সিরাজগঞ্জে আন্দোলনের সেই অস্ত্রধারীরা কোথায়?
অদিত্য রাসেল, সিরাজগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন চলাকালে রংপুরে প্রকাশ্যে পুলিশের গুলিতে নিহত হন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। সেই ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। প্রকাশ্য গুলিতে আবু সাঈদ প্রাণ হারানোর পরে দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ ফুঁসে ওঠেন।
সারাদেশের মতোও সিরাজগঞ্জেও ছাত্র আন্দোলন বিস্তৃত হয়ে পড়ে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে শহর থেকে উপজেলা এমনকি গ্রামীণ জনপদেও।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমন করতে প্রশাসনকে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার। সেই নির্দেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবকলীগসহ তাদের নেতাকর্মীরা মাঠ দখলে রাজপথে নামে। চলমান আন্দোলনের সময় গত (৪ আগস্ট) দুপুর থেকে সিরাজগঞ্জে পুলিশের পাশাপাশি আন্দোলনকারীদের দমনে রাজপথে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নিয়ে মাঠে নামে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ ক্ষমতাসীনদের বিভিন্ন সংগঠনের ক্যাডাররা।
জানা যায়, আন্দোলন ঠেকাতে সিরাজগঞ্জের এসএস রোড, মুজিব সড়ক, ইবিরোডসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় আগ্নেয়াস্ত্র হাতে জড়ো হন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের শত শত ক্যাডার। সেদিন অত্যাধুনিক সব ধরনের অস্ত্রের মহড়া দেখা গেছে। নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর গুলিসহ মারপিটও করে ক্ষমতাশীন দলের ক্যাডাররা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে জেলার বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে অস্ত্রের ঝনঝনানি। সেই সঙ্গে ক্যাডাররা বন্দুক, রিভলবার, পিস্তলসহ অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও রাম দা, হকিস্টিক, রডসহ বিভিন্ন ধরনের ধারালো দেশীয় অস্ত্র হাতে হামলা চালায় ছাত্র-জনতার ওপর।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেওয়া বেশকয়েকজন জানিয়েছেন, ওইদিন অস্ত্রধারীদের লক্ষ্য ছিল বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঠেকানো। এতে মানুষ মারা গেলেও তারা ড্যাম কেয়ার ছিল। সেদিন পুলিশের একটি অংশের ভূমিকাও ছিল মারমুখি। দলীয় ক্যাডাররা অস্ত্র হাতে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা ও গুলি চালানোর সময় যেন সহযোগীর ভূমিকা পালন করেন দায়িত্বরত কর্মকর্তারা।
একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী অভিযোগ করে বলেন, গত (৪ আগস্ট) দুপুরের পর থেকে আন্দোলনকারীদের ওপর কোনো কারণ ছাড়াই চড়াও হয় পুলিশ। শুরু হয় বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ। এতে শহরের রেলগেট, মুজিব সড়ক ও ইবি রোড এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এক পর্যায়ে ছাত্র-জনতা পিছু হটে, আহত হয় বহু মানুষ। কিছু সময়ের পরে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীসহ সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা এসকল স্থানে দখল নেয়। এ সময় মজিব সড়কে দেখা যায় সশস্ত্র মহড়া।
অনেকে বলছেন, আন্দোলনের দিন যে অস্ত্রের মহড়া হয়েছিল, যা সিরাজগঞ্জের মানুষ অতীতে এমনটা ঘটনা দেখেননি। আর কখনো রাজপথে প্রকাশ্যে অত্যাধুনিক অস্ত্র হাতে কাউকে মহড়া দিতে দেখা যায়নি। কখনো এমন ভয়ংকর অস্ত্র নিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কেউ রাজপথে নামেনি।
ওইদিনের অস্ত্রধারীদের নিয়ে প্রতিনিয়তই চলছে আলোচনা ও সমালোচনা। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের লক্ষ করে বার বার বিদেশি শটগান দিয়ে গুলি করছিল আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। ছবিতে দেখা যায় স্থানীয় সংসদ সদস্য জান্নাত আরা হেনরীর ভাতিজা ও যুবলীগ নেতা এনামুল হক, পাশেই আরেক যুবলীগ নেতা এম এ মুছা ও করিম মুন্সি গুলি ছুঁড়ছেন শটগান দিয়ে। ছাত্রলীগ নেতা কর্মীদের হাতেও ছিল ছুরি, রামদা, রড, ফালা ও লাঠিসহ নানান দেশীয় অস্ত্র।
সেদিন গুলিতে নিহত হয় যুবদলের তিন জন। প্রকাশ্যে দিবালোকে এ সকল অবৈধ অস্ত্র প্রদর্শনী হলেও ৩৮ দিন পার হলেও এসব অস্ত্র উদ্ধারে প্রশাসনের নেই কোনো তৎপরতা। ইতোমধ্যে হত্যার ঘটনায় জেলায় পাঁচটি মামলায় আসামি করা হয়েছে প্রায় ১০ হাজার জনকে।
সেদিন আওয়ামী লীগ নেতাদের ব্যবহৃত সেই অন্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। সেই সাথে এনায়েতপুর ও হাটিকুমরুল হাইওয়ে থানা থেকে ২৮টি অস্ত্র খোয়া যায়। এরমধ্যে ১৭টি উদ্ধার করা গেলেও ১১টি এখনও উদ্ধার হয়নি। খোয়া যাওয়া অস্ত্রগুলো উদ্ধার না হওয়ায় চরম আতঙ্কে রয়েছে সাধারণ মানুষসহ পুলিশ সদস্যরা। এত অস্ত্র বাইরে রেখে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও রয়েছে চরম আতঙ্কে।
এদিকে, গত (৪ সেপ্টেম্বর) থেকে অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ায় জনমনে কিছুটা স্বস্তি ফিরতে শুরু করেছে। সিরাজগঞ্জবাসীর প্রত্যাশা, যৌথ বাহিনী সশস্ত্র সন্ত্রাসী ক্যাডার, তাদের সহযোগী ও গডফাদারদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসবে।
নিহত জেলা যুবদলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সোহানুর রহমান রঞ্জুর স্ত্রী মৌসুমী খাতুন বলেন, ‘যারা আমার স্বামীকে গুলি করে মেরেছে, পুলিশ তাদেরকে এখনো ধরতে পারেনি। সেই অপরাধীরা এখনো বাইরে আছে অবৈধ অস্ত্রগুলো তাদের কাছে আছে। আমি মামলা করেছি আসামিদের বিরুদ্ধে। মামলা করার পর থেকে আমি ও আমার দুই বছরের একটা বাচ্চা নিয়ে চরম আতঙ্কের মধ্যে আছি। রাষ্ট্রের জন্য কাজ করতে গিয়ে আমার স্বামী শহীদ হয়েছে। তাই রাষ্ট্রের কাছে আমার একটাই অনুরোধ আমার স্বামীকে যারা হত্যা করছে তাদের যেন দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়।’
অপর নিহত যুবদল কর্মী আব্দুল লতিফের বোন মোছা. সালেহা বেগম বলেন, ‘আমার ভাইয়ের কোনো দোষ ছিল না। আমার ছোট ভাইকে গুলি করে হত্যা করে তারা সবাই গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে। তাদের কাছে অবৈধ অস্ত্র এখনো রয়েছে। তারা যে কোনো সময় আমাদের উপর হামলা করতে পারে। ফলে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে অনেকেই এখন আতাংকের মধ্যে রয়েছে।’
সফিকুল ইসলাম, নীরব, শাকিল, মনিরুলসহ বেশকয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অনেকেই অবৈধ অস্ত্র দিয়ে শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালিয়েছে। তারা সিরাজগঞ্জে তিন জনকে হত্যা করেছেন। এছাড়াও কয়েকটি থানার অস্ত্র লুট করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত সেই সকল অস্ত্রগুলো উদ্ধার করা হয়নি এবং থানায় জমা দেয়নি। এই অস্ত্রগুলো এখনো বিভিন্ন মহল বা দুষ্ককৃতিদের হাতে রয়েছে।
প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী ক্যাডার বাহিনীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর গুলি চালিয়েছে এমন অভিযোগ করে সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপি যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হারুন-উর-রশিদ খান হাসান বলেন, ‘আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের গুলিতে যুবদলের তিন কর্মী নিহত হয়েছে। সেই সঙ্গে অনেকেই আহত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। সেই অবৈধ অস্ত্রধারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও অস্ত্রগুলো যদি উদ্ধার না হয় তাহলে আমরা নিরাপদ বোধ করছি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আন্দোলনের সময় জেলার কয়েকটি থানা থেকে পুলিশের অস্ত্র লুট হয়েছে সেই অস্ত্রগুলো এখনো উদ্ধার হয়নি। যারা শিক্ষার্থীদেরকে গুলি করেছে যুবদলের নেতা কর্মীদের হত্যা করেছে তাদেকে দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা। যদি তাদেরকে দ্রুত গ্রেপ্তার করা না হয়, তা হলে শুধু রাজনৈতিক নেতারাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে না পুরো সিরাজগঞ্জবাসী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে।’
সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) মো. শামছুল আলম জানান, দুইটি থানা থেকে মোট ২৮টি অস্ত্র আন্দোলনের সময় খোয়া যায়। ইতোমধ্যে ১৭টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি ১১টি উদ্ধারের জন্য অভিযান চলছে। আশা করি দ্রুত এ সকল অস্ত্র উদ্ধার করতে স্বক্ষম হব। আন্দোলনের সময় যারা অবৈধ অস্ত্র নিয়ে মহড়ায় গিয়েছে ও গুলি করেছে, সেসব অস্ত্রধারী অপরাধীদের ধরতে অভিযান চলছে।
সিরাজগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) লিটুস লরেন্স চিরান বলেন, ‘যৌথ বাহিনীর অভিযানে অস্ত্রধারীদের ধরা হলে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা হবে। অবৈধ অস্ত্র ও মাদক উদ্ধারেও অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
(এডিএম) লিটুস লরেন্স চিরান আরও বলেন, ‘‘২০০৯ সালের ৪ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের (৫ আগস্ট) পর্যন্ত জেলা প্রশাসন ব্যক্তি মালিকানা আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স ইস্যু করে ১৬০টি। এসব লাইসেন্সের বিপরীতে ১২১টি কেনা হয়। বাকি ৩৯টি অস্ত্রের লাইন্সেস থাকলেও তারা এখন পর্যন্ত অস্ত্র ক্রয় করেনি। কিন্তু এখন পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন থানায় জমা পড়েছে ১১৭টি অস্ত্র।
‘ইস্যু করা অস্ত্রের মধ্যে পিস্তল ১১টি, একনলা বন্দুক ১৪টি, দুইনলা বন্দুক ২৮টি, বন্দুক একটি, রাইফেল ১৩টি, রিভলবার সাতটি ও শটগান ছিল ৪৭টি। বাকি ৪টি অস্ত্র জমা হয়নি। তাদের মধ্যে ২টি অস্ত্র গত (৮ সেপ্টেম্বর) সকালে সদর উপজেলার বাগবাটি ইউনিয়নের বেজগাতী এলাকার একটি নির্মাণাধীন মসজিদের সিঁড়ির নিচ থেকে এবং জেলার শাহজাদপুর উপজেলার পৌর এলাকার পাড়কোলা গুচ্ছগ্রামের তিনটি বাড়িতে এ অভিযান চালিয়ে ১৯ রাউন্ড গুলিসহ তিনটি ওয়ান শুটার গান উদ্ধার করা হয়েছে। এই তিনটি অস্ত্রে লাইন্সেস না থাকায় অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা হয়েছে।”
//সনি