ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

খুলনার ৪ উপজেলা নদী ভাঙনের কবলে, লবণ পানিতে প্লাবিত জনপদ

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান, খুলনা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫০, ১২ নভেম্বর ২০২২  
খুলনার ৪ উপজেলা নদী ভাঙনের কবলে, লবণ পানিতে প্লাবিত জনপদ

নদীতে বিলীন হচ্ছে বেড়িবাঁধ।

খুলনা উপকূলের চারটি উপজেলা নদী ভাঙনের কবলে পড়েছে। এসব এলাকার একের পর এক ভাঙছে বেড়িবাঁধ। ফলে লবন পানিতে প্লাবিত হচ্ছে গ্রামীণ জনপদ। ডুবছে ফসল, ভেসে যাচ্ছে মাছ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অধিবাসীরা।

সূত্র মতে, খুলনার উপকূলীয় উপজেলা কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটা সামান্য ঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাসে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বাঁধ ভেঙে বারবার নোনা পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। প্রায় প্রতি বছর কোথাও না কোথাও বাঁধ ভেঙে নোনা পানিতে ভেসে যাচ্ছে বসতবাড়ি ও সম্পদ। 

নাগরিক নেতারা বলছেন, নদী শাসন ছাড়া শুধু বাঁধ মেরামত করে ভাঙনের প্রতিকার মিলবে না  

এদিকে সম্প্রতি উপকূলে দেখা দিয়েছে ভিন্ন আতঙ্ক। ঝড়-বৃষ্টি ছাড়াই নির্মিত বাঁধ ভাটির টানে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। বেশ কয়েকটি স্থানে সবল বাঁধ এমনকি বড় বাজেটের টেকসই বাঁধও ভাটির টানে ধসে নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। তবে এসব বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গেল ১০ নভেম্বর কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের আংটিহারা গ্রামে শাকবাড়িয়া নদীতে ভাটির টানে ওয়াপদার বেড়িবাঁধ আকর্ষিক ভাঙনে প্রায় ২০০ মিটার নদী গর্ভে বিলীন হয়। ভোর রাতে ভাটির সময় বেড়িবাঁধে ভাঙন দেখে তাৎক্ষণিক স্থানীয়রা নিজেদের ঘরবাড়ি, সোনালী ফসল রক্ষা করতে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে রিং বাঁধের কাজ শুরু করেন। সহস্রাধিক মানুষ সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দিনভর কাজ করে রিংবাঁধ সম্পন্ন করেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড আনুষঙ্গিক জিনিস দিয়ে সহযোগীতা করে। তবে মূল বাঁধ নির্মাণ না করা পর্যন্ত যে কোনো মুহূর্তে জোয়ারের পানিতে সেখানকার বসতবাড়ি-সম্পদ ভেসে যাওয়ার চরম শঙ্কা বিরাজ করছে।

স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামতের চেষ্টায় স্থানীয় বাসিন্দারা।

দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম খান বলেন, ‘বাঁধটি ব্লক দিয়ে নির্মাণ করা ছিল। গত বছর বাঁধটিতে ফাঁটল দেখা দেয়। তিন মাস আগে জিও ব্যাগ ফেলে ফের সংস্কার করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে নদী শাসনের মাধ্যমে টেকসই না হওয়ায় বাঁধটি ধসে গেছে।’

এর আগে ৭ নভেম্বর ভোর ৫ টার দিকে দাকোপের খরোস্রোতা ঝপঝপিয়া ও পশুর নদীর ভাটার সময় পাউবো’র ৩১ নম্বর পোল্ডারের পানখালী ফেরিঘাটের পূর্ব পাশে দিকে প্রায় ১০০ মিটার বাঁধ নদী গর্ভে বিলীন হয়।

 গত ২৪ অক্টোবর ভোরে কয়রা উপজেলার সদর ইউনিয়নের হরিণখোলা এলাকায় কপোতাক্ষ নদে প্রায় ৫০ মিটার বাঁধ ধসে যায়। ধসে যাওয়া বাঁধ এক বছর পূর্বে প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়। বছর না ঘুরতেই ধসে যাওয়ায় কাজের মান নিয়ে জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছি। 

কয়রা সদর ইউপি সদস্য আবুল কালাম শেখ বলেন, ‘গেল বছর কপোতাক্ষ নদ থেকে বালি উত্তোলন করে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। নদীর ঢেউ লেগে বাঁধের তলার মাটি সরে যাওয়ায় বালির বাঁধ ধসে গেছে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘বাঁধটি পরিকল্পিতভাবে না করায় টেকসই হয়নি। নদী শাসনের মাধ্যমে ড্যাম্পিং ও ব্লক ব্যবহার করলে বাঁধ নষ্ট হতো না।’

পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্র জানায়, হরিণখোলা এলাকায় জাইকার অর্থায়নে ঠিকাদারের মাধ্যমে ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর ৬০ মিটার ক্লোজার ও ১ হাজার ৬৪০ মিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণকাজ শুরু করে। পাউবো’র অর্থায়নে ওমরর্স ট্রেডিং এ্যান্ড কনস্ট্রাকশন নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ওই বাঁধ নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন। নির্মাণ কাজ সম্পন্নের পর ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বরে হস্তান্তর করে তারা।
অপরদিকে, খুলনার দাকোপ উপকূলের দুটি বাঁধ (৩২ ও ৩৩ নম্বর পোল্ডার) পুনঃনির্মাণ হয়। অথচ কাজ শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যেই আগস্ট মাসে ৩২ নম্বর পোল্ডারের একাধিক জায়গার বাঁধ ধসে যায়। ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে আরও ৫টি এলাকা। সর্বশেষ গত ১৫ সেপ্টেম্বর বাজুয়া ইউনিয়নের চুনকুড়ি খেয়াঘাটের পাশে ১০০ মিটার বাঁধ (৩৩ নম্বর পোল্ডার) নদীতে ধসে যায়। ২০১৭ সালে শুরু হওয়া এই কাজ শেষ হয় গত ৩০ জুন। খুলনার অংশে প্রকল্প ব্যয় হয় ৩৫০ কোটি টাকা।

গত ১৭ জুলাই ভোরে কয়রার দক্ষিণ বেদকাশীর চরামুখা কপোতাক্ষ নদের বাঁধের প্রায় ৩০০ মিটারের মতো ধসে যায়। 

পাউবো সূত্রে জানা যায়, ১৪/১ নম্বর পোল্ডারে ওই এলাকার বাঁধ মেরামতে ৩ কোটি ১২ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়। কাজটিতে অর্থায়ন করে জাপান আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা (জাইকা)। দরপত্রের মাধ্যমে ‘অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরা’ নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ওই কাজটির দায়িত্ব পায়।

কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, ‘নদী শাসন ছাড়া শুধু বাঁধ নির্মাণ করায় টেকসই হচ্ছে না। কয়েক বছরের মধ্যে বাঁধ আবারও নদীতে চলে যাচ্ছে। আগে নদী শাসন জরুরী।’

কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সম্প্রতি কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীর তলদেশ থেকে বেশ কয়েকটি স্থানে চরের মাটি ভেঙে নদী গর্ভে চলে গেছে। যে কোনো মুহূর্তেই সেসব এলাকার বাঁধ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। নিচের দিকে পানির চাপ বেশি পড়ায় মাটি সরে যাচ্ছে। নদী শাসন ছাড়া বাঁধের ধস ঠেকানো যাবে না।’

খুলনার কয়রা, সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর আওতায়। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহনেওয়াজ তালুকদার বলেন, ‘বাঁধের নিচের মাটি সরে যাওয়ায় ধস নামছে। এটা যে কোনো স্থানেই হতে পারে। বাঁধের পাশ্ববর্তী নদী বেশি গভীর হলে এবং পানি কম থাকলে বাঁধ ধসে যেতে পারে। এজন্য সমস্যা চিহ্নিত করে নদী শাসন করতে হবে।’ 

মাসুদ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়