ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

চলন বিলে চলছে অবাধে শামুক নিধন, জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের আশঙ্কা

অদিত্য রাসেল, সিরাজগঞ্জ  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:০৯, ২৪ ডিসেম্বর ২০২২   আপডেট: ১৬:১২, ২৪ ডিসেম্বর ২০২২
চলন বিলে চলছে অবাধে শামুক নিধন, জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের আশঙ্কা

উত্তরবঙ্গের শস্য ভান্ডার খ্যাত সিরাজগঞ্জের চলনবিলে বর্ষার পানি কমে যাওয়ায় বিল ও ফসলের জমি থেকে জাল দিয়ে শামুক সংগ্রহ করছেন কৃষক ও জেলেরা। এ শামুক নৌকায় করে বিভিন্ন বাজারে আনা হচ্ছে। সেখান থেকে শিকারিদের কাছ থেকে শামুক কিনে  বিভিন্ন হাঁসের খামার ও মাছের পুকুরের মালিকদের কাছে বিক্রি করছেন পাইকাররা। 

অবাধে বিলের শামুক নিধনের ফলে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস ও ফসলহানির শঙ্কা করছে স্থানীয় কৃষি বিভাগ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার তাড়াশ উপজেলার চলনবিল থেকে এখনো বর্ষার পানি পুরোপুরি নেমে যায়নি। এ কারণে বিলের আশপাশে বসবাসকারী মানুষজন মাছ ধরার পাশাপাশি বাড়তি আয়ের জন্য জাল দিয়ে অবাধে ছোট-বড় শামুক তুলে আনছেন বিল থেকে। পরে সেই শামুক উপজেলার মাগুরা বিনোদ ইউনিয়নের দীঘি সগুনা বাজার, হামকুড়িয়া বাজার, মান্নাননগর চৌরাস্তায় পাইকারদের কাছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি করছেন। পরে এই শামুক পাইকাররা হাঁস ও মাছের খাদ্য হিসেবে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায় খামারিদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন। এভাবে প্রতিদিন শামুক নিধনের ফলে পরিবেশ বিপন্ন হওয়ার পাশাপাশি হুমকিতে পড়েছে বিল অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য। 

স্থানীয় বাসিন্দা আলতাব শেখ, জুলমাত হোসেন, সাগর শেখ জানান, খেটে খাওয়া মানুষরা বাড়তি উপার্জনের আশায় প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছোট-বড় নৌকা নিয়ে বিলের বিভিন্ন অংশে ঘুরে বেড়ান। তারা ডুবে থাকা ফসলি জমি থেকে মই জাল, হেসি জাল ও হাত জাল দিয়ে শামুক সংগ্রহ করছেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বিলের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০টি নৌকায় করে শামুক আসছে উপজেলার বিভিন্ন সড়কে। সেখান থেকে পাইকাররা শামুকের বস্তা ভ্যান ও পিকআপে করে নিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে এই এলাকা শামুকের হাটে পরিণত হয়েছে।

উপজেলার বিলনাদো গ্রামের শামুক শিকারি আব্দুর রহমান বলেন, ‘বর্ষায় বিল অঞ্চলে মানুষের কাজকর্ম থাকে না। তাই মই জাল ও হেসি জাল দিয়ে আমরা শামুক সংগ্রহ করি। পানি কম থাকায় শামুক ধরে পাইকারদের কাছে প্রতি বস্তা ১১৫ টাকা থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি করি।’

শামুক ব্যবসায়ী রিন্টু হোসেন ও মিলন শেখ বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমে চলনবিল ও ফসলের জমিতে ছোট, বড় ও মাঝারি সাইজের প্রচুর শামুক পাওয়া যায়। বিল ও ফসলের জমি থেকে পুরোপুরি পানি কমেনি। এ কারণে বিলপাড়ের মানুষেরা বিভিন্ন আকারের শামুক সংগ্রহ করেন। এসব শামুক আমরা কিনে হাঁস ও মাছের খামারিদের কাছে বিক্রি করি। উপজেলার বিভিন্ন বাজার থেকে প্রতিদিন প্রায়
৩০০ বস্তা শামুক বিক্রি হয়। এখান থেকে গাড়িতে করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খামারিরা শামুক নিয়ে যান।’

উপজেলার হামকুড়িয়া গ্রামের হাঁসের খামারি আব্দুল জলিল বলেন, ‘প্রতি বছর বিল থেকে হাঁসের খাবারের জন্য শামুক কিনে আনা হয়। শামুক হাঁসের জন্য খুবই পুষ্টিকর খাদ্য।’

চলনবিল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব মিজানুর রহমান বলেন, ‘বিলের প্রতিটি জলজ উদ্ভিদ ও প্রতিটি প্রাণী একে অন্যের পরিপূরক। একটি প্রাণী বা উদ্ভিদের ঘাটতি হলে অপর একাধিক উদ্ভিদ বা প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এটাই স্বাভাবিক। বর্তমানে এ বিলে শামুক বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে। কিছু টাকার জন্য মানুষ প্রকৃতির ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এতে চলনবিল আরও বিপর্যস্ত হতে
পারে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃতির সৃষ্টি  চলনবিলকে রক্ষা করতে হবে। এর খাল-বিল-জল রক্ষা করতে হবে। সেই সঙ্গে চলনবিলের প্রতিটি প্রাণী ও উদ্ভিদকে রক্ষা করতে হবে।’ 

তাড়াশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লুৎফুলন্নাহার লুনা জানান, ‘পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে বেশির ভাগ শামুক মারা যায়। মৃত শামুক মাটিতে মিশে কৃষি জমির উর্বরতা বৃদ্ধিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। কিন্তু শামুক নিধন প্রতিরোধে কৃষি বিভাগের তেমন কোনো দিক নির্দেশনা নেই। তারপরও পরিবেশের কোনো ক্ষতি না হয়, সে দিক থেকে বিষয়টি দেখা হবে।’

তাড়াশ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মশগুল আজাদ বলেন, ‘শামুক পানিকে ফিল্টার করে। এগুলো বড় মাছেরও খাদ্য। জলের মধ্যে শামুকের যেমন প্রয়োজন আছে, তেমনি অতিরিক্ত হলে সেগুলো নিধন করাও যেতে পারে। তবে চলনবিলে কত শামুক স্টক
রয়েছে, তা জরিপ করে সেভাবেই আহরণ করা দরকার।’

সিরাজগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুল গফুর বলেন, ‘শামুক নিধন প্রতিরোধে আমাদের তেমন কোনো দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি। তবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় আমরা কাজ করে যাবো। এমনিতেই শামুক নিধন বেশি মাত্রায় হওয়ায় হুমকিতে পড়েছে বিল অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য। যার প্রভাব পড়বে পরিবেশের ওপর। আমরা মানুষকে সচেতন করতে লিফলেট বিতরণ, উঠান বৈঠক, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ও মাইকিং করে শামুক নিধন বন্ধে কাজ করছি। আগামী দিনে যেন কেউ এই শামুক নিধন না করে ও শামুক ধরা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ হাতে নিয়েছি।’ 

মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়