আমার রানার কি অপরাধ ছিল?
কালীগঞ্জ (গাজীপুর) প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
রানা হত্যার বিচারের দাবিতে আন্দোলন করেন গ্রামবাসী
‘আমার রানার কি অপরাধ ছিল? আমার ছেলে তাদের কি ক্ষতি করেছিল, আমার ছেলে কোনো অন্যায় করেনি। আমার ছেলেকে ওরা পিটাইয়া মাইরা ফালাইছে, ওরা আমার ছেলেকে বাঁচতে দিল না ক্যান? আমি খুনিদের বিচার চাই, আমার মতো আর যেন কোনো মায়ের বুক খালি না হয়’।
চুরির অপবাদ দিয়ে পিটিয়ে খুন করা রানার মা রেহেনা আক্তারের আর্তনাদ করে এ কথাই বারবার বলছিলেন। তার আহাজারিতে প্রকম্পিত হচ্ছিল গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা গ্রাম। স্বজন- প্রতিবেশীরা সন্তান হারা মাকে শান্তনা দিতে এসে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।
স্বজনদের দাবি রানাকে পরিকল্পিতভাবে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।
আরো পড়ুন: রাতভর নির্যাতন, হাসপাতালে নেওয়ার পথে মৃত্যু
নিহত যুবক রানা মিয়া (২২) উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের মুলাইদ গ্রামের মো. আমিনুল ইসলামের ছেলে।
এদিকে ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে নিহত রানার বাবা মো. আমিনুল ইসলাম শ্রীপুর থানায় বাদী হয়ে মামলা করেছেন।
মামলার আসামিরা হলেন- উপজেলার কেওয়া পশ্চিম খন্ড গ্রামের আব্দুল করিমের দুই ছেলে শিপন (২৭) ও আকাশ (২৫), একই গ্রামের মৃত খোকা মেকারের ছেলে উজ্জল (৪৫), সিরাজুল ইসলামের ছেলে শওকত (৩০), আবুল কাশেমের ছেলে ইমন (৩০), মৃত ওদর আলী বাইদ্যার ছেলে মোশারফ (৫০)। নাম না জানা আসামির সংখ্যা ৪/৫ জন।
নিহত রানার বাবা আমিনুল ইসলাম জানান, রানা মারা যাওয়া আগে অভিযুক্তদের নাম ও নির্যাতনের ভয়াবহ তথ্য জানিয়েছে। অভিযুক্তরা রানাকে শুক্রবার (২৩ সেপ্টেম্বর) রাত ১১টার দিকে বাড়ি থেকে ডেকে নেয়। পরে চুরির অপাবদ দিয়ে শিপনের ভাঙ্গারী দোকানের সামনের রাস্তায় ফেলে রাতভর তার ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালায়। তারা রানার মুখে কাগজ গুজে দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে একাধিকবার বৈদ্যুতিক শক দেয়। এছাড়াও পুরুষাঙ্গের ভেতর রড ঢুকিয়ে দেয়। সে চিৎকার শুরু করলে মুখে কাগজের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় হত্যাকারীরা। পরে ড্রিল মেশিন দিয়ে পা ছিদ্র করে ফেলে। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে বুকের পাজর, দুই হাত ও পা ভেঙ্গে দেয়।
আরো পড়ুন: নিহত যুবকের মরদেহ নিয়ে সড়কে মানববন্ধন
রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর) রাতে ময়নাতদন্ত শেষে রানার লাশ বাড়িতে আনা হলে বিক্ষোভে ফুসে উঠে গ্রামের মানুষ। তাৎক্ষণিক তারা বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন করেন। মানববন্ধন থেকে ঘাতকদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানানো হয়।
এলাকাবাসী অভিযোগ, ভাঙ্গারী ব্যবসার আড়ালে এলাকায় বড় একটি চোরের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন শিপন। তার এ সিন্ডিকেট আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় দিনে রাতে চুরি করে। প্রকাশ্যে রানাকে মারধর করা হলেও তাদের ভয়ে কেউ রানাকে উদ্ধার করতে সাহস পায়নি। গ্রামবাসীরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রানার খুনিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
রেহেনা আক্তার বলেন, শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) সকাল ৬টার দিকে রানাকে ঘরে পাওয়া যায়নি। এসময় খবর পান, তার ছেলেকে মারধর করছে। রানার বাবাকে আমি দ্রুত ঘটনাস্থলে যাই ছেলেকে উদ্ধার করতে। কিন্তু শিপনসহ অন্যরা আমাদের বাধা দেন। আমরা তাদের কাছে কাকুতি-মিনতি করি, হাত-পাও ধরি। তবুও শিপনের মন গলাতে পারিনি। বরং শিপনের ভাই আকাশ আমার চুলের মুঠি ধরে মারধর করে। আমার স্বামীকেও মারধর করে তারা। পরে তারা একাধিক সাদা কাগজে আমাদের টিপসই নেয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা রানাকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হলেও শিপনের লোকজন আমাদের হাসপাতালে যেতে বাধা দেয়। পরে স্থানীয় নেতাদের সহযোগিতায় রানাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হয়।’
রানার বাবা আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমি বারবার আকুতি মিনতি করলেও আমার ছেলেকে তারা ছাড়লো না, আমি তাদের পায়ে পর্যন্ত ধরেছি। তবুও তারা আমার কথা শুনলো না। সবশেষ আমার ছেলেকে মেরেই ফেললো। আমার ছেলেকে তুলে নিয়ে দফায় দফায় নির্যাতন করে বুকের পাজর, দুই হাত ও পা ভেঙে দেয়। আমার ছেলের শরীরের এক ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা নেই যেখানে আঘাত করেনি ওরা। আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে, আমি হত্যাকারীদের বিচার চাই।’
শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, ‘ঘাতকদের গ্রেপ্তারে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে। দ্রুতই আসামিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে।’
রফিক/ মাসুদ
আরো পড়ুন