ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘সময় বদলায়, বদলায় না মানুষগুলো’

মো. রকিবুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৪৯, ২৩ মে ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
‘সময় বদলায়, বদলায় না মানুষগুলো’

ইতিহাসের ধারাবিবরণীতে মানুষ পাল্টে গেছে বারবার। পাল্টেছে চিন্তা-ভাবনা, বেঁচে থাকা, স্বপ্ন দেখা। টেকনোলজির দুনিয়া এসে গোগ্রাসে গিলে নিয়েছে সবকিছু। কিন্তু মানুষের শ্রেণি সংগ্রাম কি পাল্টেছে? প্রত্যেকটা দিন-রাতের সঙ্গে লড়াই! টাইম এবং স্পেসের ব্যবহার বিশ্ব-সংসারে হু হু করে বদলাতে থেকেছে, সেই সঙ্গে বদলে গেছে জীবনযাত্রার সংজ্ঞা।

এমতাবস্থায় আমাদের কি একবার হলেও মনে পড়বে না ‘মেঘে ঢাকা তারা’ চলচ্চিত্রের সেই অমোঘ দৃশ্যটির কথা, যেখানে রাতের অন্ধকারে জানলার ধারে কিছুক্ষণ থমকে যাওয়া এক চরিত্র বলে ওঠেন, ‘রাত কত হল? উত্তর মেলে না।’ বিশ্বায়ন আর পুঁজিবাদী সংস্কৃতির গ্রাস আমাদের যেমন নিঃসঙ্গ করেছে, তেমনি শাসক আর শোষকের মধ্যে ঠিক কতখানি দূরত্ব তা বুঝিয়েও দিয়েছে। নাহলে ঋত্বিক ঘটক দেশভাগের যন্ত্রণার ছবি বানাতে বানাতে লিখতেন না, ‘মানুষ, তোমাকে ভালোবাসি। এইভাবে, পৃথিবীর ইতিহাস বারবার বদলে গেছে, তবুও মানুষ, সবসময় বেঁচেছে। মানুষ, তোমাকে ভালোবাসি।’

মানুষ বাঁচে। আনন্দে, যন্ত্রণায়, উচ্ছ্বাসে, অনাহারে – মানুষ বেঁচে যায়। এটাই মানুষের ধর্ম, এটাই মানুষের নিয়তি। দেশ ভাগের পর কেটে গেছে প্রায় ৪৯টা বছর। শিকড় হারানোর যন্ত্রণার মধ্যে সেই ছোট্ট হাসির চারাগাছটি কীভাবে পুঁতে রাখা যায়, মানুষ জানে। ‘দেশবিভাজন,তৎকালীন পাকিস্থান’ বনাম ‘করোনা এবং বর্তমান বাংলাদেশ’– পাশাপাশি রেখে আলোচনা করলে একটা শব্দই হয়তো মাথায় আসে আমার আপনার–মানুষ।

এখন ২০২০ সালের মে মাস। করোনার প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা দেখেছি হাজার হাজার প্রবাসী বাড়ি ফিরতে চাওয়ার আকুতি জানিয়েছিলেন। আকুতি জানিয়েছিলেন দেশের শ্রমিক মহল। দেশসহ পৃথিবীর আদ্যপান্তে গিজগিজ করছে তাঁদের মাথা। না, আমরা কেউ তাঁদের নাম জানি না। মানচিত্রের বুকে তাঁরা ‘দুঃস্থ খেটে খাওয়া শ্রমিক’, করোনা ভাইরাসের ভয়াবহ প্রকোপে তাঁরা সবাই বাড়ি ফিরছেন – ‘নিজের দেশ কিংবা দেশের বাড়ি’ যেটাই হোক। ভিন দেশ থেকে নিজ দেশে কিংবা দেশের অন্য কোনো শহর থেকে নিজ গ্রামে। এতদিন তাঁরা জানতেন, উপার্জনের ওই জায়গাটিই আসলে নিজের দেশ বা অঞ্চল। যেখানে খেতে পরতে পান। আরেক দেশে থাকেন স্বজনেরা। বছরের হয়তো ওই তিন/চারটে দিন তাঁদের দেখার সুযোগ হয়। আর সারাবছর মালিক যেখানে রাখবেন, সেটাই দেশ।

লকডাউনের এই কঠিন পরিস্থিতিতে হঠাৎ তাঁদের বলা হয়েছে, ‘চলে যাও’ কিংবা নিজ দেশ বা বাড়ি যাও’। তাঁরা দেশে ফিরতে চাইছেন। কিন্তু বাড়ি? এত দিন যেখানে কাজ করছেন সেটা বাড়ি নয়? দেশের কথাই যদি বলি, বাবুরা লকডাউনের নির্দেশ দেন, কিন্তু কীভাবে তাঁরা বাড়ি ফিরবেন তা বলে দেন না। অতএব হুটহাট করে চলে আসা। শত শত মাইল দূরে পৌঁছে দেবে দেশের বাড়িতে। স্বামী-স্ত্রী-দুই বাচ্চা আর একটা পুঁটলি।

১৯৭১ সাল–দেশভাগ–হঠাৎ ঘোষিত হলো দেশ ছাড়তে হবে পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থান তথা বাঙালি শ্রমিক, কর্মচারী ও অফিসারদের। অন্য দিকে মিলিটারি আর্মিরা বাংলার বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালায় এবং দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করে। দেশ না ছাড়লে সমস্ত বাড়ি-ঘরে জ্বলবে আগুন, চলবে গুলি। এমন পরিস্থিতিতে বাঙালিরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও একটি পুটলি নিয়ে নিরুপায় হয়ে হাটা শুরু করতে হয়েছিল ভারতের দিকে। দিনের পর দিন হেঁটে হেঁটে অবশেষে ভারতের অভ্যন্তরে জায়গা। অনাহারে থাকা, খুদার যন্ত্রণায় ছটফট করা এগুলো ছিল নিত্য দিনের ঘটনা। ভারত সরকারের দেওয়া স্বল্প পরিমাণ ত্রাণ! আমরা সবাই জানি ৭১ এর ঘটনা।

ইতিহাস আসলে আমাদের নিজেদের চিনতে শিখিয়েছে। বোঝানোর চেষ্টা করেছে এক থেকে আরেক প্রজন্মে যাওয়ার বিবর্তন। ঘটনাচক্রে আমাদের বেশ কয়েকটি প্রজন্ম স্বচক্ষে এমন মহামারি প্রত্যক্ষ করিনি। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর পড়েছি, আরও আন্দোলনের কথা জানি–সবটাই বইয়ের পাতায় কিংবা সিনেপর্দায়। আমাদের কাছে তাই ‘করোনা’ নামক মহামারি প্রবল উদ্বেগের। আমরা ঠিক চিনে উঠতে পারছি না কোলাহলহীন এই বৃহত্তর সমাজটাকে।

প্রত্যেকটা সময়েই বলি হতে হয় কিছু শ্রমজীবী মানুষকে। ইতিহাস পাল্টে যায়, কিন্তু সমাজ গড়ার নামে যাবতীয় ‘প্রগতিশীলতা’ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তখন ঋত্বিক ঘটককে অনুসরণ করেই বলতে হয়, ‘তবুও মানুষ, সবসময় বেঁচেছে’। কিছু দিন আগেও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও ঘুরছিল লকডাউন হালকা শিথিল ও কিছু পোশাক কারখানা খুলে দেওয়ায় গার্মেন্টসকর্মী ও দিনআনা দিন খাওয়া লোকগুলো পায়ে হেঁটে দূর দূরান্ত থেকে কারখানায় যাওয়ার। যেখানে দেখা যাচ্ছিলো ময়মনসিংহ গাজিপুর টাঙ্গাইল ও তার দূরবর্তী কয়েকটি এলাকা থেকে পায়ে হেঁটে ঢাকায় যাচ্ছিলো হাজার হাজার শ্রমিক। শত বাঁধা-বিপত্তি ঠেলে রোজগার কিংবা চাকরি বাঁচানোর স্বার্থে ছুটে চলেছেন গন্তব্য ঢাকা ও গাজিপুরের দিকে। নিম্ন আয়ের মানুষগুলো কয় দিনের হেঁটে হেঁটে পথচলা শেষে যখন খাবার পেয়েছেন। দু’মুঠো ভাত তখন ভেসে যাচ্ছে চোখের জলে। তাঁরা জানেন চোখের জলে ভাত মাখলে তা মহামারির চেয়েও বিষাক্ত হয়ে ওঠে। করোনার জন্য ভয় যতটুকু, তারও বেশি পেটের জন্য।

জয় গোস্বামীর একটি কবিতার কথা মনে পড়ছে। দেশভাগের প্রেক্ষাপটে কিছু শরণার্থী মানুষদের নিয়ে তাঁর সেই দীর্ঘ লেখা ‘নন্দর মা’। ‘সেই কোন দেশে আমরা যাচ্ছিলাম/ কোন দেশ ছেড়ে আমরা যাচ্ছিলাম/পেরিয়ে পেরিয়ে উুঁচু, নিচু, ঢালু মাঠ/ শিশির ভেজানো কাঁটাতার, গাছপালা/আলপথে নেমে আমরা যাচ্ছিলাম/ধানক্ষেত ভেঙে আমরা যাচ্ছিলাম/ছোট বোন আর মা বাবা, গ্রামের লোক/তার পাশে আমি...’

দেশবিভাজন বনাম করোনা–মহামারি দুটিই। একটি ভৌগোলিক আরেকটি ভাইরাস। মধ্যখানে পড়ে থাকেন অজস্র মানুষ।

লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


রাবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়