দুর্লভ ও সুস্বাদু আতপ চালের মুন্ডি
বান্দরবান প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
বান্দরবানের আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী খাবার মুন্ডির খ্যাতি দিন দিন বাড়ছে। অনেকটা নুডলসের মতো এই খাবার বিক্রির জন্য জেলা শহরে বেশ কয়েকটি স্থানে গড়ে উঠেছে ‘মুন্ডি হাউস’। এসব রেস্তোরাঁয় বিকেল থেকে রাত অবধি চলে জমজমাট বেচাকেনা। স্থানীয় আদিবাসী-বাঙালিদের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছেও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই খাবার।
বিকেল হলেই তরুণ-তরুণীরা দলে দলে মুন্ডি খাওয়ার জন্য বের হয়ে পড়েন। ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে শহরের উজানীপাড়া, মধ্যমপাড়া ও বালাঘাটা এলাকায় ৩৫টি মুন্ডি হাউস গড়ে উঠেছে। ঐতিহ্যবাহী এই খাবার তৈরি হয় চাল থেকে। তবে মিয়ানমার ও চীনের নুডলসের আগ্রাসনে স্থানীয়ভাবে তৈরি মুন্ডির কদর অনেকটাই কমে যাচ্ছে বলে মুন্ডি হাউসের মালিকরা জানান। দিন দিন বাইরের দেশের তৈরি শুকনা মুন্ডি বাজার দখল করায় স্থানীয় কারিগররা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
শহরের উজানীপাড়ায় কং রং মুন্ডি হাউসের উচি মং মারমা বলেন, তরুণ-তরুণী ও শিশু-কিশোররা বেশি মুন্ডি খাওয়ার জন্য আসে। এজন্য মুন্ডি হাউসগুলো এখন তরুণ-তরুণীদের আড্ডা ও বিনোদনের স্থানে পরিণত হয়েছে।
এদিকে একসময় শুধু বান্দরবানে বসবাসরত আদিবাসীরা এই খাবার খেয়ে আসলেও এখন স্থানীয় বাঙালিদের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা পর্যটকরাও এই খাবারের প্রতি আগ্রহ বাড়াচ্ছেন।
বান্দরবানে বেড়াতে আসা পর্যটক ইমতিয়াজ আহমেদ জানান, বান্দরবানের মুন্ডি অনেকটাই দারুণ। আমরা এখানে এসে আদিবাসীদের এই মুন্ডি খেয়ে অনেক মজা পেয়েছি।
টক-ঝাল স্বাদের মুন্ডি একটি ব্যতিক্রমধর্মী খাবার। একবার খেলে বার বার খেতে ইচ্ছে করে। এজন্য প্রতিদিন সন্ধ্যায় মুন্ডি দোকানে ভিড় বাড়তে থাকে। দিন দিন মুন্ডি দোকানে বিক্রি বাড়ায় দোকানিরা মুন্ডির পাশাপাশি কাবাব, লাকসো (ভর্তা), মুরগির স্যুপসহ নানা লোভনীয় খাবার তৈরি করছেন।
বান্দরবানের বিভিন্ন মুন্ডি হাউসগুলো ঘুরে দেখা যায়, বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত লোকজনের আনাগোনা থাকলেও সন্ধ্যায় ভিড় বেড়ে যায় বহুগুণ।
বান্দরবান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা মা টিং টিং মারমা জানান, মারমা জনগোষ্ঠী প্রাচীনকাল থেকে মুন্ডি তৈরি করছে। ঐতিহ্যবাহী এই ঘরের খাবার এখন বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করার ফলে অনেক অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে।
বান্দরবানের রাজবিলার জামছড়ি মুখ পাড়ার মুন্ডি প্রস্ততকারক চিং নু মং মার্মা জানান, প্রথমে আতপ চালকে দুই থেকে তিন দিন পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। পরে ভিজিয়ে রাখা চাল তুলে ছোট ছিদ্রযুক্ত চালুনির ওপর নিয়ে পরিষ্কার করে পানি শুকিয়ে নিতে হয়। এরপর ঢেঁকিতে চালগুলোকে চাপ প্রয়োগ করে মন্ড তৈরি করা হয়। পরে এই মন্ডকে আদিবাসীদের নিজস্ব হাতে তৈরি যন্ত্র দিয়ে চাপ প্রয়োগ করতে হয়। সর্বশেষে যন্ত্রের নিচে বের হয়ে আসে নুডলসের মতো চিকন লম্বা মুন্ডি।
প্রস্ততকারক চিং নু মং মার্মা আরো জানান, প্রতি এককেজি চালে দুইকেজি মুন্ডি তৈরি করা সম্ভব। বাজারে প্রতিকেজি মুন্ডির দাম ১০০-১১০ টাকা। বাজারে প্রতি বাটি বিক্রি হয় ২০-৩০ টাকা।
তিনি জানান, মুন্ডি পরিবেশনের সময় মাছের ঝোল বা স্যুপ দিলে আরো ভালো হয়। এ ছাড়া মাছ অথবা চিংড়ি শুঁটকি দেওয়া হয়। তবে কেউ নাপ্পি খেতে চাইলে সেই ব্যবস্থাও রাখেন বিক্রেতারা। খাওয়ার সময় সব উপকরণ দিয়ে মুন্ডিতে তেঁতুল অথবা লেবু মিশিয়ে খেতে অনেকটাই সুস্বাদু লাগে এই খাবার। মুন্ডির সাথে গোলমরিচ ও পাহাড়ি মরিচের গুঁড়া, পেঁয়াজভাজা, ধনেপাতা, চিংড়ি ও শুঁটকিসহ নানা মসলা পরিমাণমতো মেশাতে হয়।
শহরের মধ্যম পাড়ার বাসিন্দা কো কো মারমা জানান, সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা পেলে মুন্ডি বিক্রির পেশাকে অবলম্বন করে অনেকে স্বাবলম্বী হতে পারবেন। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় এই দুর্লভ ও সুস্বাদু খাবার পৌঁছাতে পারবে।
মিয়ানমার ও চীনের নুডলসের আগ্রাসনে দিন দিন অনেকটাই স্থানীয় হাতে তৈরি মুন্ডির খদর কমে যাচ্ছে। এর ফলে বেকার হয়ে পড়ছে বান্দরবানে কাঁচা মুন্ডি তৈরির কারিগররা। সরকারের সহযোগিতা ও সহজ ব্যাংক লোনের প্রদানের ভিত্তিতে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার অনুরোধ করেন অনেকে।
বাসু দাশ/এনএইচ
আরো পড়ুন