ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

মানবিক গল্প

রিয়াদের চা বিক্রেতা ভাই

জুবায়ের আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০৯, ১ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
রিয়াদের চা বিক্রেতা ভাই

আমাদের চলার পথে এমন কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়, যাদের সঙ্গে পরিচয় না হলে কোনো ক্ষতি না হলেও পরিচয়ের সুবাদে জীবনে অনেক কিছু শেখা যায়, যা বছরের পর বছর পাঠ্য বই পড়েও শেখা যায় না। শিখতে হয় মানুষের বাস্তব জীবন থেকে, চারপাশে ঘটে যাওয়া ভালো-মন্দ ঘটনা থেকে।

কলেজের পাশে টংয়ের চা দোকানে জমিয়ে আড্ডা দেয় রিয়াদ। এখানে বসেই রাজ্যের সব আলোচনা করে বন্ধুদের নিয়ে। ক্লাস করা ব্যতীত চায়ের দোকানকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল রিয়াদদের কলেজ লাইভ। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান রিয়াদ সমমানের বন্ধুদের নিয়ে সময় কাটানোর জন্য চায়ের দোকানকেই ভালো জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছিল। আর নেবেই না বা কেনো, চা বিক্রেতা ছিল যথেষ্ট আন্তরিক, বাস্তববাদী ও রসিক মানুষ। কাজের মাঝে রিয়াদদের আড্ডায় তিনিও যোগ দিতেন। নিজ সময়ের সুখ-দুঃখের গল্প করতেন।

শহরের পরিবেশে বেড়ে ওঠা রিয়াদ গ্রামে বেড়ে ওঠা চা বিক্রেতা ভাইয়ের মুখেই গ্রামের পরিবেশ, মানুষের জীবনযাপনের মান, দুঃখ-কষ্ট সব শুনতেন। বাবা বড় ব্যবসায়ী হওয়ার কারণে কখনোই অভাব চোখে না দেখা রিয়াদ চা বিক্রেতা ভাইয়ের জীবনের কান্না হাসির গল্প শুনে একজন ভালো স্রোতা হয়ে যান।

চাওয়ালা ভাইয়ের নাম জলিল মিয়া। বাড়ি কুমিল্লায়। পিতার অভাবের সংসারে অনেক ভাইবোনদের একজন হয়ে লেখাপড়া করেছেন মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। তারপর থেকেই চট্টগ্রাম শহরে কাজ করছেন আজ অবধি ৩০ বছর যাবত। স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে চট্টগ্রামেই থাকেন। আগে ছোটখাটো চাকরি করলেও নিজের জমানো টাকা দিয়ে এলাকার ও কলেজের নেতাদের ম্যানেজ করে চায়ের দোকান দিয়েছেন আজ ৫ বছর হলো। সবার সাথে মিশতে পারার অসাধারণ গুণ থাকা জলিল মিয়া সব ছাত্রছাত্রীসহ চা-নাস্তা খেতে আসা সবার প্রিয় হয়ে উঠেন। বাবার বয়সী হলেও সবাই চাওয়ালা ভাই ডাকার কারণে রিয়াদ ও তার বন্ধুরাও চাওয়ালা ভাই বলেই ডাকেন জলিল মিয়াকে।

রিয়াদ আর্টস বা মানবিক বিভাগে পড়ছে। স্কুলজীবনে বন্ধুদের আড্ডা ও অনলাইনে পরে থাকলেও ইতিহাস, ঐতিহ্য বেশ টানে রিয়াদকে। কেউ পুরনো স্মৃতিচারণ এবং ইতিহাস নিয়ে বললেই বাধ্য স্রোতার মতো শুনে রিয়াদ। খেলাধুলা ও বন্ধুদের আড্ডায় মেতে থাকা রিয়াদ কলেজজীবন শুরু করে চাওয়ালা ভাইয়ের সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই মুগ্ধ হয়ে গেছেন। কলেজের সময় ছাড়াও অবসরে আড্ডা দিতে চলে আসেন চায়ের দোকানে। কলেজ লাইফে যার তার সাথে মেলামেশা করে পড়ার ক্ষতি করা ঠিক নয় এবং বাস্তবতাকে মূল্যায়ন করতে বলে চাওয়ালা ভাই। রিয়াদও মুগ্ধতার সাথে সব মেনে নেয়।

বাবার অঢেল সম্পদের মাঝে সোনার চামচ মুখে নিয়ে বড় হওয়া রিয়াদ কখনো অভাব না দেখলেও চাওয়ালা ভাইয়ের জীবন কাহিনী এবং সাধারণ মানুষের দুঃখ কষ্ট, নিম্নমানের জীবনযাপনের গল্প শুনে নিজের চেনা জগতের বাইরেও আরেকটি জগত আছে, আবিষ্কার করে রিয়াদ। যে জগতের মানুষরা রিয়াদদের মতো ঐশ্বর্যবান নয়। তাদের দৈনন্দিন খাবার জোগাড় ও সন্তানদের লেখাপড়া করানোর খরচ যোগাতে হিমশিম খেতে হয়।

কলেজ লাইফের প্রথম বছরটি আনন্দঘন পরিবেশে কাটলেও করোনা হানা দেওয়ায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার ফলে রিয়াদদের আড্ডাও বন্ধ হয়ে যায়। বাসায় বন্দিজীবনের অবসরে রিয়াদের শুধু মনে পড়ে চাওয়ালা ভাইয়ের কথাগুলো। করোনাকালে সাধারণ মানুষজনের খাদ্য অধিকার অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় রিয়াদ চাওয়ালা ভাই ও সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা অনুভব করে। চাওয়ালা ভাইতো সব সময় গরীব, অসহায় মানুষজনের কথাই বলতো। করোনাকালে রিয়াদ তা ভালোভাবেই উপলব্ধি করে।

রিয়াদের বাবাও দরিদ্র মানুষের জন্য সহযোগিতা করে। রিয়াদ চাওয়ালা ভাইকে ফোন করে খবর নেয়, প্রথমে ইতস্তর করলেও তিনি জানান, ছেলের অসুখের জন্য কিছু দিন আগে সঞ্চিত সব টাকা খরচ হয়ে গেছে। চলতে কষ্ট হচ্ছে তাদের। সরকার থেকে কোনো সহায়তা পাননি, এলাকার বিত্তশালীদের সহায়তা তাদের জন্য পর্যাপ্ত হচ্ছে না। রিয়াদ চাওয়ালা ভাইকে পূর্ণ সহায়তার আশ্বাস দেয়।

বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে রিয়াদ। রিয়াদ তাদের জানান, আমার জীবনে  বাবা-মায়ের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি হলেও কলেজে পা রাখার পর এমন একজনকে পেয়েছি আমি, যার মাধ্যমে জীবনের মানে শিখেছি। দরিদ্র একজন মানুষের কথাবার্তা, জীবন দর্শন আমাকে নতুন পৃথিবীর সন্ধান দিয়েছে। যেখানে শুধু প্রাচুর্যই শেষ কথা নয়। আনন্দ, উল্লাসে সময় পার করে দেওয়ার নামই জীবন নয়, মানুষের দুঃখে দুঃখী হওয়া, মানুষের পাশে দাঁড়ানো, সবার সাথে মিলেমিশে চলার মানসিকতা তৈরি হয়েছে আমার। এমন মানুষটা কিন্তু অনেক শিক্ষিত, বিত্তশালী কেউ নয়, তিনি আমাদের কলেজের পাশের চা বিক্রেতা ভাই। আজ গৃহবন্দি হয়ে তিনি অনেক কষ্টে জীবনযাপন করছেন। আমরা তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই আব্বু।

রিয়াদের বাবা আশরাফ আলী মুগ্ধ হয় ছেলের কথা শুনে। যে ছেলে শুধুই বন্ধুদের আড্ডা আর অনলাইনে পড়ে থাকতো, সে যে মানুষের সাথে কথা বলে এত কিছু জেনেছে, বুঝেছে, শিখেছে, সে মানুষের জন্য অবশ্যই কিছু করবো আমি। যতদিন চাওয়ালা ভাইয়ের দোকান বন্ধ থাকবে, তত দিন তার পরিবারের সব খরচ দেবে রিয়াদের বাবা। রিয়াদকে তা জানিয়ে দেয়। বাবার সিদ্ধান্তে খুশি হয় রিয়াদ। ফোন করে সাথে সাথেই জানিয়ে দেয় চাওয়ালা ভাইকে। মানুষের বিপদে তার পাশে দাঁড়ানোর চেয়ে ভালো কাজ আর কিছুতেই হতে পারে না ভেবে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে রিয়াদ।

লেখক: শিক্ষার্থী, ডিপ্লোমা ইন জার্নালিজম, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম অ্যান্ড ইলেকট্রনিক মিডিয়া (বিজেম)।


বিজেম/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়