ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বাংলা সাহিত্যে মহামারি

হুসাইন আহমেদ সৌরভ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৩, ৩ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাংলা সাহিত্যে মহামারি

মহামারি মানেই শেষযাত্রার মহামিছিল। পৃথিবী এ মহামিছিলের সাক্ষী হয়েছে বারবার। কখনো এক মহামারির হাত ধরে এসেছে আরেক মহামারি, কখনো আবার দীর্ঘ সময় পরে জন্ম নিয়েছে নতুন আরেকটি। কিছু বৈশ্বিক, কিছু আবার নির্দিষ্ট কোনো জাতির ভিত্তিতে আঘাত হেনেছে।

প্লেগ, বসন্ত, কলেরা, ফ্লু, এইডসের মতো মহামারিগুলোর পথ বেয়ে মানবসমাজ ও সভ্যতার ভিতে নতুনভাবে নাড়া দিতে হাজির হয়েছে কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস। পূর্ববর্তী সব মহামারি, এদের প্রকোপ ও সেগুলো থেকে মানুষের মুক্তির প্রচেষ্টা নানাভাবে স্থান পেয়েছে বিশ্বসাহিত্যে। বাংলা সাহিত্যও এর ব্যতিক্রম নয়। আমাদের সাহিত্যিকদের কলমের খোঁচায় দর্পণের মতো ফুটে উঠেছে নানা মহামারির ধ্বংসযজ্ঞ, মহামারি সময়ের মানুষ।

আমরা অতীতের সেসব দুর্বিষহ দিনগুলোতে ফিরে যাই এসব লেখকের বর্ণনাশিল্প অবলোকন করে। এগুলো আমাদের মর্মমূলে গভীরভাবে নাড়া দিয়ে যায়, করে তোলে শঙ্কিত, ভাবায় এ সময়ের কোভিড-১৯ সংক্রমণ বিষয়ে। আমরা কি টিকে থাকব, আর যারা টিকে থাকবে, তারা হারাবে কত প্রিয়জনকে?

কোভিড-১৯ সংক্রমণের এ সময়টায় আমরা মানুষের চোখে দেখছি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। মানুষ ছুটছে, যেন পালাতে চাইছে। অন্য দেশগুলোতে  সংক্রমণের কথা ছড়িয়ে পড়লে অনেকে দেশে ফিরে আসছে। কোথাও সংক্রমণ শুরু হয়েছে জানতে পারলে, সেখানে মানুষ নেই, যেন সেখানে থাকতে নেই। নানা গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে, কলম্বিয়ায় করোনা আতঙ্কে পালিয়ে যেতে গিয়ে নিহত হয়েছে ২৩ জন। 

আহমদ ছফার ‘সূর্য তুমি সাথী’ উপন্যাসে কলেরা থেকে পলায়নপর মানুষের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এভাবে, ‘কলেরার সময় গাঁ ছেড়ে পালাচ্ছে ডরে মানুষ। এক বাড়িতে কারো কলেরা লাগলে পাশের বাড়ীর মানুষ উধাও।’ শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’ উপন্যাসে বসন্ত রোগের প্রকোপের সময় মানুষের এ পলাতক মনোভাব ফুটে উঠেছে, ‘কবর আর কবর। মুশকিল হচ্ছে, যারা বেঁচে আছে, তারাও পালাচ্ছে ভয়ে।’

এখন যেমন প্রতিনিয়ত চীন, ইতালি, স্পেন, আমেরিকায় আমরা মৃত্যুর মিছিল দেখে চমকে উঠছি, আর এও ভাবছি, যদি আমাদেরও এরকম কোনো কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়, দেখতে হয় স্বজনের মৃত্যু। সেই সময়টা কেমন হবে? অথচ বঙ্গদেশেও এরকম মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছে অনেকবার। বাংলা সাহিত্যে সেসবের উল্লেখ প্রচুর।

সেলিনা হোসেনের ‘কাকতাড়ুয়া’ উপন্যাসে ‘বুধা’ তার পরিবারের চারজনকে হারিয়েছে। বুধার মানসিক বিপর্যস্ততার ইঙ্গিত লেখিকার কলমে ধরা দিয়েছে, ‘চোখের সামনে মা-বাবা, চার ভাই-বোনকে মরে যেতে দেখলে কেউ কি নরম থাকতে পারে?’ হয়তো পারে না। তাই পৃথিবীব্যাপী আজ কান্নার রোল। কলেরা মহামারি কীভাবে মৃত্যুর পর মৃত্যু উপহার দিয়েছে সেলিনা হোসেন তারও উল্লেখ করেছেন। ‘সেবার কলেরায় মহামারিতে উজাড় হয়ে যায় গাঁয়ের অর্ধেক লোক।’

জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসে ওলা বিবির (কলেরা) কবলে পড়ে অনেককে মরতে দেখা গেছে। ‘অবশেষে আরো আট দশটি প্রাণ হরণ করে তবে গ্রাম থেকে বিদায় নিলেন ওলা বিবি।’

সবাই যখন করোনা থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইছে, তখন দেখা মিলছে কিছু স্বেচ্ছাসেবীর, আমাদের প্রিয় ডাক্তারদের। জীবন বাজি রেখে তারা লড়ছেন। শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংসপ্তক’ উপন্যাসে দেখা মিলবে রাবু, সেকান্দর, জাহেদ প্রভৃতি চরিত্রের। আবার সেবা দিতে গিয়ে অনেক ডাক্তারকে সংক্রমিত হতে দেখা গেছে। অনেককে পাঠানো হয়েছে হোম কোয়ারেন্টাইনে। রাবু নিজেও বসন্ত রোগীর সেবা করতে গিয়ে নিজেও বসন্তে আক্রান্ত হয়ে গেছেন। শহীদুল্লা কায়সার সে রাবুর অবস্থা বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘গায়ে হাত রেখে চমকে উঠলো ওরা। এখন কোঁকাচ্ছে না রাবু। অচেতন পড়ে আছে, জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গাটা। ডাক্তার এলো। দেখল। গম্ভীর মুখে বলল পক্সের আলামত।’

করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সাবান, জীবাণুনাশকের ব্যবহার করার জন্য WHO কর্তৃক পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। শহীদুল্লা কায়সারের সংশপ্তকে জীবাণুনাশক ব্যবহার করতে দেখা যায়, আরো দেখা যায় ঘর পরিষ্কার করতে। ‘ঝেড়ে-মুছে নতুন চাদরে, নতুন পর্দায় ঝকঝকে করে ফেলল রাবুর ঘরটি। সারা বাড়িতে ছড়িয়ে দিলো জীবাণুনাশক।’

করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি, মানুষকে কীভাবে রক্ষা করা যাবে এ মহামারি থেকে? চীনে ফ্লুর ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে, ট্রাম্প ওষুধের নাম প্রস্তাব করেছে। কিন্তু, সব কিছু ছাপিয়ে ধ্বনিত হচ্ছে, ঘরে থাকো। হোম কোয়ারেন্টাইন। আইসোলেশন। নার্সিং। ‘সংশপ্তক’ উপন্যাসে ভ্যাকসিনবিহীন বসন্ত চিকিৎসায় এ দিকটির প্রতিই যেন ইঙ্গিত, ‘সাবেক রায়টাই বহাল রাখল এম.বি ডাক্তার। বলল প্রধান ওষুধ নার্সিং। ভালো নার্সিং চাই।’

করোনার সময় প্রশ্ন উঠছে, যারা মারা গেলেন, তাদের শেষকৃত্য হবে কীভাবে? তখনই কিছু মানুষ নিজেরা স্বেচ্ছাসেবক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে সামাজিক মাধ্যমে লিখছেন। কোথাও সেনাবাহিনী, কোথাও বা স্বেচ্ছাসেবক, কোথাও আবার ডাক্তাররা করছেন এ কাজ।

আহমদ ছফার ‘সূর্য তুমি সাথী’ উপন্যাসে এ রকম স্বেচ্ছাসেবকদের বর্ণনা আছে। ‘আর এরা সারাটা ইউনিয়ন ঘুরে ঘুরে দেখছে, কোথায় মানুষ মরে আছে, কোথায় মৃতের সৎকার হচ্ছে না। তারা হিন্দু? তারা মুসলমান, তারা কোন জাত? হাসিম অবাক হয়ে মনির আহমেদ এর মুখের দিকে চেয়ে থাকে।’

চীনে করোনায় মৃত্যুর মিছিল কমে আসলে আতশবাজিতে উদযাপন করতে দেখা গেছে সে দেশের মানুষকে। আমাদের আতশবাজি সংস্কৃতি নেই। তবে, আমাদের সাহিত্যে মহামারি থেকে মুক্তির সময়টা মানুষকে নিজেদের মতো করে আনন্দ প্রকাশ করতে দেখা যায়, আর তাতে থাকে মানুষের নিজস্ব ধর্মবোধ, নিজস্ব সংস্কৃতি। ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসে জহির রায়হান এ বাস্তবতা ফুটিয়ে তোলেন, ‘গ্রাম থেকে বিদায় নিলেন ওলা বিবি। গ্রামের সবাই মসজিদে সিন্নি পাঠালো। মিলাদ পড়ালো বাড়ি বাড়ি।’

সাহিত্য সমাজের দর্পণ, জীবনের আরশি। এ আরশিতে ফুটিয়ে তোলা হয় সমাজ, সমাজের মানুষ, সমকালীন পরিস্থিতি। রোগ-শোক, মহামারি মানুষের জীবনের করুণ সত্য। এ সত্য যেমন ফুটে উঠেছে বিদেশি সাহিত্যে, তেমনি ফুঠে উঠেছে বাংলা সাহিত্যেও।

লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।


কুবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়