‘জিপিএ-৫ মেধার মাপকাঠি নয়’
জাহিদুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম
শিক্ষা, দুই অক্ষরের একটি ছোট শব্দ হলেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য তো এর গুরুত্ব আরও বেশি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের কটুক্তি শুধু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেই ইঙ্গিত করেনি, দেশের ক্রমবর্ধমান সমস্যাগুলোকেও ইঙ্গিত করেছিল। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষারও যে প্রভূত উন্নয়ন ঘটাতে হবে, তা সরকার কিন্তু ঠিকই বুঝেছিল।
কুদরত-এ-খোদা শিক্ষা কমিশন থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটি কমিশনের পর বর্তমান কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী চলছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। সরকারের পাশাপাশি অভিভাবকেরাও এই বিষয়টা ভালোভাবেই বোঝেন। তাই তো সরকার কর্তৃক ঠিক করা প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন তাদের শিশু সন্তানকে। হিসেব করলে দেখা যাবে, তাদের অধিকাংশেরই বয়স পাঁচ থেকে ছয়। যে বয়সে একটি শিশু মাঠে দৌড়াবে, খেলবে; সে বয়সে একটি শিশু ঘুম থেকে উঠে বগলদাবা করে বই নিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে যাচ্ছে স্কুলে।
শহরে তো এ দৃশ্য আরও ভয়াবহ। স্কুলে যাচ্ছে স্কুলভ্যানে করে আবার বাসায় ফিরেই প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে বসতে হচ্ছে বই নিয়ে। সারাদিন সে কিন্তু একটুখানি খেলাধুলা করার ফুরসতও পেলো না। তার উপরে পর্যাপ্ত চিত্তবিনোদনের ঘাটতি তো রয়েছেই। এভাবেই পাঁচ বছর বয়সেই একটি কোমলমতি শিশু নিজেকে বিলিয়ে দেয় একটি প্রতিযোগিতার মধ্যে।
পঞ্চম শ্রেণিতে উঠে আবার অংশগ্রহণ করতে হয় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী নামক জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষায়। ভাবা যায়! প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী উপলক্ষে একটি পরীক্ষা। ধীরে ধীরে শিশুটি কৈশোরে অবতীর্ণ হয় আর অষ্টম শ্রেণিতে অংশগ্রহণ করতে হয় আরেকটি পাবলিক পরীক্ষায়। দুইটি পাবলিক পরীক্ষারই গ্রেডিং কিন্তু আলাদা। যে বয়সে সে মাঠে ফুটবলে কিক করে বিপক্ষের গোল বারে বল ফেলার অঙ্ক করার কথা, সে বয়সে ঐ কিশোরটি গ্রেডিং সিস্টেমের প্যাঁচে পড়ে কুঁজো হয়ে যাওয়া থেকে বেঁচে উঠতে পারছে না।
জিপিএ-পাঁচ নামক সোনার হরিণের চিন্তার বীজ তাদের মাথায় কে গেঁথে দিচ্ছে? অবশ্যই তার অভিভাবক। দুইটি পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলেও সে এখনো গ্রেডিং সিস্টেমটাই ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেনি। অষ্টম শ্রেণি পাস করেই নবম শ্রেণিতে পা ফেলার আগে তাকে বাছাই করে নিতে হয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত। মূলত এই সিদ্ধান্ত তার নিকটেই থাকে না। থাকে তার অভিভাবকের হাতে। একটি ছেলে হয়তোবা ব্যবসায় শিক্ষা নিয়ে পড়াশোনা করতে চেয়েছিলো, কিন্তু তার বাবা-মা তাকে আর দশটা বাবা-মার মতোই ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চায়। এভাবেই অঙ্কুরে বিনাশ ঘটে একটি সুপ্ত সম্ভাবনার। মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায়ও রয়েছে জিপিএ-পাঁচের সেই গ্যাঁড়াকল।
পাশের বাসার মেয়ে গোল্ডেন জিপিএ-পাঁচ পেয়েছে কিংবা ক্লাসের সেকেন্ড বয় বোর্ডে স্ট্যান্ড করেছে; নিজের ছেলে কেন পেলো না জিপিএ পাঁচ কিংবা ক্লাসে ফার্স্ট বয় হওয়া সত্ত্বেও কেন বোর্ডে স্ট্যান্ড করতে পারলো না, তা নিয়ে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের উপর চালায় এক দারুণ মানসিক নির্যাতন। চারপাশের লোকজনের হাসি-তামাশা, আত্মীয়-স্বজনদের তিতকুটে কথা তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে একটা জিপিএ-পাঁচ না পাওয়া ছেলে বা মেয়ের সামনে পরিবেশটা হয়ে উঠে ভারী আর অন্ধকার।
সদ্য কৈশোর পেরোনো একটা ছেলে বা মেয়ে এই পরিবেশটা খুব একটা ভালোভাবে নিতে পারে না। চলে যায় হতাশায়। বেছে নেয় নেশার নানা পদ্ধতি কিংবা হঠাৎ করেই আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে। বিগত কয়েক বছরের রেজাল্ট পরবর্তী সময়টা একটু পর্যবেক্ষণ করলেই হবে। তাকে এই আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিলো কে? অবশ্যই তার অভিভাবক। মাধ্যমিকের গণ্ডি পাড়ি দেওয়া ষোল বছরের একটা ছেলে বা মেয়েকে আমরা অভিভাবকরা বুঝতে পারি না। কখনো জানতেই চাই না কিসে তার আগ্রহ কিংবা কী তার ভালো লাগে। তার সামনে আরও পথ ছিল, কিন্তু সেগুলো দেখার সময়ও পেলো না ঐ ছেলেটা। নিজের পছন্দ অনুযায়ী পথে চললে ছেলেটা হতে পারতো নতুন একজন জয়নুল আবেদীন, হতে পারতো নতুন একজন সত্যজিৎ রায়, হতে পারতো নতুন একজন জগদীশচন্দ্র বসু। যে ছেলেটা জিপিএ-পাঁচ পেয়েছে, সে হয়তো বা জীববিজ্ঞানের গভীর তত্ত্বগুলো বোঝে না, কিন্তু যে ছেলেটা অল্পের জন্য জিপিএ-পাঁচ পায়নি সে এই তত্ত্বগুলো বোঝে। সুতরাং কার কোথায় প্রতিভা তা তার পরীক্ষার খাতার জিপিএ দিয়ে নির্ধারণ করা যাবে না। জিপিএ-পাঁচ মানেই চূড়ান্ত ফলাফল নয়, জিপিএ-পাঁচ মানেই ভালো ছাত্র বা ছাত্রীর পরিচয় নয়। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। এই সম্ভাবনাময় কুঁড়িগুলোকে কঠিন পরীক্ষার দিকে ঠেলে না দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
শিক্ষক, অভিভাবক সবাইকে বুঝতে হবে জিপিএ-পাঁচ মানেই সবকিছু নয়। এর বাইরেও একটি ছেলে বা মেয়ে নিজেকে তোলে ধরতে পারে। এই সম্ভাবনাময় ছেলে বা মেয়েগুলোকে পরিচর্যা করে দেশ ও দশের সম্পদে পরিণত করার দায়িত্ব শিক্ষক, অভিভাবক, সরকার ও আমাদের সবার।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
নোবিপ্রবি/হাকিম মাহি
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন