ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

‘জীবনে সফল হতে জিপিএ-৫ মুখ্য নয়’

ইমরান ইমন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৪৪, ৩১ মে ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
‘জীবনে সফল হতে জিপিএ-৫ মুখ্য নয়’

যারা আজ জিপিএ-৫ পাওনি বলে হা-হুতাশ করছো, ওমুকে পেয়েছে আমি কেন পেলাম না! ওমুক-তমুকের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করে নিজেকে অযোগ্য ভাবছো, অনেকে আবার অতি আবেগপ্রবণ হয়ে আত্মহত্যার মতো মহা অন্যায়ের সিদ্ধান্ত নিচ্ছো তাদের জন্য বলি, জীবনে সফল হতে জিপিএ-৫ মুখ্য নয়। একটা পাবলিক পরীক্ষায়ও জিপিএ-৫ না পেয়ে তুমি জীবনে সফল মানুষদের কাতারে নিজের নাম লেখাতে পারবে। তোমার ভেতরে কী আছে, কতটুকু তুমি অর্জন করেছো সেটাই গুরুত্বপূর্ণ এবং দিনশেষে সেটাই তোমাকে সফলতার চূড়ায় নিয়ে যাবে।

কেবল দুই একটা পরীক্ষার রেজাল্ট তোমার জীবন নির্ধারণ করতে পারে না। পৃথিবীতে যারা আজ সফলতার চূড়ায় আরোহণ করেছেন, তাঁদের জীবনী অনুসন্ধান করে দেখো, তাঁদের একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল ব্যর্থতা আর গ্লানিতে পরিপূর্ণ। কিন্তু দিনশেষে তাঁরা সফল।

কেননা তাঁরা ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ছিল নিজের প্রতি প্রচণ্ড বিশ্বাস, ছিল কাজের প্রতি ভালোবাসা, সততা ও নিষ্ঠা। যারা নিজেকে চিনে নিতে পেরেছেন, যাদের রয়েছে নিজের প্রতি প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস, সেই সাথে রয়েছে সততা ও নিষ্ঠা-দিনশেষে তাঁরা সফলতা ছিনিয়ে আনবেই।

তোমার নিজের প্রতি যদি নিজের আত্মবিশ্বাস থাকে, কাজকে যদি তুমি ভালোবাসতে পারো, তোমার নিজের মধ্যে যদি সততা থাকে, তাহলে বিশ্বাস করো পৃথিবীতে তোমাকে আর কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না। দিনশেষে তুমি সফলতার চূড়ায় পৌঁছে যাবেই।

আমার নিজের কথাই বলি, আমার কিন্তু এসএসসি ও এইচএসসি কোনোটাতেই জিপিএ-৫ ছিল না। এ প্লাস পেতে পেতেই পাওয়া হলো না। আমার প্রতি আমার শিক্ষক, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবার আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল আমি অবশ্যই A+ পাবো। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আমার তা জোটেনি। কিন্তু A+ না পাওয়াতে আমার কোনো আক্ষেপ ছিল না, আমি বিন্দুমাত্রও হতাশ হইনি।

পরীক্ষার রেজাল্টের পর আমাকে নিয়ে অনেকেই অনেক বিরূপ মন্তব্য, নেতিবাচক সমালোচনা করেছে। আমি দাঁতে দাঁত চেপে সেসব হজম করেছি। অনেক দিন লুকিয়ে লুকিয়ে বাথরুমে ঢুকে ঝর্ণা ছেড়ে দিয়ে কান্না করেছি। আত্মচিৎকার করেছি গড়িয়ে পড়া পানির সাথে।

তবুও হতাশ হইনি, দমিয়ে যাইনি। বরং হতাশাকে হতাশ করে দিয়ে আমি নিজের সাথে নিজে শপথ করেছি-সফল‌ আমি হবোই। নিজের প্রতি আমার ছিল প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস। আমি নিজেকে চিনে নিয়েছি আসলে আমি কে? কতটুকু যোগ্যতা আমার রয়েছে। আমি জানতাম, আমি পারবোই, আমি সফল হবোই। হ্যাঁ, আমি এখন সফল‌। নিজের একনিষ্ঠ পরিশ্রম, সততা দিয়ে এক এক করে সব স্বপ্ন পূরণ করে নিচ্ছি।

আমার প্রতি যাদের বিশ্বাস ছিল, আশা আকাঙ্ক্ষা ছিল সেসব মানুষদের আমি হতাশ করিনি। কম সিজিপিএ নিয়ে, সমালোচনার তুমুল ঝড় ভেঙে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার মতো স্নায়ুযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মেধাবীকে ডিঙিয়ে, শীর্ষ স্থান দখল করে আমি এখন দেশের স্বায়ত্তশাসিত শীর্ষ একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, শীর্ষ একটা সাবজেক্ট নিয়ে পড়াশোনা করছি।

শুধু একাডেমিক পড়াশোনার গণ্ডিতে আমার জীবন সীমাবদ্ধ নয়। স্কুল জীবন থেকেই আমি একাডেমিক পড়াশোনার বাইরে সব ধরনের এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজে এ দাপিয়ে বেড়িয়েছি। এখনও দাপিয়ে বেড়াচ্ছি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক সংগঠনের সাথে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছি।

লেখালেখি করে যাচ্ছি আপন গতিতে। কখনো সাহিত্য, কখনো সমাজ, কখনো বা দেশকে রাঙিয়ে তুলতে চেষ্টা করি লেখনিতে। দেশের শীর্ষ জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতে আমার লেখা হয় টপ অফ দ্যা কলাম। সম্পাদকরা যখন বলেন, ‘তুমি বেশ ভালো লিখো, লেখার মান খুব ভালো। লেখালেখি চালিয়ে যাও, অনেক বড়ো হতে পারবে।’

এসব শুনে আমি উল্লাসিত হই না, অভিভূত হই। জীবনের স্বার্থকতা এখানেই। এক জীবনে চাইলে মানুষ অনেক কিছু হতে পারে। দরকার শুধু কাজের প্রতি ভালোবাসা, সততা, একনিষ্ঠ পরিশ্রম আর লেগে থাকা।

আমার A+ বিহীন অনেক বন্ধু-বান্ধব এখন দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, ভালো সাবজেক্ট নিয়ে পড়াশোনা করছে। কই A+ এর অভাবে বা A+ না পাওয়াতে তাদের জীবন তো থেমে থাকেনি‌! দেখা গেছে, এমন ভুরি ভুরি A+ পাওয়া শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই কোথাও চান্স পায়নি।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই এসএসসি ও এইচএসসি কোনোটাতেই A+ থাকে না। জীবনে সফলতার চূড়ায় আরোহণ করতে হলে, সফলতার ছোঁয়া পেতে হলে A+ মূখ্য বিষয় নয়। সামান্য দুই এক পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়ে একজন মানুষকে কখনোই বিচার করা যায় না, তার সম্পর্কে ধারণা নেওয়া যায় না। কিন্তু আমাদের অভিভাবকরা মেনে নিতে চায় না এ অমোঘ বাস্তবতা। তাঁরা শিক্ষার্থীদের ওমুক-তমুকের সাথে তুলনা করে, রেজাল্ট নিয়ে মানসিক চাপের মুখে রাখে। ফলে অনেক শিক্ষার্থী ঘুরে দাঁড়ানোর মনোবল হারিয়ে ফেলে। অনেকে জীবনের মায়া হারিয়ে ফেলে চরম হতাশার অন্ধকারে ডুবে থাকে, বেঁছে নেয় আত্মহত্যার মতো জঘন্য পাপের।

আপনি একজন মা/বাবা? আপনার ছেলেমেয়ে তো আপনারই DNA! ওরা সাইন্টিফিক্যালি আপনারই। কিন্তু যখন তাদের বলেন, ‘তোরে দিয়ে কিচ্ছু হবে না!’ অজান্তেই -You are destroying your DNA!

অভিভাবকদের প্রতি অনুরোধ, সামান্য দুই এক পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়ে ছেলেমেয়েদের বিচার করবেন না, তাদের সুযোগ দিন এবং সঠিক পথে পরিচালিত করুন। আপনি বিশ্বাসও করতে পারবেন না- আপনার সন্তানের মাঝে হয়তো লুকিয়ে আছে আইনস্টাইন, নিউটন, শেক্সপিয়ার, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও হুমায়ূন।

কোনো মানুষই অযোগ্য নয়। প্রতিটা মানুষই এক একটা হীরার খনি। দরকার শুধু সে খনি থেকে মনি মুক্তা বের করে আনার। প্রতিটা মানুষই আলাদা বিশেষ গুণে গুণান্বিত। তাই নিজেকে চিনে, নিজের মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করে সততা ও নিষ্ঠার সাথে আপন পথে দৌড়াও। কেউ তোমাকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। সফলতার পর্বত একদিন তুমি ছুঁবেই।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।


চবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়