ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

লিটনের ‘সেলুন লাইব্রেরি’ 

অলোক সাহা  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫৭, ১ জানুয়ারি ২০২৩   আপডেট: ১৭:১৮, ১ জানুয়ারি ২০২৩
লিটনের ‘সেলুন লাইব্রেরি’ 

নদীবেষ্টিত ৯টি গ্রাম নিয়ে গঠিত ঝালকাঠি সদর উপজেলার ৭ নাম্বার পোনাবালিয়া ইউনিয়ন। পোনাবালিয়া বাজারে ‘নগর বাউল হেয়ার কাটিং’ সেলুন আশপাশের দু’দশ গ্রামে সুপরিচিত। বলাবাহুল্য বাজারে সেলুন রয়েছে আরো। কিন্তু লিটন চন্দ্র শীলের নগর বাউল হেয়ার কাটিং নামে নয়, কাজেও ব্যতিক্রম। এর কারণ এটি একটি মিনি পাঠাগারও বটে!

লিটনের সেলুনে গেলে দেখা যাবে থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বই। সৌন্দর্য বাড়াতে নয়, সামাজিক জ্ঞানার্জনে সহায়তা করতেই এ প্রচেষ্টা। লিটন সেলুনে গড়ে তুলেছেন সমৃদ্ধ পাঠাগার। কষ্টার্জিত অর্থ তিনি ব্যয় করেন বই সংগ্রহে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্রের কালজয়ী গল্প, উপন্যাসসহ লিটনের সেলুনে রয়েছে দেশবরেণ্য লেখকদের বই। 

লিটন গায়ক জেমস-এর ভক্ত হওয়ায় দোকানের নাম দিয়েছেন ‘নগর বাউল হেয়ার কাটিং’। এ কারণে এলাকায় তিনি ‘নগর বাউল লিটন’। তবে বইপ্রেমী হিসেবেও তার আলাদা পরিচিতি আছে। সেলুনে পাঠাগার করার পাশাপাশি লিটন সেলুনের দেয়ালে কবি, লেখক ও মনীষীদের বাণী লিখে রেখেছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু, মাদার তেরেসা, স্বামী বিবেকানন্দ, ফকির সাধক লালন সাঁই, কাজী নজরুল ইসলামসহ অনেকের ছবি টাঙিয়েছেন দেয়ালে। যে কারণে সেলুনে প্রবেশের পর গ্রাহক অন্য এক জগতের সন্ধান পান। বিস্মিত হন এই তরুণের সৃজনী উদ্যোগে।  

এলাকাবাসী লিটনের সেলুনকে ‘সেলুন লাইব্রেরি’ নামে ডাকেন। সেলুনে চুল কাটাতে আসা চল্লিশোর্ধ্ব আব্দুল ওহাব হিরু বলেন, ‘শহর থেকে গ্রামে আসি চুল কাটাতে। এর কারণ এটা  মিনি লাইব্রেরি। বই পড়া ছাড়াও এখানে আলাদা একটা স্বাদ পাই। দীর্ঘক্ষণ থাকলেও ধৈর্য্য হারাতে হয় না। বাচ্চাদের খেলার সামগ্রীও আছে সেলুনে।’

সেলুনের নিয়মিত পাঠক মো. সালাউদ্দিন মল্লিক। তিনি বলেন, ‘পড়াশোনা বেশি দূর না করলেও লিটন ব্যতিক্রমী মানুষ, জ্ঞানী লোকের মতো তার মেধা। সেলুন দিয়ে এলাকায় তিনি জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছেন। সনাতন ধর্মের হলেও তিনি ইসলামিক বইও রাখেন। আমাদের সন্তানদেরও এই সেলুনে পাঠাই। যাতে ওদের মেধার বিকাশ ঘটে।’ 

লিটনের সেলুনে আসা কুলকাঠি শহীদিয়া ইউনিয়ন একাডেমির নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী মো. মাইনুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা স্কুল শিক্ষার্থীরা অনেকেই বই কিনে পড়তে পারি না। লিটন দাদার সেলুনে এসে বই পড়ি। এই ইউনিয়নে পাবলিক লাইব্রেরি নেই। এ কারণে আমার বন্ধুরাও এখানে এসে বই পড়ে। আমরা মাঝেমধ্যে বই বাসায়ও নিয়ে যাই।’

উচ্চ শিক্ষিত না হলেও লিটনের শিক্ষার চেতনা অন্য অনেকের তুলনায় বেশি। লিটনের এই ভূমিকা প্রশংসনীয় উল্লেখ করে বিজিবি সদস্য মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমি ছুটিতে বাড়ি এলে এখান থেকে বই নিয়ে পড়ি। তবে এখানে আরো বই প্রয়োজন। অনেকের ঘরে সেলফে বই পরে আছে, কিন্তু পড়া হয় না। তারা যদি কিছু বই এখানে দিয়ে যান তাহলে বইগুলো কেউ না কেউ পড়তো।’

পাশাপাশি সরকারী সংস্থা থেকেও কিছু বই এখানে দিলে এলাকাবাসী উপকৃত হতো বলে মনে করেন এই বিজিবি সদস্য। 

লিটন চন্দ্র শীল বলেন, ‘ভার্চুয়াল দুনিয়ায় বইয়ের পাঠক কমে গেছে। তাই মানুষের বই পড়ার অভ্যাস ধরে রাখতে আমার এই উদ্যোগ।’

বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী ও একটি কন্যা সন্তান নিয়ে লিটনের সংসার জগৎ। সেলুনের আয় থেকে সামান্য টাকা বাচিয়ে বই সংগ্রহ করার চেষ্টা করেন তিনি। সেলুনে লাইব্রেরি গড়ার স্বপ্ন মনে এলো কীভাবে? লিটন বলেন, ‘মানুষ সেলুনে বসে পেপার পড়ে। আমি ভেবে দেখলাম বই রাখলে বইও পড়তে পারে। সেই ভাবনা থেকেই একটু একটু করে এই লাইব্রেরি করার চেষ্টা করছি। বলতে পারেন আত্মতৃপ্তি থেকেই কাজটি শুরু করেছিলাম। এখন সবাই প্রশংসা করছে। বর্তমান প্রজন্ম একটু হলেও বই পড়ায় উৎসাহ পাচ্ছে এতেই আমার তৃপ্তি।’

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়