ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

পাহাড় ঝরনা সমুদ্র পেরিয়ে

সাইফুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩৭, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পাহাড় ঝরনা সমুদ্র পেরিয়ে

মাসের পর মাস ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট করতে করতে নিজের প্রতি বিরুক্তি এসে পড়েছিল। তাই প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে পাহাড়, সমুদ্র, ঝরনার নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে গিয়েছিলাম সাজেক, বান্দরবান, সেন্টমার্টিন ও কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে। একা যাইনি, আমার প্রিয় শিক্ষাঙ্গন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের বন্ধুদের সঙ্গে গিয়েছিলাম।

প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও শিক্ষাসফরের আয়োজন করেছিল আমাদের বিভাগ। একাডেমিক জীবনের বাইরে প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে দেখতে সবাই গিয়েছিলাম পাহাড়ের সবুজ অরণ্যে মাঝে মেঘের কোলে ভাসতে ও সমুদ্রের নীল জলরাশির ঢেউকে আপন করে নিতে।

যাত্রা শুরুর আগে অদেখাকে দেখার, অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার আনন্দে সবাইকে বেশ প্রাণবন্ত লাগছিল। সব পিছুটান ঝেড়ে ফেলে সবাই যেন হয়ে উঠেছিল ভ্রমণপিপাসু।

গেল ৮ ফেব্রুয়ারি গোধূলিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে ৪ জন শিক্ষক ও প্রায় ৭৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে দুটি বাসে যাত্রা শুরু হয় আমাদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গেই বাসের মধ্যে শুরু হয় নাচ গানের আসর। আমাদের বাসে শ্রদ্ধেয় সামছুল আরেফিন স্যার ও তামান্না রশিদ ম্যামসহ সবাই যেন অবাচনিক ভঙ্গিতেই বোঝালেন বাসের মধ্যে আমাদের নাচ গান আর উল্লাসে সমস্যা হচ্ছে না, বরং সবাই উপভোগ করছেন। এভাবে চলতে চলতেই নেমে এলো রাতের অন্ধকার। এ সময় নতুন কোনো নগর, বাঁশঝাড়, জোনাকি পোকা,  ধু ধু প্রান্তর পেরিয়ে চলতে থাকে আমাদের শিক্ষাসফরের দুটি বাস। 

কালার সাথে পিরিত কইরা, লোকাল বাস, খাইরুন সুন্দরী,  বোরকা পরা মেয়ে কোনো ধরনের গানই যেন বাদ পড়লো না। হৈ-হুল্লোড়, মজা-মাস্তি করতে করতে সবাই যেন ক্লান্ত। এর মধ্যেই সবাই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। ঘুমকাতুরে  চোখ খুলতেই চোখে পড়ে কুয়াশার দখলে থাকা আঁকাবাঁকা বন্ধুর পাহাড়ি সড়কে ঢেউয়ের তালে গাড়ি চলছে। সকাল সাড়ে ৭টায় আমরা পৌঁছে যাই খাগড়াছড়ি দীঘিনালায়। সেখানে নেমে সবাই ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা শেষ করে সাজেক ভ্যালির উদ্দেশ্যে চাঁন্দের গাড়িতে উঠে বসি।

যাওয়ার পথে আমরা কয়েকজন চালকের অনুমতি না নিয়েই উঠে পড়ি চাঁন্দের গাড়ির ছাঁদে। গাড়ির ছাঁদে শোঁ শোঁ বাতাস আর কনকনে শীত, পাহাড়ের আঁকাবাঁকা সড়কের ভয়কে জয় করতে বেসুরা কণ্ঠে গান ধরি। দীর্ঘ ৪ ঘণ্টা যাত্রা পথে আদিবাসী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জীবন বৈচিত্র্য, বাসস্থান দেখে আদিম যুগের মানুষের  কথা মনে পড়ে গেল। পথিমধ্যে আদিবাসীদের ছোট ছোট বাচ্চাগুলো যেন তাদের রাজ্যে আমাদের স্বাগত জানিয়ে হাত নেড়ে অভিবাদন জানাচ্ছিল। এরই মধ্যে উঁচু পাহাড় পেরিয়ে চাঁন্দের গাড়ি এসে পৌঁছায় সাজেক রিসোর্টের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে আমরা প্রবেশ করি সাজেক গেস্ট হাউজ কটেজে। কটেজে বিশ্রাম শেষে দুপুরের খাবার শেষে বিকেল সাড়ে ৩টায় চাঁন্দের গাড়িতে ভ্রমণ পিপাসুদের শেষ ঠিকানা কংলাক পাহাড়ের উদ্দেশ্য যাত্রা।

সামছুল আরেফিন স্যারের নেতৃত্বে  কংলাকে উঠার সময় সবাই মিলে স্যারের নামে স্লোগান ধরে উঠতে থাকি, এ যেন হিমালয় পর্বত জয়ের আনন্দ। কংলাকে উঠে চারদিকে তাকিয়ে সাজেক তথা বাংলার অপরূপ বৈচিত্র্য দেখে বিস্মিত হই। এ দিকে কংলাকে সবাই মোবাইল ও ক্যামেরায় ছবি ও সেলফি তুলে ব্যস্ত সময় পার করছিল। তখন পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্তমিত হওয়ার পালা। পশ্চিমাকাশে দিন শেষে সূর্যের বিদায়লগ্নে এক অপরূপ রঙ ধারণ করে। সন্ধ্যা নামার দৃশ্য দেখে আমরা কটেজে ফিরে আসি।

পরদির ভোর সাড়ে ৫টায় হেলিপ্যাডের উদ্দেশ্যে বের হই সূর্যোদয় দেখতে। সেখানে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে মেঘদল যেন হাতছানি দিচ্ছিল। মেঘের আড়ালেই ঝলমলিয়ে আলো ছড়িয়ে সূর্যি মামা বেরিয়ে এলো। এরপর সকাল ৮টায় কটেজে ফিরে সকালের নাস্তা খেয়ে আমরা রুইলুই ছেড়ে দীঘিনালার উদ্দেশ্যে যাত্রা করি।

দুপুরে আমরা পৌঁছে যাই দীঘিনালায় সেখানে দুপুরে খাবার শেষে আমরা রওনা হই আলুটিলা গুহার উদ্দেশ্যে। বিকেল ৪টায় আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রের মূল গেটের সামনে থামে আমাদের বাস। মূল গেট পার হতেই পাশে দুটি শতবর্ষী বটবৃক্ষ। শান্ত নিবিড় ছায়াবীথি। মাথা উঁচু করে আকাশটা ছুঁয়ে আছে। পাহাড়ি ঢালু রাস্তা বেয়ে নিচে নামতেই চোখে পড়লো একটি বিশ্রামাগার ও ওয়াচ টাওয়ার। ওয়াচ টাওয়ার থেকে খাগড়াছড়ি শহরের বেশ কিছুটা অংশ দেখা যায়। এখান থেকে অবলোকন করা যায়, আকাশ-পাহাড় আর মেঘের মিতালীর মায়াবী এক আবহ। সত্যিই এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়, হৃদয়-মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো অপূর্ব।

আলুটিলা গুহা ভ্রমণ করে সবার মধ্যে যেন আবার সজীবতা ফিরে এসেছে।  নব্য উদ্যমে চলতে থাকে নাচ-গান। এরই মধ্যে আমাদের বাসে উঠে পড়েছেন চেয়ারম্যান মজনুর রশিদ স্যার ও তার সহধর্মিনী।  আমাদের নাচ গানে তিনিও আর বেশি সময় সিটে বসে থাকতে পারলেন না উঠে এলেন আমাদের মাঝে।  তিনিও নাচলেন আমাদের সঙ্গে।  বাসে চলতি পথে আমাদের সঙ্গে গলা ছেড়ে গান ধরলেন আরেফিন স্যার নিজেই। অনেক মজা মাস্তি করতে করতেই আমরা পৌঁছে যাই বান্দরবান।

বান্দরবানের নীলগিরি, নীলাচল যেন সবুজ পাহাড় ও নীল আকাশে সাদা মেঘের পসরা সাজিয়ে বসে আছে, সেই মেঘে সোনালি রোদের আলোর ঝটকায় যে বিক্ষিপ্ত সৌন্দর্য চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তা মনের মরমে যেয়ে প্রবেশ করে। এক দুপুর পর্যন্ত ভেসে বেড়ানো মেঘের নিখাঁদ সৌন্দর্যে ডুবে থেকে বিকেলে আমরা সবাই দেখতে যাই মারমা হীনযান ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র স্থান স্বর্ণ মন্দিরে। এই পবিত্র স্থানেই রয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৌদ্ধ মন্দির।

বান্দরবান ভ্রমণ শেষে রাতে আমাদের যাত্রা শুরু হয় টেকনাফের উদ্দেশ্যে। পরের দিন সকালে আমরা পৌঁছে যাই টেকনাফে। টেকনাফ থেকে সকালে লঞ্চ এম. ভি. পরিজাতে যাত্রা শুরু হয় দারুচিনি দ্বীপ খ্যাত সেন্টমার্টিনের পথে। টেকনাফ থেকে যখন আমাদের জাহাজ নাফ নদীর বুক চিরে সেন্টমার্টিন দ্বীপের দিকে রওনা দেয়, তখন আমাদের পিছু নেয় পাখা মেলে উড়তে থাকা একঝাঁক মায়াবী গাঙচিল। সমুদ্র ও গাঙচিলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে চলে আসি নীল সৌন্দর্যের নগরী সেন্টমার্টিন দ্বীপে।

চারদিকে বঙ্গোপসাগরের বিশাল নীল জলরাশি আর তার মাঝে ছবির মতো সুন্দর ও নয়নাভিরাম এই প্রবাল দ্বীপ। আমরা শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সঙ্গে দ্বীপের সৌন্দর্য উপভোগ করি, আড্ডা গানে মুখরিত ছিলাম পুরোটা সময়। রাতে সকলে মিলে কটেজে ডিজে গানের সঙ্গে নাচানাচি, সঙ্গে বারবিকিউ পার্টি।

১৩ তারিখ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই সবাই এক সাথে নাস্তা করলাম। ছেঁড়াদ্বীপ যাব, এখান থেকে বেশ খানিকটা দূর। আমাদের জন্য ভাড়া করা হয়েছে দুটি সাম্পান।

সাম্পানে সবাই ছেঁড়াদ্বীপে গেলাম। সফরের সবচেয়ে সুন্দর সময়ের মধ্যে সাম্পানে ছেঁড়াদ্বীপ ভ্রমণ ছিল অন্যতম। আমাদের সাম্পানটা ছিল পেছনে, সামনে ছিল স্যারদের সাম্পান। সামনের সাম্পান থেকে সামছুল আরেফিন  স্যার নিজে আমাদের ছবি তুলছিলেন। ছেঁড়াদ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছালে সেখান থেকে ছোট ডিঙি নৌকায় নামিয়ে দেয় ছেঁড়াদ্বীপে। নেমে প্রথমে একটা গ্রুপ ছবি তুলি আমরা, তারপর পৃথক পৃথকভাবে ঘোরাঘুরি করি ও ছবি তুলে ফিরে আসি ডেনিশে। দুপুরে জেটি ঘাটে সবাই এক সাথে খাওয়া-দাওয়া করে ফিরে আসি রিসোর্টে। তারপর বিকেলের লঞ্চে আবার যাত্রা শুরু করি টেকনাফের উদ্দেশ্যে।  টেকনাফ থেকে রাতে গাড়ি এসে থামে কক্সবাজার ওয়াটার অর্কিড হোটেলের সামনে। রাতে সমুদ্রের গর্জন শুনতে অনেকেই বেরিয়ে পড়ি সুগন্ধা বীচে।

১৪ তারিখ সবাই সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠে সোজা সমুদ্র সৈকতে গোসল। জোয়ারের পানিতে আমরা গোসল করছি সাঁতার কেটেছি,  সাঁতার ও বিভিন্ন  খেলাসহ সবকিছুর মধ্যমণি ছিলেন আমাদের সামছুল আরেফিন স্যার। কারণ, স্যার আমাদের সাথে বিভিন্ন খেলা থেকে শুরু করে গোসল সব কিছুতেই অংশ নিয়েছেন আনন্দচিত্তে। গোসল শেষে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে মেরিন ড্রাইভ রোডে ইনানী বীচের পথে যাত্রা শুরু। এক পাশে সবুজ অরণ্যের পাহাড়, অন্য পাশে বিশাল সমুদ্র সৈকত, মাঝের রাস্তা ধরে আমরা পৌঁছাই ইনানী বীচে। ইনানী বীচে থেকে ফেরার পথে আমাদের গাড়ি থামে হিমছড়িতে। নেমে বিশাল পাহাড়ের মাঝে ঝরনা দেখে সবাই উচ্ছ্বসিত।

হিমছড়ি ধরনা দেখে চলে আসি হোটেলের সামনে। সেখান থেকে দুপুরের খাবার শেষে কেনাকাটার জন্য সবাই বের হয় সুগন্ধা ও বার্মিজ মার্কেটে।  রাতের খাবার শেষে ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে বাসে উঠি। মহাসড়ক দিয়ে যথেষ্ট দ্রুত গতিতে আমাদের ট্যুরের বাস চলছে ক্যাম্পাসের দিকে। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত সবাই, তবুও মজা-মাস্তি কর‍তে করতে চলে আসলাম ক্যাম্পাসে। স্মৃতির পাতায় জমা হলো আরো একটি সোনালী অধ্যায়।

লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।


বশেমুরবিপ্রবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়