ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

“মার্ক টালি বলছি...! ”

|| রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:২৮, ১৮ নভেম্বর ২০১২   আপডেট: ০৮:৪৫, ১১ আগস্ট ২০২০
“মার্ক টালি বলছি...! ”

রাইজিংবিডি২৪.কম:

“সত্যিই অবিশ্বাস্য! চমৎকার লাগছে! বাংলাদেশের মানুষ আমাকে এই বিরল সম্মানে ভূষিত করেছে। আমি আমার সাধ্যমত শিশু বাংলাদেশকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। এই সম্মাননা আমাকে আমার অতীতের সেই দিনগুলির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে! এক কথায় বলতে গেলে অনেক উত্তেজনাকর মুহূর্ত ছিল সেই দিনগুলো।”

গাড়িতে বসে কথাগুলো বলতে বলতে গলার স্বরটা কিছুটা নরম হয়ে আসে মার্ক টালির।
‘বাংলাদেশ স্বাধীনতাযুদ্ধ সম্মাননা’ পাওয়ার পর তার ব্যক্তিগত অনুভূতি এভাবেই প্রকাশ করেন মার্ক টালি।

‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্মাননা’ নিতে গত ১৮ অক্টোবর ঢাকায় আসেন স্যার উইলিয়াম মার্ক টালি। ঢাকায় অবস্থানকালে তার সাথে আলোচনা হয় অতীত, বর্তমান ও পরিবর্তনশীল আগামীর বাংলাদেশ নিয়ে।

একাত্তরের বিবিসি বলতে তৎকালীন সবাই ‘মার্ক টালিকেই জানত। সেই সময়ে তিনি ছিলেন বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আশার আলো। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হারিকেন বা কুপির মিটি মিটি আলো জ্বালিয়ে রেডিওর এরিয়াল তুলে শর্টওয়েভ স্টেশনের নব ঘুরিয়ে স্থির হয়ে সকাল-সন্ধ্যা বিবিসিতে কী বলছেন মার্ক টালি, তা শোনার জন্য উৎকণ্ঠিত থাকত পুরো বাংলাদেশ। তিনি যখন কথা বলতেন পিনপতন নীরবতা অবলম্বন করে চুপ হয়ে থাকতেন পরিবারের সকল সদস্য। কি বলছেন মার্ক টালি? মুক্তিযোদ্ধারা নাকি একে একে নাজেহাল করে চলেছেন পাকবাহিনীকে। পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দিয়েছে, যুদ্ধজাহাজ নাকি ডুবিয়ে দিয়েছে, টিক্কা খান আর ইয়াহিয়ার গদিতে নাকি আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে... এরকম আরও অনেক নিত্যদিনের প্রাণবন্ত খবরের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে হাজির হতেন মার্ক টালি। আজকের দিনে সচেতন ষাট-ঊর্ধ্ব বাঙ্গালিদের কাছে মার্ক টালি সমানভাবে তাই জনপ্রিয়।   

মার্ক টালি’র জন্ম ১৯৩৫ সালের ২৫ অক্টোবর, ধনাঢ্য ইংরেজ পরিবারে হলেও  জন্মস্থান কিন্তু কলকাতায়। মার্ক টালি’র কেন এই বাংলাদেশের প্রতি নাড়ির বাঁধন অনেকেই হয়ত  জানেন না? “মার্ক টালি’র মা ছিলেন বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলার মেয়ে। বাবা ব্রিটিশ রাজত্বে ব্যবসার সুবাদে কলকাতা থেকে বাংলাদেশে পাট কিনতে আসতেন। বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক স্থায়িত্ব বেড়ে যায় তার মা’ বাঙালি বলে। একটার পর একটা চমকপ্রদ ঘটনা বলে চলছিলেন আর হাসছিলেন মার্ক টালি।             

১৯৭১-এ মার্ক টালির বয়স মাত্র ৩৫ বছর। জীবনের দশটি বছর বাঙালি পরিবেষ্টিত আঙিনায় কাটলেও তিনি ফিরে যান ইংল্যান্ডে। পড়াশোনা করেন মার্লবরো ও ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে। পাদরি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ভর্তি হলেন লিঙ্কন থিওলোজিক্যাল কলেজে, কিছুদূর এগোলেনও। তারপর বুঝতে পারলেন এই পাদরিজীবন তো তার নয়! তার চাই গতিময় ও অনুসন্ধিৎসু জীবন। চাই চ্যালেঞ্জ! ১৯৬৪-তে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে বিবিসি রেডিওতে যোগ দিলেন। ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৬৫-তে চলে এলেন দিল্লিতে। তখন থেকেই শুরু হলো তার পূর্ব পাকিস্তান পর্যবেক্ষণ।  
mark-tally-bg
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিবিসি টিমে যারা কাজ করতেন তাদের অগ্রনায়কের আসনে ছিলেন মার্ক টালি। প্রতিমুহূর্তে বাঙালিদের চাঙ্গা করতে নিয়ে আসতেন তাৎক্ষণিক অনেক খবরা খবর।

পাকিস্তানিরা বাঙালিদের উপর হামলা চালানোর আগে হিসাবে ভুল করেছিল। তাই মার্ক টালি বলেন, “একাত্তরে বাঙালিদের ওপর আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিশাল ভুল করেছিল। আমার মনে আছে, সায়মন (সায়মন ড্রিং) যখন ঢাকা ছেড়ে যান তখন ঢাকায় আর কোনো বিদেশি সাংবাদিক ছিল না। আমি রাজশাহী গিয়েছিলাম এবং দেখেছিলাম সব গ্রাম আগুনে ভস্মীভূত। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পুরো দেশকে ধ্বংস করার নীতি গ্রহণ করেছিল। পুরোদেশ যেন ভূতের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। খুব কাছ থেকে দেখছিলাম মানুষের সেই নিদারুণ কষ্ট। দগদগে ক্ষতগুলো!”

এক একটা লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনার আড়ালে নোট নিতে নিতে মাঝে মাঝে খেই হারিয়ে ফেলছিলাম। রূপসীবাংলা হোটেলে তার রুমে বসে নোট লেখা বন্ধ করে চুপচাপ শুনছিলাম এক একটা ঘটনার মায়াজালের পিছনের কাহিনী।

যুদ্ধের সময়টাতে তিনি বিবিসি’র প্রতিনিধি হয়ে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে সফরে যান। টালি’ দেখতে চেয়েছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানিরা কি বাংলাদেশের এই সব ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে জানে কি না। পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা যে বাংলাদেশের উপর নির্মম অত্যাচার চালাচ্ছে তার খবর সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাত না।  
টালি তখন বলেন, “পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আমি যখন যাই তখন আমাকে বলা হয়, বিবিসিকে এক পক্ষের সংবাদ দেওয়া হয়েছে এবং অর্ধেক খবর সম্প্রচার করা হচ্ছে।”
১ জুলাই ১৯৭১ সালে মার্ক টালি ঢাকায় ছিলেন। মার্ক টালি তখন ওয়ার্ল্ড নিউজের মধ্যমণি। মার্ক টালি সেই সময়কার কথা তুলে ধরেন, “ঢাকা এবং ঢাকার আশপাশে বিভিন্ন এলাকায় ব্যবসায়ী, সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলার পর আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সর্বশেষ রাজনৈতিক কর্মসূচি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আরও হতাশাব্যঞ্জক হয়ে উঠছে...পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ ও সেনাবাহিনীকে উৎসাহ দেওয়ার জন্যই তার ভাষণটি তৈরি করা হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি তার প্রশংসাকে ভীষণ সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। ইসলাম নিয়ে তার জোরালো বক্তব্য সময়োচিত হয়নি। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, যুক্তিসংগত কারণে বাঙালিরা সেনাবাহিনীকে মোটেও বিশ্বাস করছে না। এরই মধ্যে সেনাবাহিনী ঢাকা থেকে ৫০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে আটটি গ্রাম ধ্বংস করে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করল, প্রতিহিংসায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কৌশল থেকে তারা এখনো সরে আসেনি। এমনকি যুদ্ধকালীন বস্তুনিষ্ট খবরের ঘোর বিরোধিতা করে পাকিস্তানিরা। বিবিসি-কে “ভারত ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন” ও “ব্রিটিশ বাকওয়াজ কর্পোরেশন” নামে অভিহিত করতে থাকে। ”
যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন , “যুদ্ধাপরাধের যে তথ্য-উপাত্ত আছে বাংলাদেশ চাইলে তা দেওয়া হবে।”
“এক সময় মনে হয়েছিল বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশর পুনর্গঠন করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। আজ মনে হয়, বাংলাদেশ কিছু করে দেখিয়েছে। গত ৪১ বছরে বাংলাদেশে যে উন্নয়ন হয়েছে তা প্রশংসনীয়। ছেলেদের সাথে সাথে মেয়েরাও অনেক এগিয়ে গেছে। গিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশকে। শুনেছি অনেক উন্নতিও করেছে। এটা অনেক পজিটিভ ব্যাপার কেননা ৭১’এর মুক্তিযুদ্ধে মেয়েদের ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ।”
মার্ক টালি তার প্রয়াত বন্ধু ও বিবিসির সাংবাদিক আতাউস সামাদকে ভীষণ পছন্দ করতেন। অনেকবার তার কথা তুলে আনেন আলাপচারিতায়।
“বঙ্গবন্ধু দেশে আসার পর অবকাঠামোর জন্য অর্থ সংগ্রহ, সংবিধান প্রণয়ন, পুলিশ ও সেনাবাহিনী গড়ে তোলাসহ অনেক সমস্যার সমাধান করতে হয়েছিল। কিন্তু এখন দেখে বোঝা যাচ্ছে যে বাংলাদেশ তার লক্ষ্যমাত্রার অনেকাংশ অর্জনে সমর্থ হয়েছে।”

বাংলাদেশের ফ্লাইওভার সম্পর্কে তার তিনি বলেন, “ এটা খুবই ভাল যে যানজট নিরসনের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তবে আমার মনে হচ্ছে, যথাযথ পরিকল্পনা এখনও মনে হয় বাংলাদেশ নিতে পারছে না। ফ্লাইওভারের নিচেই বেশই যানজট। এখানকার যানজট একটু তীব্র লাগছে।”

সমকালীন বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, “ শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া ও মিঃ এরশাদ – তিনজনের আমলেই ঢাকায় সফর করেছি আমি। সবাই উন্নয়ন চান কিন্তু আমার মনে হয় বিক্ষিপ্ত না হয়ে একত্রিতভাবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিৎ।‘’

‘’আজ থেকে ২০ /২৫ বছর পর কোন বাংলাদেশ দেখতে চান তার একটা পরিকল্পনা এখনই রাখা উচিৎ। অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ব্যাপার রাজনীতির সাথে জড়ানো উচিৎ নয় হয়ত! এটা ভাল হতে পারে। ”

৪২ বছর ধরে একটানা দিল্লিতেই কাটাচ্ছেন মার্ক টালি। পেয়েছেন ভারতীয় নাগরিকত্ব। তিনি ৭৭ বছরে পা দিলেন গত ২৫ অক্টোবরে।২ ছেলে ও ২ মেয়ে নিয়ে মার্ক টালি ও স্ত্রী গিলিয়ান টালির পরিবার। মিসেস টালিকে মার্ক টালি অনেক ভালবাসেন যা অনেকবারই বলেন। বড় ছেলে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে (যুক্তরাজ্য) কর্মরত এবং ছোট ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় আছেন মার্কেটিং একজিকিউটিভ হিসেবে।বড় মেয়ের জামাই যুক্তরাজ্যের একটা এয়ার লাইন্স কোম্পানি আছে।

মানসিক ও শারীরিকভাবে মার্ক টালি শক্ত থাকলেও বার্ধক্যজনিত কারণে নিয়মিত অনেক ওষুধ খেতে হয়। আমার নিজের দেখা, তিনি ঘুমাতে যাওয়ার আগে কয়েক ঘণ্টা বই, খবরকাগজ পড়েন।  বর্তমানে তিনি ভারতে “রেডিও বিবিসি -৪” এর ধারা ভাষ্যকার হিসেবে কর্মরত আছেন। এই বয়সেও অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। সাম্প্রতিক সময়ে পড়ছেন এক ইরানি লেখকের ভ্রমণ কাহিনী।

এই পর্যন্ত বিভিন্ন দুর্লভ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন টালি।এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ
  “অর্ডার অফ দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার (ওবিই)” ১৯৮৫ ও “ পদ্মশ্রী” সম্মাননা ১৯৯২ সালে। ২০০২ সালে নিউ ইয়ারে “নাইট” ও ২০০৫ সালে “পদ্মভূষণ” এ ভূষিত হন।      
 
তার লেখা উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলঃ “নন ফুলস্টপ ইন ইনডিয়া” সর্বজন পাঠক সমাদৃত। “রাজ টু রাজিভঃ ফোরটি ইয়ার্স অব ইনডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স” , “হার্ট অফ ইনডিয়া (১৯৯৫)” ।     

“স্যার উইলিয়াম মার্ক টালি” একটি নাম, একটি অনুরণ, একটি আশার সঞ্চার। যার কণ্ঠ শোনার জন্য ৭১’এ ছিল অগণিত “মুক্তিকামী মানুষের” অধীর অপেক্ষা আর “শুভধ্বনি”। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুকে বাংলাদেশের

নাগরিকত্ব দেয়া হোক । বাঙালির মননে মার্ক টালি সজীব থাকুন চিরকাল।

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়