ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

গল্পে গল্পে ‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখি’

আনিকা তাসনিম সুপ্তি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০৭, ৩০ মার্চ ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গল্পে গল্পে ‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখি’

‘এত দিন গল্পের বিষয় ও আঙ্গিকের যে নিরীক্ষা আমি করে এসেছি, এই বইয়ে তার একটা সম্প্রসারণ হয়তো দেখা যাবে। এ বইয়ে আঙ্গিকের নিরীক্ষাগুলো আমি করেছি তুলনামূলকভাবে স্বাচ্ছন্দ্যে।’ কথাগুলো এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখি’ বইয়ের লেখক শাহাদুজ্জামান।

লেখক এই অধুনা জগতের যাপিত জীবনের ভাবনা-চিন্তা মিলিয়ে মিশিয়ে লিখেছেন ‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখি’ বইটি। এতে মোট ১১টি গল্প স্থান পেয়েছে। সমসাময়িক গভীর উৎকণ্ঠা বয়ে গেছে প্রতিটি গল্পের শরীরে। গল্পগুলো সম্পর্কে পাঠক হিসেবে কিছু পর্যালোচনা-

‘জনৈক স্তন্যপায়ী প্রাণী, যিনি গল্প লিখেন’ এই গল্পে শাহাদুজ্জামান একজন স্তন্যপায়ী প্রাণীর কথা শুনিয়েছেন, যিনি পরিচিত পাঠকদের ভিড় থেকে মুক্ত হয়ে সাহসী অপরিচিত পাঠকদের জন্য গল্প লিখতে চান। গল্পটি মূলত একজন লেখকের মনস্তত্বের গভীর বয়ান, যেখানে গল্পের চরিত্র মতিন কায়সার সারাক্ষণ ভাবেন, তার লেখা গল্প, গল্প হয়ে উঠছে কি? এখানে ধরাবাঁধা কোনো কাহিনী নেই, কিন্তু লেখক-পাঠক উভয়ের জন্যই এই গল্প যেন অমোঘ বাণী।

‘মৃত্যু সম্পর্কে আমার অবস্থান খুব পরিষ্কার’ এই গল্পের প্রধান চরিত্র পলাশ, যার মৃত্যু সম্পর্কে অবস্থান খুব পরিষ্কার, অথচ এই স্বচ্ছতা সত্ত্বেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে তিনি দ্বিধান্বিত। গল্পটাকে এগিয়ে নেওয়া হয়েছে প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে, যার ধরনটা মুগ্ধ করেছে। লাইফ সাপোর্টে থাকা বাবাকে নিয়ে নিত্য দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগা পলাশ লাইফ সাপোর্ট নিয়ে ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করে একটি অনন্য গভীর প্রশ্ন, মেডিকেল সায়েন্স জীবন-মৃত্যুর কোনো সমাধান দিতে পারছে না, কিন্তু আমাদের একটা নৈতিক দ্বিধার ভেতর ফেলে দিচ্ছে, তাই না?

‘টুকরো রোদের মতো খাম’ গল্পে আন্দালীব নামে একজন খেয়ালি মানুষের দেখা পাওয়া যায়, যিনি হাতে পান এক বেওয়ারিশ ফাঁসির আসামির জীবনের শেষ চিঠি। এতে অনেক কথার ভিড়ে একটা কথা আন্দালীবকে প্রবলভাবে নাড়িয়ে দেয়। শুধু আন্দালীব নয়, এই অসাধারণ গল্পটি পড়তে গিয়ে পাঠকও নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হবেন। গল্পটি শেষ হয় যেন অন্যরকম তৃপ্তি নিয়েই।

‘চিন্তাশীল প্রবীণ বানর’ নামটি লেখক রূপক অর্থে ব্যবহার করেছেন বলেই মনে হয়েছে। এই গল্পে লেখক এক চিন্তাশীল প্রবীণ বানরের সাথে পাঠকের পরিচয় করান, যে কিনা শহীদুল জহিরের পুরান ঢাকার এক ছাদে বসে আবদুল মোমেন এবং তার পরিবারকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করেন। এই পরিবারে যা যা ঘটে, তা চিন্তাশীল বানরটির কতটুকু চিন্তার প্রসার ঘটায়, তা না জানা গেলেও নিজস্ব চিন্তাভাবনায় বলতে পারি, গল্প শেষে পাঠকের তৃপ্তির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কমই থাকে।

‘পৃথিবীতে হয়তো বৃহস্পতিবার’ নামের সাথে গল্পের সংযুক্তি ঠিক ধরা যায়নি। তবে, এখানে এক প্রতারক এবং প্রতারিতের কথা জেনেছি। গল্পের চরিত্র মাসুদ নিজেও জানে এই শহরে টিকে থাকার মূলমন্ত্রই হচ্ছে প্রতারণা, কিন্তু তাও নিজের সাথে হওয়া প্রতারণায় মাসুদ যেন হতবিহ্বল হয়ে যান। কায়সার হকের মতো প্রতারকরাই টিকে থাকেন।

‘উবার’ গল্পটি এই বইয়ের একমাত্র গল্প, যা সম্পর্কে পাঠকের পক্ষে আগে থেকে বিন্দুমাত্র কিছুই আঁচ করা সম্ভব নয় বলেই মনে করি। লেখক এ গল্পে টান টান উত্তেজনার মধ্যে রেখেছেন সত্যি, কিন্তু যেরকম আবহ তৈরি হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত সেরকম কিছুই পাওয়া যায়নি। এই গল্পে আরো জানা যায়, বোধিপ্রাপ্ত এক উবার চালকের কথা, যে কিনা দুনিয়ার কোনো খোঁজ রাখে না, অথচ নিজের রাইড নিয়েই খুব বেশি চিন্তিত। খুব সাধারণভাবেই শেষ হয়েছে অর্থহীন এই গল্পটি।

‘ওয়ানওয়ে টিকেট’ গল্পতে দেশ না ছাড়ার নানারকম যুক্তি এক হাতে নিয়ে, অন্য হাতে আমেরিকার ওয়ানওয়ে টিকেট যে ভদ্রলোকের, তার নাম রফিকুল আলম। এই রফিকুল আলমের গল্পের ফাঁকে সমসাময়িকতা চরমরূপে ধরা দেয় পাঠকের সামনে। গল্পের শেষটা চিরচেনাই ছিল। নতুনত্ব নেই, তবে গল্পের কাহিনী ভালো। ক্ষুদ্র পরিসরে লেখক বিস্তৃত এক কাহিনী তুলে এনেছেন এই গল্পে।

‘অপস্রিয়মাণ তির’ গল্পটি চাতক পাখির মতো অপেক্ষমাণ এক যুগলের উৎকণ্ঠার গল্প। নীনা আর সাব্বিরের একমাত্র সন্তান শাহাব। দিনে দিনে রুক্ষ হয়ে ওঠা শাহাব যেন অপস্রিয়মাণ তিরের মতো হাতছাড়া হয়ে হারিয়ে যান। সমসাময়িকতা গভীরভাবে ফুটে উঠেছে এই গল্পে। তবে অসমাপ্ত এই গল্পটি চিন্তার জন্ম দেয়।

‘লবঙ্গের বঙ্গ ফেলে’ গল্পের মোজাম্মেল আলী বংশানুক্রমে সবচেয়ে বড় কাঁঠালবাগানের মালিক। ভাগ্যের লিখনে মোজ্জাম্মেল আলীর কাঁঠালময় জগতে ধীরে ধীরে ঘটে এক অনিবার্য সর্বনাশের কাহিনী। লেখকের দৃঢ় লিখনশৈলী দ্বারা কাহিনী ভালোভাবেই এগুতে থাকে। এই গল্পে একাকিত্ব, বিষণ্নতা, বেদনা, প্রতারণা আর মৃত্যু মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। গল্পটির চরিত্রগুলোর সাথে ছিল পরিবেশের অদ্ভুত সংযুক্তি৷ তাছাড়াও গল্পটির কাঠামো, ভাষা সব কিছুই পাঠককে আগ্রহী করে তুলবে।

‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখি’ গল্পটি নিয়ে নির্দ্বিধায় বলতে পারি, বইয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী গল্প। গল্পের ভেতর গল্প যাকে বলে, তার আভাস পাওয়া যায় এখানে৷ গল্পে জানা যায়, মোহাম্মদ বজলু নিশানদিয়া গ্রামের একজন গাছি, বজলুর গোপন নেশাটা হচ্ছে কবি আবদুল করিমের পুঁথি পড়া, যে পুঁথির গল্পে আছে এক ময়না পাখির গল্প, যে পাখি আদালতে সাক্ষী দেয়। হারিকেনের আলোয় পুঁথিপাঠ করা সরল গাছি বজলু কীভাবে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে মুহূর্তেই পাল্টে যায় অন্য এক মানুষে, তা এই গল্পটিতে দেখা যায়। এখানে আছে একদিকে সত্যের জয়, অন্যদিকে প্রতারণা, আবার মিথ্যার জয়জয়কার।

শেষ গল্প ‘নাজুক মানুষের সংলাপ’।  এটি একটি সংলাপনির্ভর গল্প। এই গল্পটা দু’জন মানুষের কথোপকথন। উত্তরসূরি আর পূর্বসূরি নামক দু’জন মানুষ জীবনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্পে মেতে ওঠে। পূর্বসূরি একের পর এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় উত্তরসূরির দিকে, আর উত্তরসূরি সেই সব জটিল প্রশ্নের সহজ উত্তর দিতে থাকেন। সেখানে থাকে জীবনবোধের কথা, বাস্তবতার কথা, সত্য-মিথ্যার ভেদাভেদের কথা, নৈতিকতার কথা, নান্দনিক সৃজনশীলতার কথা, যৌনতার কথা। গল্প এগিয়ে চলে প্রশ্ন-উত্তর পর্বের মাধ্যমে, যা পড়ে জীবনবোধের অতলে ডুব দেওয়া যায় সহজেই। দার্শনিক ভাবনার এই গল্পটি বারবার পড়ার মতো।

শক্তিশালী ছোট গল্পকার হিসেবে খুব কম লেখকই নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন শাহাদুজ্জামান। এই বইয়ের প্রতিটি গল্পে শাহাদুজ্জামানের স্বকীয়তা এবং সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ রয়েছে। ‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখি’ নামটি মূলত আবদুল করিম খানের একটি পুঁথি থেকে নেওয়া। ১৪২৫ বঙ্গাব্দে ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই’ হিসেবে শাহাদুজ্জামানের গল্পগ্রন্থ ‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখি’ সৃজনশীল শাখায় পুরস্কার পেয়েছে।

যুতসই একটি নামকরণই মূলত বইটি পড়তে আগ্রহী করে তোলে। সব শ্রেণির পাঠক এই বই পড়তে আগ্রহী হবেন না, তবে পড়ার সময় প্রথম গল্পটি প্রত্যেক পাঠককেই গভীরভাবে ভাবাবে, যদিও প্রথমটির চাইতে অন্যান্য গল্পগুলো বেশি সাবলীল। তবে, প্রতিটি গল্পই স্বতন্ত্র ও সুন্দর। গল্পগুলোর বিষয়বস্তু নির্বাচনের ক্ষেত্রে সমসাময়িকতা এই বইয়ের একটি উল্লেখযোগ্য দিক।

বইয়ের বেশির ভাগ বাক্যই এতটা গভীর যে, এর গভীরতা উপলব্ধি করতে পাঠক দ্বিতীয়বার বইটি পড়তে বাধ্য হবেন।

এতে লক্ষ করলাম, কিছু গল্পে ঘটনার আবহ দিয়ে ঘটনা বোঝানোর চেষ্টা খুব প্রবল, তবে বেশির ভাগ গল্পেই সরাসরি গভীর বর্ণনা দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা আছে। এভাবেই প্রচলিত গল্পের ধারাকে ভেঙে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখক খুব ব্যতিক্রমীভাবে সাজিয়েছেন গল্পগুলো। বইয়ের কিছু বাক্য বা বিষয় খুব জটিল মনে হয়েছে, আর বেশির ভাগ বাক্য এতটা গভীর যে, এর গভীরতা উপলব্ধি করতে পাঠক দ্বিতীয়বার বইটি পড়তে বাধ্য হবেন।

বইতে পাওয়া যায় বিবেক জাগ্রত করার মতো কিছু কথা, যা বই থেকে হুবুহু তুলে এনেছি-

‘গল্প লিখলেই তাকে গল্প বলা যায় না। গল্পের এই নকল পৃথিবীর ভেতরও আসল আছে, আবার নকলের নকল আছে। কেউ গল্প বানিয়ে তোলে, কারও গল্প হয়ে ওঠে।’

‘বেঁচে থাকা মানে তো মানুষকে ভালোবাসতে পারার একটা সুযোগ, হয়তো মানুষের ভালোবাসা পাওয়ারও একটা সুযোগ।’

‘প্রতারণার দক্ষতাই এ শহরে টিকে থাকার মন্ত্র।’

‘কবিতা হচ্ছে সেই মিথ্যা যা সত্যকে বুঝতে সহায়তা করে।’

'আপাতত যাত্রা করো পরিব্রাজকের মতো, পর্যটকের মতো নয়। পর্যটক হচ্ছে সেই মানুষ, যার ঘরে ফেরার পরিকল্পনা আছে, আর পরিব্রাজকের নেই। পরিব্রাজকের কাছে গন্তব্য প্রধান না, পথটাই প্রধান।’

‘আদিম এককোষী প্রাণী অ্যামিবা অমর। কিন্তু তার কোনো যৌনতা নেই। একে অন্যের সঙ্গে মিলিত না হয়ে কেবল নিজেকে ভেঙে ভেঙে সে বংশবিস্তার করে। তার যেমন যৌনতা নেই, তেমনি মৃত্যুও নেই। কিন্তু প্রজাতি রক্ষার জন্য মানুষকে যৌনতায় লিপ্ত হতে হয়। এই যৌনতার বিনিময়ে তাকে অমরত্ব বিসর্জন দিয়ে আলিঙ্গন করতে হয়েছে মৃত্যুকে। তবে সেই যৌনতার সঙ্গে যদি প্রেম যুক্ত হয়, তাহলে হয়তো খানিকটা অমরত্বের স্বাদ মিটতে পারে।’

‘মানুষ নান্দনিক জীব। নকশা পিঠার স্বাদের কোনো পরিবর্তন করে না, তবু সে নকশি পিঠা বানায়। নান্দনিক সৃজনশীলতাও তার একটা তাড়না। বাবুই পাখিরও নান্দনিক সৃজনশীলতা আছে। অপূর্ব জটিল এক বাসা বানায় সে। কিন্তু বাবুই ওই একই নান্দনিকতায় বন্দি। এর চেয়ে ভালো বা মন্দ কিছু সৃষ্টি করার দক্ষতা তার নেই। পক্ষান্তরে মানুষের সৃজনশীলতা নানা রহস্য আর অনিশ্চয়তায় আচ্ছন্ন।’

লেখক: শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ (৩য় বর্ষ), কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

কুবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়