ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘আমার স্বামী কই? সে আমারে ফোন করে না কেন’

মাওলা সুজন, নোয়াখালী  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩৬, ২৩ আগস্ট ২০২২   আপডেট: ১২:৪২, ২৩ আগস্ট ২০২২
‘আমার স্বামী কই? সে আমারে ফোন করে না কেন’

স্বামীর জন্য কাঁদছেন জান্নাত বেগম। ছবি: রাইজিংবিডি

বঙ্গোপসাগরে বৈরি আবহাওয়ায় সাগরে প্রচণ্ড ঢেউয়ের কবলে পড়ে ট্রলার ডুবির ঘটনায় ১৪ দিন পেরিয়ে গেলেও নোয়াখালীর হাতিয়ার নিখোঁজ হওয়া ৫ জেলের এখনও কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

নিখোঁজ ওই পরিবারগুলোতে চলছে আহাজারি। জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় স্বজনদের ফিরে পেতে চান পরিবারের সদস্যরা। হাতিয়া উপজেলার হরনী ইউনিয়নের বয়ারচর গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, স্বামীর জন্য আহাজারী করে প্রায় বাকরুদ্ধ সিরাজ উদ্দিনের বাড়ির নিখোঁজ জেলে সোহেলের স্ত্রী জান্নাত বেগম।

তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী কই? তারে আপনারা আইনা দেন। সে আমারে ফোন করে না কেন? দুই মাইয়া লই এখন কই যামু? কে আঙ্গোরে (আমাদের) দেখবে? কোনাইতুন খানা আইবো (কোথায় থেকে খাওয়া আসবে)?’

জানা গেছে, গত ৯ আগস্ট বঙ্গপসাগরের গভীরে ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায় মাছ ধরার ট্রলার ‘এফবি নিশান’। এতে নিখোঁজ রয়েছেন হাতিয়া উপজেলার হরণী ইউনিয়নের ৫ জন জেলে।

নিখোঁজ জেলেদের অপেক্ষায় স্বজনরা

নিখোঁজ জেলেরা হচ্ছেন-হাতিয়া উপজেলার হরনী ইউনিয়নের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের বয়াচর গ্রামের মোশাররফ হোসেনের ছেলে ইয়াসিন আরাফাত (২৬), আব্বাস উদ্দিনের ছেলে আলকাস উদ্দিন (৩০), ইউনুস মাঝির ছেলে সোহেল উদ্দিন (২৫), নবীর উদ্দিনের ছেলে ইয়াকুব উদ্দিন (৩০) এবং হাতিয়া উপজেলার চানন্দী ইউনিয়নের শরীয়তর গ্রামের আমজাদ উদ্দিনের ছেলে আশরাফ উদ্দিন (৩৩)।

নিখোঁজ জেলে ইয়াছিন আরাফাতের মা তানজিনা বেগম বলেন, ‘ছেলে আমারে বলসে মা আমি ওই বোটে যামুনা। আমার ভয় লাগে। মালিক আমারে ধরে নিয়ে আসছে। আপনারা আমার ইয়াসিনকে আইনা দেন। আমার দুইটা ছোট ছোট নাতনি আর বউ নিয়ে এখন আমি কই যামু? তাদের ভরণ পোষণ কোথায় থেকে আসবে? আমার ছেলে বেঁচে আছে না মরে গেছে তাও জানি না।’

পাশের আরেক বাড়ির নিখোঁজ আলকাসের মা পাগলপ্রায়। তিনি আমার বাবারে আইনা দে বলে চিৎকার দিয়ে কান্না করেন এবং মূর্ছা যান। আলকাসের স্ত্রী জমিলা খাতুন বলেন, আমার স্বামী সাগরে গেছে। দুইটা অবুঝ বাচ্চা রেখে গেছে। আমাদের নিজের ভিটা পর্যন্ত নাই। অন্যের ঘরে বাড়া থাকি। এখন আমাদের কে দেখবে?

আরেক জেলে ইয়াকুব ফেরার অপেক্ষায় থাকা বৃদ্ধ বাবা-মার বিলাপ থামছে না কোন আশ্বাসেই। মিজানের ২ শিশু ছেলেও বাবার ফেরার অপেক্ষায়। জীবিত না হোক মৃত উদ্ধারে সরকারের সহায়তা চান স্বজনরা।

নিখোঁজ ইয়াছিনের পরিচয়পত্র

শুধু সোহেল, ইয়াছিন ও আলকাসের বাড়িতে নয়, একই অবস্থা নিখোঁজ অপর জেলেদের পরিবারেও। সময়ের সঙ্গে বাড়ছে স্বজন হারানোর শঙ্কা। প্রবল ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে সাগরে যাওয়ার সাধ্য নেই, তাই মেঘনার তীরেই নিখোঁজদের ফেরার অপেক্ষায় অনেক স্বজন।

উদ্ধার হওয়া ট্রলারটির মাঝি মো. শামীম উদ্দিন বলেন, গত ৯ আগস্ট তাদের এমবি নিশান নামের মাছ ধরার ট্রলারটি ঝড়ের কবলে পড়ে নিঝুমদ্বীপের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থেকে ভেসে গিয়ে পটুয়াখালী জেলা সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে ডুবে যায়। ঐ সময় পাশে থাকা একটি জেলে ট্রলাার তাদের চার জনকে জীবিত উদ্ধার করে পটুয়খালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার মহিপুরে নিয়ে যায়। আরও আট জেলেকে পরে জীবিত উদ্ধার করেছে স্থানীয় জেলেরা। এ নিয়ে ওই ট্রলারের উদ্ধার হওয়া জেলের সংখ্যা ১২ জন। এখনো পাঁচ জেলে নিখোঁজ রয়েছে।

স্থানীয় নবীনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বোরহান উদ্দিন বলেন, হাতিয়া নদীবেস্টিত এলাকা। এখানে নদীতে মাছ ধরে বেশিরভাগেরই সংসার চলে। কিন্তু এরা মারা গেলে লাশও পাওয়া যায় না ফলে কবর দেওয়া যায় না।

স্থানীয় ইউপির সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য নাজমা আরিফ বলেন, জেলেরা নদীতে মাছ ধরে নিজেরা স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি সরকারি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। তাই সরকারের উচিৎ এই অসহায় পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানো।

হরনী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আখতার হোসেন বলেন, ট্রলারডুবির ঘটনায় আমার হরণী ইউনিয়নের ৯ জন জেলে নিখোঁজ ছিল। ৪ জনকে পাওয়া গেলেও ৫ জনের সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি। পরিবারগুলো অসহায় হয়ে পড়েছে। সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদাউস ও সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী তাদের সহযোগিতা করেছেন।

নিখোঁজ জেলে, স্বজনদের আহাজারি

দুর্ঘটনার কবলে পড়া ট্রলাারের মালিক হাতিয়ার জাহাজমারা ইউপির আমতলী গ্রামের লুৎফুল্লআহিল মজিব নিশান বলেন, জেলেদের খুঁজতে খুঁজতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এতগুলো মানুষ নিখোঁজ আমার কেমন লাগে আমি বলে বুঝাতে পারবো না। আমি নিখোঁজ জেলেদের পাশে আছি।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন বলেন, নিখোঁজ জেলেদের যদি জেলে কার্ড থাকে তাহলে বিধি অনুযায়ী সরকারি অনুদান তারা পাবেন।

/সুজন/সাইফ/

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়