বাড়তি ভাড়া গলায় ফাঁস রংপুর থেকে ঢাকাগামীদের
আমিরুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম
আপনজনদের সঙ্গে ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করেছে মানুষ। দেশের বিভিন্ন স্থানের মতো রংপুর থেকেও রাজধানীতে ফিরছে সবাই। তবে বাসের অতিরিক্ত ভাড়া কর্মজীবী মানুষের গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে রংপুর থেকে ঢাকাগামী বাস কাউন্টারগুলোয় দ্বিগুণ বা তিনগুণ ভাড়া দিয়েও টিকিট মিলছে না। বেশিরভাগ যাত্রীদের অভিযোগ, কাউন্টারের বাইরে থেকে কয়েকগুণ বেশি দামে টিকিট কিনতে হচ্ছে। সাতশ’ টাকার টিকিটের জন্য দিতে হচ্ছে পনেরশ’ থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে কাউন্টার মাস্টাররা বলছেন, আগে থেকেই সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। বাড়তি ভাড়ায় কোনো টিকিট বিক্রি হচ্ছে না।
শুক্রবার (৬ মে) সকাল ১০টার দিকে রংপুরের কামারপাড়া বাসস্ট্যান্ড ঘুরে দেখা গেছে, যাত্রীরা টিকিট না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ কাউন্টারের বাইরে পরিবহন সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে দ্বিগুণ বা আরও বেশি দামে টিকিট সংগ্রহের চেষ্টা করছেন।
ঢাকার একটি পেশাক কারখানায় কোয়ালিটি ইনচার্জ পদে কাজ করেন পীরগাছার মসিউর রহমান। টিকিটের জন্য বাসস্ট্যান্ডে ঘুরছিলেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘আজ সকাল সাড়ে সাতটা থেকে টিকিটের জন্য ঘুরছি। টিকিট পাচ্ছি না। আগামিকাল থেকে কারখানায় যোগ না দিতে পারলে পুরো ছুটির বেতন কেটে নেওয়া হবে। তাই চড়া দামে হলেও টিকিট পাওয়ার চেষ্টা করছি। অনেকেই সাইডে ঘুরে টিকিট সংগ্রহ করে চলে যাচ্ছে, কিন্তু আমরা পাচ্ছি না।’
ঢাকায় একটি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিতে চাকরি করেন মামুনুর রশিদ। চড়া দামে টিকিট কিনেছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘৮ তারিখ পর্যন্ত ঈদের ছুটি পেয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে ঈদ করতে এসেছিলাম। তবে ফিরতি টিকিট কিনতে পারিনি। গত তিনদিন থেকে চেষ্টা করছি। আজ সকালে দুটি টিকিট পেলাম, বাড়তি দাম দিয়েই কিনতে হলো।’
তবে কার কাছ থেকে এবং কীভাবে তিনি টিকিট সংগ্রহ করলেন সে বিষয়ে কিছু জানাতে চাইলেন না।
এদিকে কাউন্টারে বা বাইরে কোথাও বেশি দামে টিকিট বিক্রি হচ্ছে না বলে জানান কাউন্টারে থাকা টিকিট বিক্রেতারা।
এনা পরিবহনের টিকিট বিক্রেতা বাবু বলেন, ‘আগে থেকেই অনেকে কাউন্টারে এসে টিকিট কিনেছেন। অনেকে অনলাইন থেকে অগ্রিম টিকিট কিনেছেন। সেসব যাত্রীরা তাদের নির্ধারিত বাসের সময়ে কাউন্টারে আসছেন এবং গন্তব্যে চলে যাচ্ছেন। বাইরে থেকে বা কাউন্টারে চড়া দামে কোনো টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে না।’
কাউন্টারের বাইরে ডাকচিৎকার করে টিকিট বিক্রি করছিলেন জুয়েল নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবহনে আগে বুকিং করা দুটি টিকিট ক্যানসেল হয়েছে। আধা ঘণ্টা পরেই গাড়িটি চলে যাবে। তাই সিট ফাঁকা আছে বলে যাত্রী সংগ্রহের চেষ্টা করছি।’
তবে টিকিটের বাড়তি দাম নেওয়ার কথা অস্বীকার করেন এই টিকিট বিক্রেতা।
এদিকে কাউন্টার থেকে কাউন্টারে ঘুরেও টিকিট না পেয়ে উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার রংপুর নগরীর মর্ডান মোড়ে গিয়ে চলতি পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাসে উঠতে ভিড় করছেন কর্মস্থলে ফেরা অনেক যাত্রী। এই সুযোগে ঢাকা থেকে আসা বিভিন্ন কোম্পানির লোকাল বাসগুলো দর কষাকষি করছে যাত্রীদের সঙ্গে। তাদের বাসগুলো রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখার ফলে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। এতে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন স্থানীয়রা।
শুক্রবার (৬ মে) বেলা ১২টার দিকে রংপুর বিভাগের আট জেলার প্রবেশপথ নগরীর মর্ডান মোড় ঘুরে দেখা গেছে ঢাকাসহ দক্ষিণবঙ্গগামী সেলফি, আলিফ, সাগর, জেকে, রাইদা পরিবহনসহ বিভিন্ন কোম্পানির ব্যানারে দুই থেকে আড়াইশ’ পরিবহন ঢাকামুখি হয়ে রাস্তার পাশে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
এসব পরিবহনের সুপারভাইজার, হেলপারসহ অন্যান্যরা হাঁকডাক করে যাত্রী সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছেন। এদিকে দাঁড়িয়ে থাকা এসব পরিবহনের কারণে মর্ডান মোড়ের গুরুত্বপূর্ণ সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকায় একটি মেসে রান্না করেন নূর নাহার বেগম। টিকিটের আশায় বিভিন্ন বাসের কাউন্টার ঘুরে অবশেষে এসেছেন মর্ডান মোড়ে।
তিনি বলেন, ‘আমি ঢাকার একটি মেসে রান্না করি। আগামী কাল থেকে গার্মেন্টস খোলা। গার্মেন্টস কর্মীদের জন্য রান্না করার জন্য আমাকে আজকেই ফিরতে হবে। মর্ডান মোড়ে এসেছি কোনো লোকাল গাড়িতে করে ঢাকায় যাওয়ার আশায়। তবে কোনো গাড়ি আমাকে নিচ্ছে না। গাড়ির সুপারভাইজার বলে তাদের গাড়িতে সিট নেই। তাদের রিজার্ভ করা গাড়ি, গেলে ইঞ্জিন কভারে বসে যেতে হবে। আবার তারা ভাড়াও চায় বারোশ’ টাকা করে। তাই ব্যাগ মাথায় নিয়ে ঘুরছি। যদি কম ভাড়ায় কোনো গাড়িতে যেতে পারি!’
নূর নাহারের মতো কয়েকশ’ পোশাক শ্রমিক কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দরদাম করে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী ঢাকায় যাওয়ার চেষ্টা করছেন তারা।
এদের মধ্যে কথা হয় শামছুল, আইনুল, গোলজারসহ ঢাকাগামী কয়েকজনের সঙ্গে। তারা বলেন, ‘মর্ডান মোড়ে অনেক বাস। বাসগুলো সবই ঢাকা রুটের। এখানে রিজার্ভে এসেছে অনেকেই, আবার কোনো কোনো পরিবহন গাদাগাদি করে যাত্রী নেওয়ার উদ্দেশ্যে এখানে এসেছে। রিজার্ভ ছাড়া সেই বাসগুলোতেও ঢাকা যেতে দুই হাজার টাকা করে ভাড়া চাচ্ছে। এত ভাড়া দিয়ে কীভাবে ঢাকা যাব বুঝতে পারছি না। একদিকে বাড়তি ভাড়া, অন্যদিকে অফিস। খুবই সমস্যায় পড়েছি।’
রংপুর মডার্ন মোড় ছাড়াও ক্যাডেট কলেজের সামনে, দর্শনা মোড়, টার্মিনাল রোডসহ কয়েকটি সড়ক ঘুরে দেখা গেছে ঢাকা থেকে আসা বিআরটিসি দোতলা এবং একতলা বাস ছাড়াও অন্য কোম্পানির বাস সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মহাসড়কের একটি বড় অংশের ওপর বিআরটিসি বাসগুলো রাখার কারণে অন্য যানবাহনগুলোরও সড়কে চলাচলের ঝুঁকি বেড়েছে।
খেঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব বাস রিজার্ভ করে গার্মেন্টস শ্রমিকরা ঈদ করতে গ্রামের বাড়িতে এসেছেন। ঈদ শেষে এসব বাসেই ঢাকায় ফিরবেন তারা। ততদিন রাস্তার ওপরই থাকবে বাসগুলো।
বিআরটিসি বাসের স্টাফ আমজাদ বলেন, ‘আমাদের দোতলা বাসে ৬০ জন পোশাক শ্রমিক এসেছে। জনপ্রতি আড়াই হাজার টাকা করে আপডাউন ভাড়া ঠিক করেছি। ৭ তারিখে ঢাকা ফিরব। তাই বাসগুলো সড়কেই রাখা হয়েছে।’
রংপুর বিআরটিসি বাস ডিপোর ডিজিএম গোলাম ফারুক বলেন, ‘ঢাকা থেকে ২৬৫টি বিআরটিসি বাস রংপুরে এসেছে। এসব বাস ঢাকার বিভিন্ন রুটসহ দেশের বিভিন্ন সড়কে চলে। ঈদে শ্রমিকরা রিজার্ভে নিয়ে এসেছেন। ঈদের ছুটি শেষে ওই বাসেই শ্রমিকসহ যারা এসেছেন, তারা ফিরবেন। আমরা জেলা প্রশাসক, পুলিশ কমিশনারসহ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের কাছে নিরপত্তা চেয়েছি। তারা আমাদের শতভাগ নিরপত্তা দিয়েছেন। এ ছাড়াও আমাদের নিজস্ব সিকিউরিটিও রয়েছে।’
রংপুর মেট্রোপলিটন ট্রাফিক পুলিশের দক্ষিণ জোনের পরিদর্শক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘ঈদে অতিরিক্ত ভাড়া পেয়ে ঢাকা রুটের এই বাসগুলো রিজার্ভে এসেছে। বাসগুলো মূল সড়কের পাশে রাখা হয়েছে। এখনও কোনো সমস্যা হয়নি। ঈদের ছুটি শেষ হলে শ্রমিকরা এই বাসে করেই কর্মস্থলে ফিরবেন।’
জেলা মোটরমালিক সমিতি পক্ষ থেকে জানানো হয়, রংপুর বিভাগের আট জেলাসহ উত্তরাঞ্চলে সড়ক পথে ঈদে বাড়তি যাত্রীর চাপ থাকায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ঈদ মৌসুমে প্রতিদিন রংপুর বিভাগে আন্তঃজেলা সংযোগ সড়কসহ দুই শতাধিক সড়কে সোয়া লাখ যাত্রী যাতায়াত করে।
উল্লেখ্য, এবারের ঈদের ছুটিতে গত পাঁচ দিনে রংপুর জেলার বিভিন্ন সড়কে ছোট বড় ১৪টি সড়ক দুর্ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কাউনিয়ার বেইলি ব্রিজ, সদরের হাজিরহাটসহ পাঁচটি স্থানে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ছয় জন। আহত হয়েছেন অন্তত অর্ধশতাধিক।
ঈদ মানে আনন্দ। আর সেই আনন্দ পরিবারের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে দূরদুরান্ত থেকে মানুষ শিকড়ের টানে ছুটে যায়। এই টান অব্যাহত থাকুক, সড়ক হোক নিরাপদ। আনন্দ শেষে আনন্দ নিয়েই ফিরুক মানুষ কর্মস্থলে।
রংপুর/সনি
আরো পড়ুন