েল পাখির খামার ছিলো। অথচ খামারগুলো বন্ধ হওয়ার প্রায় দুই বছরের মতো হলো। খামারগুলো কি কারণে বন্ধ হয়েছে সে সম্পর্কে জানতে এখন পর্যন্ত প্রাণী সম্পদ দপ্তর থেকে কেউ খবর নিতে আসেনি। 

আমজাদ হোসেন নামের আরেক খামারি জানান, ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় তিনি পুরো বাড়িকেই খামারে রুপান্তর করেছিলেন। কিন্তু পাখির বাচ্চা ফুটানো হ্যাচারি মালিকদের কারণে তিনি লোকসানের মুখে পড়েছেন। কারণ তিনি হ্যাচারি মালিক মজনু রহমানের (জেবুন্নাহারের স্বামী) কাছ থেকে ১ দিনের বাচ্চা নিয়ে পালন শুরু করেছিলেন। মাজলু অন্য কোনো ব্যবসায়ীকে গ্রামে প্রবেশ করতে দিতো না পাখি নেয়ার জন্য। তিনিই বাচ্চা বড় হলে খামারিদের কাছ থেকে নিতেন। আবার তিনিই গত ৩ বছর যাবৎ তারসহ আরো বেশ কিছু খামারির টাকা আটকে দিয়ে নিজে ৫ তলা বাড়ি করেছেন। তিনি আমাদের টাকা আটকে দিয়ে ঠিকই নিজের উন্নতি করছেন কিন্তু আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। টাকা চাইতে গেলে তিনি ব্যবসার লোকসানের কথা বলেন। 

নারী উদ্যোক্তা ও মহাজন জেবুন্নাহার জানান, কোয়েল পালন করেই তিনি ৫ তলা বাড়ি এবং হ্যাচারির মালিক হয়েছেন। তিনি তার বাড়িতে কোয়েল পালন করেন। আর তার স্বামী মজনু রহমান মাজলু বাইরে ব্যবসায়ী কার্যক্রম চালান। করোনার কারণে তাদের ১৫ লাখ টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। এরপরেও তিনি ব্যবসা থেকে সরে আসেননি। ২০ হাজার পাখি উঠিয়েছেন চলতি মাসে। 
তিনি আরো বলেন, ‘সরকার থেকে মুরগী এবং গরুর খামারিদের আর্থিক প্রনোদনা দেওয়া হলেও আমরা যারা কোয়েল পাখির খামরি রয়েছি তারা করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও আর্থিক সহায়তা বা ঋণের সুযোগ পাইনি। সরকার যদি আমাদের দিকে সুনজর দিতো তাহলে আমাদের ক্ষতিটা পুষিয়ে উঠতে পারতাম।’

হ্যাচারি মালিক মজনু রহমান কোনো খামারি তার কাছে টাকা পাবে না বলে দাবি করে বলেন, ‘আজিজ ও জুয়েল নামে আরো দুই মহাজন ছিলো। তাদের সঙ্গেও এই গ্রামের খামারিরা ব্যবসা করতো। খামারিদের অনেকের টাকা এই দু’জনের কাছে আটকে আছে। তারা ঢাকায় অবস্থান করছে। তবে যতটুকু জেনেছি তারা কিন্তু খামারিদের টাকা দেবে না এমনটা বলেননি। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরেই আসলে এমন হয়েছে।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘নতুন করে যদি কোন খামারি পাখি পালন করতে চান তাহলে আগে যেমন তাদের কাছে পাখি নিয়ে বিক্রির পর তাদের টাকা পরিশোধ করা হচ্ছিলো এখন তেমনটি হবে না। এখন পাখি যেদিন নেওয়া হবে সেদিনই তাদেরকে টাকা দিয়ে পাখি নেওয়া হবে।’

বগুড়া জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার জানান, ‘প্রাণী সম্পদ দপ্তর প্রতিনিয়ত খামার পরিদর্শন করে এবং খামারিদের পাশে থাকে। আমরা সব সময় তাদের পাশে আছি। তবে  দুশো-আড়াইশ’ খামার বন্ধ হয়ে গেছে বিষয়টি কিন্তু এরকম নয়। আসলে খামারিরা কি বলেছেন সেটা আমি জানি না।’

দু’বছর ধরে গ্রামটির ২০০ খামার বন্ধ হয়ে গেলেও প্রাণী সম্পদ দপ্তর থেকে কেউ খোঁজ নিতে যায়নি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘খামারের সংখ্যা অনুযায়ী আমাদের জনবল সংকট রয়েছে। যে কারণে একই খামারে বারবার যাওয়া সম্ভব হয় না। যার জন্য খামারিকেই এগিয়ে আসতে হবে। তখন প্রাণী সম্পদ দপ্তর সর্বোচ্চভাবে চেষ্টা করবে খামারিদের সহযোগিতা করার জন্য। কোনো খামারি যদি লোনের প্রয়োজন পরে আমরা তাকে লোন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারি। জেলায় মোট ৩১৭টি কোয়েলের খামার বর্তমানে আছে। এর মধ্যে বগুড়া সদরেই সবচেয়ে বেশি।’

বগুড়া/ মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়