ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

বিরল ভাইরাসে আমাদের বিরল আচরণ

অরিত্র দাস || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৬, ২৯ মার্চ ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিরল ভাইরাসে আমাদের বিরল আচরণ

করোনা বা কোভিড-১৯ নামে যে ভাইরাস বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। এ ধরনের মহামারি বিশ্বে এবারই প্রথম নয়। এর আগেও আরো অনেক মহামারি এসেছে। দাপিয়ে বেড়িয়েছে। মানব সভ্যতাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। তখনও মানুষ ভেবেছিল- এই বুঝি পৃথিবী থেকে মানুষ নামক প্রাণী নিঃশেষ হয়ে যাবে। অনেকে আক্ষেপ করে বলেছেন, কেয়ামত বা মহাপ্রলয় বুঝি সামনে।

কিন্তু পৃথিবী ধ্বংস হয়নি। কেয়ামতও হয়নি। মানুষ নিঃশেষ হয়নি। বরং ভঙ্গুর পৃথিবী বিশ্বমারি থেকে বারংবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ধ্বংসস্তুপের উপর তৈরি করেছে নতুন সভ্যতা, গড়েছে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভিত। দমাতে পারেনি প্লেগ, ইবোলা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডিজিজ এক্স, গুটিবসন্ত, কলেরা, জিকা ভাইরাস, মার্স, সার্স, মারবুর্গ ভাইরাস, নিপাহ ভাইরাসসহ আরো অনেক মহামারি।

এই ভাইরাসগুলোর মধ্যে ইউরোপ থেকে ছড়িয়ে পড়া প্লেগ, যা ইতিহাসে ব্ল্যাক ডেথ নামে পরিচিত। ১৭২০ সালে আলোচিত এই সর্বগ্রাসী ভাইরাসজনিত রোগের কারণে পৃথিবীতে ২০ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এর ১০০ বছর পর ১৮২০ সালে ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ কলেরা। তাতে মৃত্যু হয় বিশ্বজুড়ে ৪ কোটি মানুষের।

তারপর আবার এক শতক পরে (১৯১৮-১৯) স্প্যানিশ ফ্লু (ইনফ্লুয়েঞ্জা) কেড়ে নিয়েছিল ৫ কোটি মানুষের জীবন। শতবছর আগের এই নিধনযজ্ঞে ভারতবর্ষে প্রাণ হারিয়েছিল ১ কোটিরও বেশি মানুষ। ওই সময়গুলোতেও মানুষ ভেবেছিল, কোনো রাগান্বিত দেবতার বিদ্বেষ বোধ হয় এই ভাইরাস। দেবতাকে প্রসন্ন করতে গিয়ে আরো সমবেত ভিড় থেকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ভাইরাস। আরো একশ বছর পর ২০২০ সালে এলো নভেল করোনা। ভাইরাসের কাছে মানুষের জীবন যেন মুড়ির মতো চিবিয়ে খাওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। এই মহামারিও বলছে, মানুষের সমাগম থেকে দূরে থাকো মানুষ।

বিদ্বেষপূর্ণ বা হিংসাত্মক ভাইরাস যাই বলা হয়ে থাকুক না কেন! মহামারি ভাইরাসের ভয়াল কামড় কি মরণঘাতী করোনায় এসেই শেষ? না, এখানেই শেষ নয়। বরং ভবিষতে নতুন নামে নতুনরূপে আর্বিভূত হবে আরো অজানা সব ভাইরাস কিংবা রোগ। হয়তো তা হতে পারে করোনার চেয়ে আরো বেশি ভয়াবহ কিংবা ঈষৎ ভয়াবহ। প্রকৃতির এ এক নির্মম প্রতিশোধ। প্রকৃতি যখন মানব সৃষ্ট অত্যাচারের সাথে পেড়ে ওঠে না, তখন অতিষ্ঠ প্রকৃতি মহামারির মাধ্যমে প্রতিশোধ নেয়। পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখে। নয়তো এই দুর্যোগকালে প্রকৃতিতে একই সঙ্গে ঝিঁঝিঁ পোকার নিশ্চিন্ত সুর আর মানুষের মৃত্যুর আর্তনাথ থাকবে কেন? কেন মৃত্যুপুরী ইতালির খালে অসময়ে ডলফিনের দেখা মিলবে! কেন প্রকৃতিতে প্রাণবন্ততা ধরা দেবে!

মানুষ প্রকৃতিকে অত্যাচার করে বারংবার। প্রকৃতি মানুষকে অত্যাচার করে একবার। প্রকৃতির সেই প্রতিশোধে নাভিশ্বাস পোহাতে হয় চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের। মানুষ বহুবার মৃত্যু উপত্যকায় পতিত হয়। অতঃপর পুনরায় সব ভুলে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় মানবসভ্যতা। ঘুরে দাঁড়ানোই পৃথিবীর ধর্ম। বস্তুত একের পর এক মহামারি মানবসভ্যতার চোখে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে একবার নয় বহুবার দেখিয়েছে- প্রকৃতি মানবসভ্যতাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। পাশাপাশি বলছে, মানুষ বৈজ্ঞানিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি। চিকিৎসা বিজ্ঞান মানুষের হাতের মুঠোয় আসেনি।

হাতের মুঠোয় আসেনি ঠিক। তাই বলে ব্যর্থও হয়নি। মহামারি নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লেগেছে। অতীতের মতো এবারও সময় লাগবে প্রতিষেধক তৈরি করতে। একসময় বন্দি হবে এই করোনা নামের অসুর। মানুষ আবার প্রাণচঞ্চলতা ফিরে পাবে। পৃথিবী ফিরে যাবে তার চির চেনা পথে। যে পথে মানুষের হাতে হাত রেখে এগিয়ে চলে মানুষ। পাশাপাশি হাঁটে মানুষ। মানুষে মানুষে কোনো ফুটের দূরত্ব নেই, কিন্তু ওপথে ফিরে যাওয়ার সময়টুকুর মধ্যে ঝরে যাবে হাজার হাজার জীবন। করোনার রাক্ষুসে ছোবল এতটাই ভয়াবহ যে, মৃত্যুর মিছিল লাখের ঘরে চলে যায় কিনা একটা সন্দেহ থেকে যায়। তবুও পৃথিবীর অসুখ সারবে।

একসময় পৃথিবীর অসুখ সারবে বটে, কিন্তু আমাদের অসুখ কখনো সারবে কি? একটা প্রশ্ন রয়েই যায়। করোনাভাইরাস যখন চীনে ছড়িয়ে পড়ল, সাথে সাথে এদেশে এক বিশাল শ্রেণীর মানুষ সচেতন হওয়ার পরিবর্তে সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠল। তারা ধর্ম দিয়ে ভাইরাসকে বন্দি করতে মরিয়া হয়ে উঠল। ভাইরাসকে ঈশ্বরের সৈনিক বলে বলে ফতুয়া দেওয়া শুরু করল। দেবতাদের দোহাই দেওয়া শুরু করল। কলেরা, বসন্ত, যা যখন এলো তখনও একই কাজ করেছে ভারতীয় উপমহাদেশের অধিবাসীরা।

কিন্তু যুগে যুগে প্রতিটি ভাইরাস কোনো ধর্ম, বর্ণ, জাত, গোষ্ঠী, ধনী- গরিব বিবেচনা করেনি। তারা সব ধর্মের মানুষকে আক্রমণ করেছে। ক্ষতবিক্ষত করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় যখন নভেল করোনাভাইরাস ইরান সৌদি আরবে ছড়িয়ে পড়ল, তখন এদেশের অন্ধবিশ্বাসীরা বিষম খেলো। বিষম গিলতে না গিলতেই অতি দ্রুত বাংলাদেশেও চলে এলো রাক্ষুসে করোনা।

একশ্রেণী বলছে বিধর্মীদের জন্য করোনা ভাইরাস আল্লাহর গজব, অন্যশ্রেণী এই গজব ঠেকাতে করছে গোমূত্র পার্টি। শুধু তাই নয়, হবিগঞ্জের লাখাইয়ে শতশত মানুষ করেছে পুণ্যস্নান, লক্ষ্মীপুরে করোনা থেকে মুক্তির দোয়ায় হাজার হাজার মানুষ করেছে গণ জমায়েত। অথচ এই ধরনের ভাইরাস গণ-সমাবেশ থেকে ছড়িয়ে পড়ে বেশি। যেমন করে এক ফোঁটা বৃষ্টির জল আকাশ থেকে পড়ে সহসা সমুদ্রের সর্বত্র মিশে যায়। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস কেবল অন্ধবিশ্বাসে।

এই ধরনের কুসংস্কার পূর্বেও ছিল। আধুনিক যুগের আগে যখন প্লেগ বা স্মলপক্স দেখা দেয়, তখন সাধারণ মানুষ দেবতাদের সন্তুষ্টির জন্য একত্রে প্রার্থনার ব্যবস্থা করত। কিংবা রোগ মুক্তির আশায় দেবতার আশীর্বাদ চাওয়ার জন্য এক জায়গায় জড়ো হত। এতে কোনো উপকার হয়নি। বরং, মানুষ যখন এসব প্রার্থনার জন্য জড়ো হতো, তখন সংক্রামক রোগ আরো বেশি করে ছড়িয়ে পড়তো। সেই হাজার বছরের অন্ধকারাচ্ছান্নতা একবিংশ শতাব্দিতে এসে আমরা আকড়ে ধরে আছি। এজন্য তারা বাহাবা পাবে নিশ্চয়ই, কিন্তু উপশম মিলবে না বরং বাড়বে।

লেখক: প্রবন্ধলেখক, শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।


জবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়