ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

‘অনলাইন বন্ধুত্বের জায়গা দখল করেছে’

ধীরা ঢালী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০৪, ৭ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
‘অনলাইন বন্ধুত্বের জায়গা দখল করেছে’

করোনার কারণে গত ১৭ মার্চ থেকে নিজেকে ঘরে বন্দি রেখেছি। ২৪ মার্চ যখন দ্বিতীয় দফায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটির মেয়াদ ৯ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হলো, তখন মনে হলো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। তাই ভাবলাম, গ্রামের বাড়ি খুলনায় যাওয়া উচিৎ।

তখনই বাসা থেকে বের হলাম, টিকিট কাটলাম। আর সেই রাতেই খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ২৫ মার্চ সকালে খুলনায় নিজের বাড়িতে মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনের কাছে পৌঁছালাম।

জাহাঙ্গীরনগর থাকতে ১৬ মার্চ থেকে মামা বারবার বলতো, সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার জন্য। বাইরে গেলে মাস্ক, গ্লাভস আর স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে তাড়া দিত। এই পদ্ধতি খুলনায় এসেও চলতে থাকলো। সবকিছু নিয়ম করে করছি, কিন্তু মনের ভেতর সারাক্ষণ অস্থিরতা চলছে।

মামা-মামী ঢাকায় আছেন। আর কমবেশি সবাই গ্রামে চলে আসছেন। সারাক্ষণ তাদের জন্য দুশ্চিন্তা হয়। দুশ্চিন্তা হয় আমার সহপাঠী, শিক্ষকদের জন্য আর আমার প্রিয় ক্যাম্পাস সংগঠন গবিসাস পরিবারের জন্য।

দিনের পর দিন চার দেয়ালের মধ্যে থাকতে থাকতে আমার দৈনন্দিন জীবনের রুটিনও উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে। সব নিয়ম-শৃঙ্খলা যেন চুকে গেছে। সেই সঙ্গে দুশ্চিন্তার মাত্রা দিনে দিনে বাড়ছে ভাইরাস আক্রান্ত পৃথিবীর গল্প শুনে। মাঝেমধ্যে আত্মীয়-স্বজন, ভাইবোন আর বন্ধুদের সঙ্গে কথা হয়। তখন একটু হালকা লাগে।

বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবাই ঘরবন্দি জীবনযাপন করছে। অনলাইনের সাথে আমার পরিচয় খুব বেশি নয়। কিন্তু অনলাইন এখন আমার বন্ধুত্বের জায়গা দখল করে নিয়েছে। সারাক্ষণ অনলাইনে আপডেট দেখি, আর দুশ্চিন্তার ঘোরে হারিয়ে যাই। চিন্তাকরি, আর কত দিন ঘরবন্দি থাকতে হবে কে জানে! এ যেন সারাবিশ্বে লকডাউনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে!

প্রায়ই ফোনে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা হয়। সবাইকে আশাবাদী হতে বলি, মনকে ইতিবাচক রাখতে বলি। তবে নিজের মনকে যেন বিষণ্ণতা থেকে বের করতে পারছি না। মানুষকে যে কখন এতটা ভালবেসেছি, সেটা আগে কখনো অনুভব করার সুযোগ হয়নি।

নিজেকে নিয়ে তেমন কোনো দুশ্চিন্তা হয় না। আমার বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের জন্য দুশ্চিন্তা হয় সারাক্ষণ। বিশেষ করে আমাদের অনুষদীয় ডীন অধ্যাপক ড. মনসুর মুসা স্যারের জন্য। বৃদ্ধ বয়সেও মানুষ যে কতটা প্রাণবন্ত থাকতে পারে, তার বাস্তব উদাহরণ উনি।

স্যার আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। তবে আশা রাখি, সবার সঙ্গে দেখা হবে। আমাকে সবচেয়ে ভাবায় একবারে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য। ব্যক্তিগতভাবে আমি বেকার। তাদের পাশে দাঁড়ানোর সামর্থ্য আমার নেই। সরকারের সাহায্যও তাদের জন্য প্রয়োজনের তুলনায় সীমিত। কিন্তু মানুষের চাহিদা তো তীব্র। শুধু একটা কথা মনে হয়, মানুষ আজ অসহায়।

খুলনায় আসার সময় তেমন কিছুই আনা হয়নি। তবে আমার প্রিয় লেখকের বই আনতে ভুলিনি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা সবসময় আমার চিরচেনা, চিরজাগরূক মনে হয়। এবার বইমেলায় যাওয়ার পর সব স্টল ঘুরে ঘুরে অবশেষে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের স্টল থেকে তাঁরই লেখা ‘আরণ্যক’ উপন্যাস খুঁজে নিতে আমার ভুল হয়নি। তবে বইটি উপহার দিয়েছিলেন আমার খুব কাছের একজন মানুষ।

‘পথের পাঁচালী’ বইটি অনেকবার পড়েছি, এখন আবারও পড়ছি। যতবার পড়ি ততবারই আমার শৈশবকে ফিরে পাই। এ যেন আমার শৈশবের মিষ্টি খুনসুটির ডায়েরি।

এখন ঘুম থেকে উঠার নির্দিষ্ট কোনো রুটিন নেই। কিন্তু আগের মতো গভীর ঘুম নিজেকে আচ্ছন্ন করে রাখছে না। আমার ছোট ভাই এইচএসসি পরীক্ষার্থী। পড়াশোনার তাড়া খুব বেশি নাই তার। কিন্তু করোনার প্রাণগ্রাসের খবর সংগ্রহে তার অনেক তাড়া। সারাক্ষণ ইন্টারনেট আর বন্ধুদের সঙ্গে গ্রুপচ্যাট নিয়ে পড়ে আছে।

ছোট বোন চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। তার পড়াশোনার গতি হারিয়েছে। এদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি শঙ্কিত। তবে ছোট বোনই আমার একাকীত্বের সবচেয়ে বড় সঙ্গী। এভাবেই আমার করোনা কালের অগোছালো দিনগুলো কেটে যাচ্ছে। মনে মনে আশা রাখছি, খুব শীঘ্রই স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসবে। আবার সবাই প্রাণের ক্যাম্পাসে মিলিত হবো।

লেখক: শিক্ষার্থী, ভাষা যোগাযোগ ও সংস্কৃতি বিভাগ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা।

 

গবি/হাকিম মাহি 

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়