ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

কাল্পনিক গল্প

জীবন গাঙের নাইয়া

জুবায়ের আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ৭ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
জীবন গাঙের নাইয়া

ছবি: সৈকত, ছবি সংগ্রাহক: হিমেল

‘জীবন গাঙের তরী বাইয়া তোমায় নিয়ে যেতে চাই ওই পারে বন্ধু ওই পারে’। দূর কোথাও থেকে সুমধুর কণ্ঠে গাওয়া এমন একটি গান ভেসে আসছে। দুজনে গানটি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছেন আর ভেলা বেয়ে ইহকালের নদী পার হচ্ছেন।    

ভেলার পেছনে বসে থাকা কাসেম আলী জীবনযুদ্ধে প্রতিনিয়ত লড়াই করে টিকে থাকা একজন সৈনিক। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলে গেলেও বাবার সঙ্গে কাজে লেগে যান তারপর থেকেই। কাজের সূত্রে পাশের গ্রামে গিয়ে পরিচয় হয় আমেনা বানুর সঙ্গে। দীর্ঘ পাঁচ বছরের চেনাজানা ও প্রেমের পর বউ করে ঘরে তুলেন পছন্দের মানুষকে।

তখনকার সময়ে কাউকে পছন্দ করে বিয়ে করা কঠিন হলেও কাসেম আলীদের মতোই দরিদ্র ঘরের সন্তান আমেনা বানুকে পরিবারের সম্মতিতেই জীবন সঙ্গিনী করতে কোনো সমস্যা হয়নি।

বিয়ের আগে থেকেই অন্যের জমিতে কৃষি কাজ ও মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা কাসেম আলী আমেনাকে অনেক ভালোবাসতেন। তাই শহরে গিয়ে কাজের সন্ধানের জন্য বাবা পরামর্শ দিলেও মাছ ধরার নেশা ও বাড়িতেই থেকে কাজ করবে জানিয়ে প্রিয়তমা স্ত্রী ও মা-বাবার কাছেই থাকেন কাসেম।

পৈত্রিক সূত্রে শুধু বসতবাড়ি পাওয়া কাসেম আলীর আর কোনো সম্পত্তি বা সঞ্চয়ও নেই। বর্ষাকালসহ যতদিন সম্ভব হয় জাল, বরশি ও চল দিয়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। অন্য সময়ে মানুষের জমিতে কৃষি কাজ করেন।

স্ত্রী আমেনা বানুর সঙ্গে দাম্পত্যজীবন শুরুর পর দুইটি সন্তান গর্ভেই নষ্ট হয়। বিয়ের ৬ বছর শেষে পরপর দুই বছর দুটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয় আমেনা বানু। আমেনা বানু বিয়ের পর থেকে কাসেম আলীর সংসারের অভাব অনটন থাকলেও নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন। ভলোবাসার মানুষের অর্ধাঙ্গীনি হয়ে আছেন সুখে-দুঃখে। দুই সন্তানকে অনেক কষ্টে লালন পালন করেছেন। দুই কন্যার পর পুনরায় একটি ছেলে হলেও জন্মের সাথে সাথেই মৃত্যুবরণ করে। তারপর আর সন্তান হয়নি তাদের।

কাসেম আলী অনেক কষ্ট করে নিজের সামান্য জমানো টাকা আর প্রতিবেশীদের সহায়তায় কন্যাদের বিয়ে দিয়েছেন। স্বামীর গৃহে দুই কন্যাও তেমন ভালো নেই। বিয়ে দেওয়ার পর দুই মেয়ের জামাই যৌতুকের জন্য মারধর করতো তাদের। মেয়েরা বাবার সামান্য আয় ও অভাব-অনটন দেখে অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করেও স্বামীর সংসার করছেন।

সন্তানদের সুখের জন্য কিছু করতে চাওয়ার তাগিদে আমেনা বানুর সঙ্গে কথা বলেন কাসেম। আমেনা বানুকে বলেন, ছোটবেলা থেকেই কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে সংসার পরিচালনা করতেছি। বাপ-মা মারা যাওয়ার পর নিজের সংসারের ভাগ্যও পরিবর্তন করতে পারি নাই। আমার দুই মেয়ে স্বামী সংসারে টাকার জন্য নির্যাতিত হবে তা হইতে পারে না। আমি সিদ্ধান্ত নিছি আমাদের থাকার লাইগা দুই শতক জায়গা রাইখা বাড়িটা বেইচা দুই কন্যাকে সমান ভাগে দিয়ে দিমু। তুমি অমত কইরো না আমেনা।

আমেনা চোখের পানি ছেড়ে দেয়। শ্বশুড়ের ভিটা বিক্রি করতে হবে মেয়ের জামাইদের চাহিদার জন্য, ভাবতেও পারে না আমেনা বানু। তাছাড়া বাবা মায়ের মৃত্যুর পর এমনিতেও দুই বোনই পাবে বাড়িটা। কিন্তু দুজনের জীবদ্দশায় বাড়ি বিক্রি করতে হবে ভাবতেই কেমন জানি লাগছে আমেনা বানুর।

আমেনা বানু সম্মতি জানান, বিয়ের পর থাইকা আপনার সুখ-দুঃখের সাথি হইয়া আছি। এতো অভাব অনটনের মাঝেও কখনো ধৈর্য্যহারা হই নাই। আমাদের দুই মেয়ের সুখের জন্য এই ত্যাগটুকু আমরা কইলাম। আমেনা বানুর কথায় খুশি হয় কাসেম আলী।

পাশের বাড়ির প্রবাসী জমির আলীকে সব খুলে বলে কাসেম আলী। জমির আলী রাজি হয়। দুই শতক জায়গা রেখে আট শতক চার লাখ টাকায় বিক্রি করে দুই সন্তানকে দিয়ে দেয় কাসেম আলী। দুই মেয়ে বাবা-মায়ের কাণ্ড দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কাসেম আলী মেয়েদের বুঝায়, এই বাড়ি এমনিতেই তোদের হইতো। তোদের প্রয়োজনে না হয় আগেই দিয়া দিলাম। স্বামীর সংসারে থাকলেও বাবা-মায়ের খোঁজ-খবর রাখিস, অসহায়ের মতো বলেন কাসেম আলী। দুই মেয়ে বাবা-মাকে জড়িয়ে আহাজারি শুরু করেন।

বাড়ি বিক্রির টাকা পেয়ে দুই মেয়ের স্বামীই আর কখনো সংসারে অশান্তি করেনি। দুজনেই বাজারে ছোটখাটো ব্যবসায় ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে লড়ছেন। তাদের সংসারও ততটা সচ্ছল নয়।

কাসেম আলী নিজের ছোট ঘর নিজের জন্য রাখা দুই শতক জায়গার মধ্যে পুনঃনির্মাণ করেন। জমির আলীকে বুঝিয়ে দেয় বিক্রি করা জায়গা। দীর্ঘ ৩০ বছরের দাম্পত্য জীবনে আবারও যেন নতুন যুদ্ধে লিপ্ত হয় কাসেম আলী ও আমেনা বানু। এত দিন নিজ বাড়িতে প্রয়োজনীয় গাছগাছাড়ি ও সবজি করে খেতে পারলেও এখন সবকিছুই কিনে খেতে হবে।

মেয়ের জামাইদের চাহিদা মেটানো, মেয়েদের সুখের জন্য কিছু করতে পারার আনন্দের মাঝেও নিজ জীবদ্দশায় পৈত্রিক ভিটা বিক্রি করতে হওয়ায় হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলেন কাসেম আলী। কাসেম আলী ও আমেনা বানুর সামান্য আয়ে কোনো রকম চলে যায়। মেয়েরা মাঝে মাঝে এসে বাবা-মাকে দেখে যায়। বাড়ি বিক্রির পর কেটে যায় আরও দশ বছর।

কাসেম আলী ও আমেনা বানু দুজনেই বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। কথায় আছে, অতিরিক্ত সুখ আর সম্পদের মাঝে মানুষের বয়স বোঝা যায় না। চেহারায়ও বয়সের ছাপ পড়ে না, আর অভাব-অনটনের সাথে জীবনযাপন করা লোকজন অন্যদের চেয়ে আট-দশ বছর আগেই বৃদ্ধ হয়ে যায়। কাসেম আলী ও আমেনা বানুর বেলায়ও তাই হয়েছে।

বর্ষাকাল চলছে, কাসেম আলী মধ্যরাত পর্যন্ত মাছ ধরেন। একটা নৌকা ছিল অনেক বছর। কিন্তু নৌকাটা চুরি হয়ে গেছে দুই বছর হয়। আর কিনতে পারেননি। তাই বর্ষাকালে মাছ ধরা এবং বাজারে যাতায়াতেট জন্য কলাগাছ দিয়ে তৈরি ভেলা দিয়েই কাসেম আলী চলাফেরা করেন। কখনো কখনো আমেনা বানুও সঙ্গী হন। স্বামীকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন আমেনা। মাছ ধরার সময়েও কাসেম আলীর সঙ্গী হন মাঝে মাঝে। কাসেম আলী মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় একা ছাড়তে চায় না সে।

সারা দেশেই খাল, বিল, নদী-নালা ভরাটের মাধ্যমে ঘর বাড়ি ও শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। অনেক এলাকায় বর্ষাকালে ঠিকমতো পানিও হয় না। তাই এখন আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। তবুও বর্ষায় পেট চালানোর মাধ্যম এবং নেশা থেকে মাছ ধরার চেষ্টা করতেই হয়। জাল, বড়শি ও চল দিয়ে দেশীয় সব মাছ শিকার করেন কাসেম আলী। ঘরে খাবারের মাছ রেখে বিক্রিও করতে পারেন কিছু। তা দিয়েই চলে দুজনের সংসার।

মাছ ধরতে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে শরীরে জ্বর চলে আসে কাসেম আলীর। পাশের বাড়ির এক ছেলেকে দিয়ে বাজার থেকে ঔষুধ আনায় আমেনা বানু। কাসেম আলীকে ঔষুধ খাইয়ে দিয়ে ভেজা কাপড় দিয়ে বারবার কপাল মুছে দেন। কাসেম বলেন, বুঝলা আমেনা, বুড়া হইয়া গেলে বউ আর জামাই ছাড়া কেউ পাশে থাকে না। আমার তো কোনো পোলা নাই, তাই আমরা একলা। পোলা থাকলেও যে বুড়া কালে আমাদের দেখভাল করতো তা কোনো গ্যারান্টি নাই। কতজনরেই তো দেখি দুই-তিন পোলা থাকার পরও বাবা মায়ের খোঁজ নেয় না তেমন, কাজ করে খাইতে হয়।

আমেনা বানু বলেন, আল্লাহ আমাদের একটা পোলা দিয়াও নিয়া গেছে। সে বাঁইচা থাকলে আজ কত বড় হইতো, বিয়ে করাইতাম, নাতি-নাতনি থাকতো। হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলেন আমেনা বানু।

এখন সত্তরোর্ধ্ব কাসেম আলী অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর ভাবনা চলে আসে মনে। আমেনা বেগমকে বলেন, বিয়ার পর থাইকা তোমারে ছাড়া কোনো দিন থাকি নাই, যেখানেই গেছি তোমারে সাথে নিয়া গেছি। আজ দীর্ঘ ৪০ বছরের বেশি সময়ের সংসার জীবনে এই প্রথম মনে হইছে তোমার পাশে আর থাকতে পারতাম না, আমারে তুমি মাফ কইরা দিও আমেনা। স্রষ্টার ডাকে সাড়া দেওয়ার সময় হইয়া গেছে।

আপনি এমন অলক্ষুণে কথা কইয়েন নাতো, আপনি আমারে ছাইড়া গেলে আমি থাকমু কেমনে। আপনি সুস্থ হইয়া যাইবেন, চিন্তা কইরেন না, বলেন আমিনা।

সারাশরীরে বার্ধক্য জেঁকে বসা কাসেম আলী আর সুস্থ হয় না। দিন দিন অবস্থার অবণতি হতে থাকে। মেয়েদের খবর দেয় আমেনা বানু। কিন্তু মেয়েরা আসার আগেই না ফেরার দেশে পারি জমায় কাসেম আলী। আমেনা বানুর আহাজারিতে প্রতিবেশীরা জড়ো হয়।

আপনার সাথে আজ এতটা বছর সুঃখে কাটাইলাম, আর আপনি আজ আমারে রাইখা চইলা গেলেন। আমারে নিয়া যাইতে পারেন নাই। আমেনা বানুর ডাকে আর সাড়া দেয় না কাসেম আলী।

দুই মেয়ে জামাইদের নিয়ে আসেন। সবার কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে কাসেম আলীর বাড়ির পরিবেশ। যথারীতি ধর্মীয় বিধান মতে গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয় কাসেম আলীকে। সেই ১৬ বছর বয়সে কাসেম আলীর অর্ধাঙ্গিনী হওয়া আমেনা বানু কিছুতেই মানতে পারছে না। কাসেম আলীর মৃত্যুর দিন থেকেই অসুস্থ হয়ে যান আমেনা বানুও। ডাক্তার এনেও কোনো কাজ হয় না। কথা বন্ধ হয়ে যায় আমেনা বানুর এবং পরদিন দুপুরে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে চলে যান দীর্ঘ দিনের সঙ্গীর পাশে।

কী অদ্ভুত বিধাতার খেলা। ৪৫ বছরের দাম্পত্য জীবনে সুঃখে-দুঃখে প্রতিটি মুহূর্তে কাসেম আলীর পাশে থাকা আমেনা বানু পরম প্রিয় পতিকে ছাড়া একদিনও আলাদা থাকতে পারেননি।

কাসেম আলীর কবরের পাশেই সমাহিত করা হয় আমেনা বানুকে। গ্রামের মানুষও বলছে, এত ভালোবাসা নিয়ে দাম্পত্যজীবন পরিচালনা করা আর কাউকে দেখিনি, সামান্য ঝগড়াও হতো না দুজনের মাঝে। একে-অপরকে মূল্যায়ণ করে মিশে যেতেন একে-অপরের মতামত ও ভাবনার সাথে।

অভাবে চললেও কাউকে তা মুখ ফুটে বললেনি। ভরা যৌবনে যেমন তেমন, বার্ধক্যে পতিত হওয়ার পরও দুজনের ভালোবাসা দেখে পাড়ার ছেলেমেয়েরা লাইলি-মজনু বলে ডাকতো তাদের। আজ সবাইকে কাঁদিয়ে কাসেম আলী ও আমেনা বানু পরপারে অনন্তকাল পাশে থাকার বন্দোবস্ত করে নিয়েছেন।

লেখক: শিক্ষার্থী, ডিপ্লোমা ইন জার্নালিজম, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম অ্যান্ড ইলেকট্রনিক মিডিয়া (বিজেম)।

 

বিজেম/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়