ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

উচ্চ শিক্ষায় ছাত্র রাজনীতির সুফল-কুফল

জুবায়ের আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২০ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
উচ্চ শিক্ষায় ছাত্র রাজনীতির সুফল-কুফল

রাজনীতি দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য হলেও এখন ক্ষমতার প্রদর্শনী ও ভোগ বিলাসের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। আর ছাত্র রাজনীতি পরিণত হয়েছে মানুষ মারার রাজনীতিতে, যার মাধ্যমে অকালেই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে বহু প্রাণের, বহু স্বপ্নের।

সর্বশেষ ক্ষমতাশীন দলের ছাত্র নেতাদের দ্বারা বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর আবারো প্রশ্ন উঠেছে দলভিত্তিক ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজন আছে কি না। সদ্য কলেজে পা রাখা ছাত্রটি দৈহিক গঠনে বেড়ে উঠলেও শিশুসুলভ আচরণ তার মধ্যে বিদ্যমান থাকা ছাড়াও রাজনীতি কেমন হবে, এসব বুঝার আগেই ছাত্র-ছাত্রীরা ক্ষমতার দাপট কীভাবে দেখাতে হয় সেটা শিখেছেন। আবার ক্ষমতা কীভাবে কাজে লাগাতে হয় তাদের সেই পাঠও শেষের দিকে।

বড় ভাইদের মাধ্যমে রাজনীতি করতে আগ্রহী ছাত্র-ছাত্রীরা লেখাপড়ার চেয়েও বেশি মনযোগী হয়ে পড়ে ক্ষমতার দাপটের দিকে। কলেজেই শুধু নয়, স্কুলভিত্তিক সংগঠনও রয়েছে এখন দেশে, যেখানে সরাসরি রাজনীতি না হলেও রাজনীতির কলা কৌশল, ক্ষমতার দাপট ঠিকই দেখা যায় ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে।

একটি ছাত্রকে নিয়ে পরিবারের অনেক স্বপ্ন থাকে। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী পরিবারগুলোর সন্তানেরা রাজকীয় ভাবেই পড়ালেখা করে। কিন্তু দরিদ্র পরিবারের মেধাবী ছাত্রদের কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির মাধ্যমে একটি স্বপ্নের ডালপালা মেলতে থাকে। লেখাপড়া শেষ করে পিতা-মাতার মুখ উজ্জ্বল করাসহ দরিদ্র পরিবারটির হাল ধরার স্বপ্ন থাকে ছাত্রটির মনে। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির বিষাক্ত ছোবলে অকারণে বহু মেধাবীর প্রাণ ঝড়ে যাওয়াসহ বহু মেধাবী ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়।

রাজনীতি কোনো পেশা নয়, একজন শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে রাজনীতিবিদ হওয়ার জন্য ছাত্রজীবনেই রাজনীতিতে পা রাখে।  তাকে নিজ যোগ্যতায় ব্যবসা কিংবা চাকরির মাধ্যমেই জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। আর রাজনীতিতে প্রবেশ করলেও রাজনীতি থেকে অর্থ আসবে এমন কোনো নিয়ম নেই। যারা রাজনীতি করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান, তারাই শুধু বেতনসহ আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন। কাজেই আদর্শিক রাজনীতি যেখানে অর্থের যোগান দেয় না, সেখানে দীর্ঘ সাত থেকে আট বছর ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত থাকা কোনো অর্থবহ বিষয় নয়।

একজন ছাত্রের মনে দেশ ও জাতির কল্যাণে রাজনীতিবিদ হওয়ার ইচ্ছা থাকলে, সে তার লেখাপড়া সম্পন্ন করেও রাজনীতিতে যুক্ত হতে পারেন। একজন ভালো রাজনীতিবিদ হওয়ার জন্য একজন ভালো মানুষ হওয়া দরকার, ভালো বক্তা হওয়া দরকার, যার জন্য দীর্ঘ সাত থেকে আট বছর রাজনীতির প্রয়োজন হয় না।

রাজনীতির প্রয়োজনীয় বা অনেক ইতিবাচক দিক রয়েছে। তবে, রাজনীতির শিকার হয়ে যেভাবে মেধাবী ছাত্ররা হত‌্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন, সেখানে নেতিবাচক দিকই বেশি। একটি প্রাণের মূল্যের কাছে ছাত্র রাজনীতির হাজারটা সুফল ও প্রয়োজনীয়তাও মূল্যহীন হয়ে যায়।

ছাত্র রাজনীতির ফলে লেখাপড়ার ব্যাঘাত ঘটছে সারা বছর জুড়ে। শুধু হত্যাকাণ্ডই নয়, ক্ষমতায় থাকা ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের অমানবিক ও আইন বিরোধী টর্চার সেলের মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে সাধারণ ও বিরুদ্ধ মতের ছাত্র-ছাত্রীরা।আর এগুলো দিন দিন বর্বরতায় রূপ নিচ্ছে। পাশাপাশি ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের হাতে ক্ষমতা না থাকলেও রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য তারাও হিংস্র কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে, হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাও সংঘটিত হয় প্রায় সময়।

একজন শিক্ষার্থী কলেজ-ভার্সিটিতে পা রেখেই ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িয়ে আদর্শিক রাজনীতির চেয়ে ক্ষমতার রাজনীতিতেই বেশি মনযোগী হয়। ছাত্র রাজনীতি এখন ক্ষমতা ও ভোগের রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে।ফলে বলি হচ্ছে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা। কাজেই ছাত্র রাজনীতির কতটুকু প্রয়োজন, তা নিয়ে ভাববার সময় এসেছে। কেউ বিচার পাচ্ছেন, আবার কেউ বিভিন্ন অজুহাতে পার পেয়ে যাচ্ছেন। এভাবে চললে সারা বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লেখাপড়ার চেয়ে বেশি অরাজকতার পরিবেশ তৈরি হয়ে থাকবে, যেখানে শিক্ষার চেয়ে হাহাকার থাকবে বেশি। সময় এসেছে কঠোরভাবে এসব দমন করার, গোড়াতে হাত দেয়ার কোনো বিকল্প নেই।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ছাত্র রাজনীতি ছিলো সকলের ঐক্যমতের ভিত্তিতে দেশের জন্য, ভাষার জন্য। ১৯৭১ পরবর্তী ৯০ এর স্বৈরাচার সরকার পতনের আন্দোলনেও ছাত্র সংগঠনগুলোর ঐক্যবদ্ধতার নজির পাওয়া গেছে। কিন্তু এরপরের চিত্রই ভিন্ন। ঐক্যবদ্ধতা বিনষ্ট হয়ে পরবর্তীতে ছাত্র রাজনীতি পরিণত হয়েছে নিজ নিজ দলের স্বার্থভিত্তিক। যেখানে ছাত্রলীগ, ছাত্র দল, ছাত্র শিবির, বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে বিরোধের রাজনীতি, যার সুফলের পরিবর্তে কুফলই দৃশ্যমান বেশি।

দেশ ও জাতির স্বার্থে রাজনীতির অবশ্যই প্রয়োজন আছে, ভালো ও মেধাবী ছাত্ররাই আগামীর রাজনীতির হাল ধরবে। তাই ছাত্র থাকাবস্থায় শিক্ষার সর্বোচ্চ প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে এইচএসসি থেকে অনার্স/ডিগ্রি পর্যন্ত ছাত্ররাজনীতি বাতিল করা সময়ের দাবি। স্বপ্ন পূরণের জন্য যখন একজন ছাত্র মাস্টার্সে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হবে, তখন তার মধ্যে বয়সে ও শিক্ষায় পরিণত বোধ তৈরী হবে।যেখানে ক্ষমতার রাজনীতি ও ভোগের রাজনীতি করার চেয়ে দেশ ও জাতির জন্য রাজনীতি করার স্পৃহা তৈরি হবে। আর সেই রাজনীতি দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর হবে বলে মনে করি।

লেখক: শিক্ষার্থী, ডিপ্লোমা ইন জার্নালিজম, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম অ্যান্ড ইলেকট্রনিক মিডিয়া (বিজেম)।

 

বিজেম/জুবায়ের আহমেদ/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়