ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘পরীক্ষার্থী নয়, শিক্ষার্থী তৈরি করুন’

হাছিবুল বাসার মানিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৩, ২ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
‘পরীক্ষার্থী নয়, শিক্ষার্থী তৈরি করুন’

শিক্ষার বিষয়টা শুধু পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া কিংবা সার্টিফিকেট অর্জন করা নয়। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো ভালো মানুষ তৈরি করা, শেখার মধ্য দিয়ে কোনো বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করা, যেকোনো সমস্যাকে মোকাবিলা করা ও গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতা অর্জন, মানবিকতা, মূল্যবোধ, দেশপ্রেম—সবকিছুই শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। এমনকি কমিউনিকেশন স্কিলের মতো বিভিন্ন সফট স্কিল ও হার্ড স্কিলও শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

কিন্তু এখন আমরা দেখতে পাই, আমাদের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা কেবল ভালো ফলাফল বা জিপিএ-৫ কেন্দ্রিক প্রতিযোগিতার দিকেই ধাবিত হচ্ছেন। মানবিক গুণাবলি ও দক্ষতা অর্জনের বিষয়টি গৌণ হয়ে পড়েছে। আমরা বিভিন্ন উন্নত দেশের চেয়ে আর্থসামাজিক দিক দিয়ে কিছুটা পিছিয়ে আছি, ফলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা হয়তো মনে করেন, ভালো ফলাফল করলে দেশের বাইরে চলে যাওয়া যাবে। এ কারণে তারা ভালো জিপিএ অর্জন করতে আগ্রহী হয়ে থাকেন।

বর্তমানে শিক্ষকতাকে শুধু চাকরি ভেবে অনেকে নির্দিষ্ট বিষয় পড়ানোর বাইরে বাড়তি কিছুতে মনোযোগ দিতে চান না। তবে মানের দিক দিয়ে আমাদের শিক্ষকদের ঘাটতি আছে বলে আমি মনে করি না, কারণ প্রাথমিকেও এখন অসংখ্য মাস্টার্স ডিগ্রিধারী শিক্ষক আছেন, যেমনটা আগে ছিল না। হাইস্কুল ও কলেজ পর্যায়ে তো উচ্চশিক্ষিত শিক্ষক আছেনই। এই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে ভিন্নতা আনা যেতে পারে, শিক্ষার্থীদের গুণগত শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে তাদের আরও উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন বলে মনে করি। সম্প্রতি যে শিক্ষার্থীরা এসএসসি পাস করল, তাদের বলব, শুধু জিপিএ-৫ এবং ভালো কলেজে ভর্তির পেছনে না দৌড়ে এখন থেকেই মনে দেশপ্রেম ধারণ করে মেধাবী ও মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে হবে।

কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘মুখস্থ করে পরীক্ষা দেওয়া আর নকল করে পরীক্ষা দেওয়া একই কথা’। কিন্তু এখনকার জিপিএ-৫ নির্ভর প্রতিযোগিতামূলক পড়ালেখার যে প্রচলন রয়েছে, তাতে শিক্ষার্থীরা যে বিদ্যার্থী, তা থেকে বের হয়ে কেবল পরীক্ষার্থী হয়ে গেছে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা কেবল জিপিএ-৫ নিয়েই মাথা ঘামাচ্ছেন। পুঁথিগত পড়াশোনা ছাড়াও সামগ্রিক জ্ঞান অর্জন করার শিক্ষা গুরুত্ব পাচ্ছে না। পড়াশোনার উদ্দেশ্য যে কেবল সার্টিফিকেট অর্জন নয়, প্রকৃত বিদ্যা অর্জন, সেই সংস্কৃতি থেকে আমরা বের হয়ে গেছি।

পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়া এবং ভালো জিপিএর ঘরে যাওয়ার জন্য শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা ইঁদুর দৌড়ে ব্যস্ত। অভিভাবকেরা মনে করেন, জিপিএ-৫ না পেলে সন্তানের জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে। এই তীব্র চাপের আরেক ভয়াবহ উদাহরণ হলো, আজকাল সন্তানের ভালো জিপিএ পাওয়ার ব্যবস্থা করতে অভিভাবকেরা পর্যন্ত প্রশ্ন ফাঁস হলো কি না খোঁজ রাখেন। বিভিন্নভাবে তারা প্রশ্ন খোঁজে, পরে তা সন্তানের হাতে তুলে দেয়। এটি শিক্ষার্থীর মননকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।

আগে যারা শিক্ষকতায় আসতেন, তাঁরা শিক্ষকতাকে মহান ব্রত ভাবতেন। অথচ অনেকে এখন শিক্ষকতাকে স্রেফ অন্য পাঁচটা চাকরির মতো ভাবেন। আগেকার শিক্ষার্থীদের পড়ার ধরনের সঙ্গে এখনকার শিক্ষার্থীদের পার্থক্য অনেক। শিক্ষার মান নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠলেও সূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়া সহজ কোনো উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে এখন আগের মতো ভর্তিযুদ্ধ নেই। যেহেতু পুরো বিষয়টা অনলাইনে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, তাই একজন শিক্ষার্থী চাইলেই যেকোনো কলেজে ভর্তি হতে পারে না, তাকে বেশকিছু অপশন মাথায় রাখতে হয়। তবে নির্দিষ্ট কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি ঝোঁক সবসময়ই লক্ষ করা যায়।

মনে রাখা দরকার, সচরাচর যেগুলোকে ভালো প্রতিষ্ঠান বলা হয়, তারা দীর্ঘদিন ধরে নিয়মশৃঙ্খলা, পাঠদানে ভিন্নতা ও ভালো ফলাফলের কারণে সুনাম অর্জন করেছে বলেই সেগুলোকে আমরা ভালো বলছি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, একজন শিক্ষার্থী যদি পরিশ্রমী হয়, আন্তরিকতার সঙ্গে পড়াশোনা করে, তবে তার পক্ষে যেকোনো প্রতিষ্ঠান থেকেই ভালো করা সম্ভব। প্রতিবছরই প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে আসা শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হওয়াসহ নানাবিধ সাফল্যের কথা শুনতে পাই আমরা। কাজেই জিপিএ-৫ এবং ভালো প্রতিষ্ঠানের নামের পেছনে না ছুটে আমাদেরকে লক্ষ্য স্থির করে প্রকৃত শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনে মনোযোগ দিতে হবে।

মানবসম্পদ ও মেধাবী প্রজন্ম হিসেবে গড়ে ওঠার যাত্রায় ফলাফল ও প্রতিষ্ঠানের দিক দিয়ে জেতার চেয়ে শেখাটা অনেক বেশি জরুরি। শিক্ষার্থীদের শুধু পুঁথিগত শিক্ষায় আবদ্ধ করে রাখলে তাদের মধ্যে সৃষ্টিশীলতার বিকাশ ঘটবে না। তাদের বাস্তবতা থেকে শিক্ষা নিতে সহায়ক পরিবেশ দিতে হবে। পূর্ণ জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই যথেষ্ট নয়। জিপিএ-৫ পাওয়া মানেই শুধু মেধাবী নয়। শুধু মুখস্থ বিদ্যা নয়, সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল হতে হবে।

একমাত্র মেধাবীরাই পারে তাদের মেধা আর মননকে কাজে লাগিয়ে দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। অভিভাবকরা কিংবা শিক্ষকরা শুধু জিপিএ-৫ বা প্রথমের পেছনে না ছুটে যদি তাদের সন্তানরা বা শিক্ষার্থীরা কী শিখল, কতটুকু শিখল, কি কি ঘাটতি আছে, কতটুকু শিখানো দরকার- এই বিষয়ে গুরুত্ব দেন, তাহলে সেই সন্তান প্রকৃত দক্ষতা অর্জনে সক্ষম হবে। তাই আসুন আমরা শিশুদের দিয়ে জিপিএ-৫ পাওয়া বা প্রথম হওয়ার প্রতিযোগিতায় না গিয়ে তাদের প্রকৃত মানুষ বানানোর ব্রতে মনোনিবেশ করি, তাতেই সমাজ তথা দেশের মঙ্গল হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


ঢাবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়