‘মনে পড়ে প্রিয় জবি ক্যাম্পাস’
কামরুজ্জামান শানিল || রাইজিংবিডি.কম
বিশ্ব আজ অতিক্রম করছে এক ভয়াবহ অধ্যায়। যে ভয়াবহতায় প্রাণ হারাচ্ছে লাখো মানুষ। হ্যাঁ, মহামারি করোনাভাইরাসের কথাই বলছি। মানবসভ্যতা আজ হার মেনেছে এক ক্ষুদ্র অণুজীবের কাছে। শুরুটা চীন থেকে হলেও লাশের মিছিল আজ বিশ্বজুড়ে। আর সেই ভয়াল থাবা থেকে বাদ পড়েনি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশও।
মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকেই দেশের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত, যোগাযোগ পরিবহন, সর্বোপরি জনজীবনের নিত্য কর্মযজ্ঞ বন্ধ রয়েছে। একই পরিপ্রেক্ষিতে বন্ধ রয়েছে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম্পাসে কাটানো দিনগুলো সবার কাছেই সোনালি স্মৃতির মতো। ছুটি সবারই পছন্দ। হয়তো ক্লাস, পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন, ভাইভা এতসব চাপে কয়েকটা দিন ছুটি সবারই কাম্য ছিল। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, প্রায় তিন মাস ধরে সবাই গৃহবন্দি। এমনটা হয়তো কারো কাম্য ছিল না। ক্যাম্পাসে কাটানো দিনগুলোর সাথে সবাই এতটাই মিশে গিয়েছে যে, প্রতিনিয়ত সেই অভাবটা উপলব্ধি হয়। তবুও সাবধানতার জন্য, সুস্থ থাকার জন্য, বেঁচে থাকার জন্য সবাই এই অবস্থাটাকেই মেনে নিয়েছে।
প্রিয় ক্যাম্পাস জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো এখন আর আগের মতো নেই। চিরচেনা কোলাহলময় পরিবেশ নেই, শান্ত চত্বর এখন সম্পূর্ণ শান্ত, কাঁঠালতলায় বসে কেউ পূর্বের ন্যায় আড্ডা দিচ্ছে না। লাল বাসগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। এখন আর কেউ পেছনের গেইটে দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে গান গাইছে না। কৃষ্ণচূড়া ফুলের লালচে সৌন্দর্য ক্যাম্পাসিয়ানদের চক্ষু শীতল করছে না। তবে কেমন আছে তারা? কতটা মনে পড়ছে প্রাণের জবিকে? সেই অনুভূতিগুলো জানাচ্ছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থীরা।
পরিসংখ্যান বিভাগের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী সাদিয়া নওশীন বিন্তি প্রিয় ক্যাম্পাসকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, প্রিয় জবি, আশা করি তোমার সৌন্দর্য ঠিক সেরকমই রয়েছে যেমন আমরা তোমাকে রেখে এসেছিলাম। ক্যাম্পাসে আমার প্রবেশ ঘটে অন্য সবার থেকে কয়েক দিন পরে। তবে আমার ভালোবাসাটা সবার মতোই তোমার প্রতি ব্যাপক। ভেবেছিলাম বন্ধুদের সাথে খুব হৈ-হুল্লোড় করে তোমার প্রাঙ্গনণে কাটিয়ে দিব পুরোটা সময়। কিন্তু এই করোনা ভাইরাসের মতো মহামারির কারণে তা আর হয়ে উঠলো না। প্রতিদিন খুব মনে পড়ে বন্ধুদের সাথে নিজের ক্লাসরুমে কাটানো মুহূর্তগুলোর কথা, শান্ত চত্বরে সবার একসাথে আড্ডা দেওয়ার কথা, শহীদ রফিক ভবনে পরীক্ষা দেওয়ার কথা, মনে পড়ে আমার প্রিয় সেই লাল বাসগুলোর কথা। তবে তুমি চিন্তা করো না আমার প্রিয় জবি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার তোমার শান্ত চত্বর হৈ-হুল্লোড়ে ভরে উঠবে। ঠিক তত দিন আমাদের অপেক্ষায় ভালো থেকো।
সমাজকর্ম বিভাগের ১ম বর্ষের ছাত্র এসএম ইমরান জিম বলেছেন, ভার্সিটি বন্ধ হয়েছে প্রায় তিন মাস হলো। ভার্সিটিতে পড়ার আগে ভাবতাম যে ভার্সিটি লাইফে কোনো বন্ধু পাব না। কিন্তু এই কথা মিথ্যা হয়ে গেলো যখন নিজের ডিপার্টমেন্টসহ অনান্য ডিপার্টমেন্ট এবং বাসের অনেক বন্ধু পেলাম। তাই এই গৃহবন্দি পরিস্থিতিতে শুধু অপেক্ষায় আছি কখন আবার সেই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিব।
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ১ম বর্ষের ছাত্র কৌশিক রায় বলেছেন, জীবনে এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দেই। আসলে খুব বেশিদিন হলো না জগন্নাথে। কিন্তু এই অল্প সময়ে এই সাজানো ক্ষুদ্র ক্যাম্পাসটি যেন হৃদয়ে গেঁথে গেছে। ক্যাম্পাসটি রংধনুর মতো সুন্দর লাগে, যখন এখানে একইসাথে সৃজনশীলতার রঙ, ভালোবাসার রঙ আর বন্ধুত্বের রঙ মেতে ওঠে। কিছু অনুভূতি আর ভালোবাসার কথা দিয়ে প্রকাশ করা যায় না।
বন্ধুদের সাথে আড্ডা, ঘোরা, ক্ষুদ্র টিএসসির আসর, নাচগানের মহরা, ক্লান্ত শরীর নিয়েও বাসে করে বাসায় আসার সময় যে পিকনিকের আনন্দ, সবই ভীষণভাবে মিস করছি। আশা করি এই মহামারির পর একসাথে আবার সবাই ক্যাম্পাসে দেখা করতে পারব। আর সবার জন্য রইল ভালোবাসা ও শুভকামনা।
রসায়ন বিভাগের ১ম বর্ষের ছাত্র এসএম মোস্তফা কামাল শাওন বলেছেন, জবির কথা মনে পড়তেই মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামে অন্যরকম ভালো লাগার অনুভূতি সৃষ্টি হয়। কতই না দুরন্তপনার সাথে কাটিয়েছি দিনগুলো! সেই শীতের সকালে চাদর গায়ে জড়িয়ে লাল বাসের জানালার শীতল হাওয়া উপভোগ থেকে শুরু করে বন্ধুদের সঙ্গে শান্ত চত্বর, কাঁঠালতলায় আড্ডার কথা অধরা স্বপ্নের মতো মনে হয়। তাই মস্তিষ্কের সেরেব্রাম বারবার সেই ক্যাম্পাসে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা শক্তিকে জাগ্রত করে। কবে ফিরে পাব সেই কোলাহলপূর্ণ জবি ক্যাম্পাস! আশায় আশায় দিন যে আর কাটে না।
লোকপ্রশাসন বিভাগের ১ম বর্ষের ছাত্রী আফসানা নওশিন দিপ্তী জবির কথা স্মরণ করে বলেছেন, প্রিয় জবি, তোমার ওই ছোট্ট জায়গাটা খুব মিস করি। তোমাকে মিস করি। বন্ধুদের সাথে ক্যাফেটেরিয়ায় আড্ডা, কাঁঠালতলার আড্ডাগুলো অনেক মনে পড়ে। বাসের আড্ডা, ভিক্টোরিয়া পার্কের আড্ডা, শান্ত চত্বরে মুখরিত সেই জায়গাটা খুব মনে পড়ে। ইচ্ছে করে এখনই যাই, তোমার প্রান্তে। কিন্তু সময়ের কী পরিহাস, হায়! জবির সেই ছোট্ট জায়গাটা, কত সহজেই প্রেমে পড়ে গেলাম আমি। আবার কি দেখা হবে তোমার সাথে!
আইন বিভাগের ১ম বর্ষের ছাত্রী মনিরা পারভীন মৌসি বলেছেন, দীর্ঘ সাধনার পরে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ হয়, অতঃপর খুব অল্প সময়ের কাটানো মুহূর্তগুলো যখন আজ স্মৃতি হয়ে মনে নাড়া দেয়! যখন সে স্বপ্নের স্থানে প্রথম পা রাখি, তখন মনের মধ্যে কোথাও ভয় কাজ করলেও, ঠিক অপর দিকে লক্ষ্য পৌঁছানোর আশায় কেমন একটা ভালোবাসা মনে কড়া নাড়ে।
ক্যাম্পাসে গিয়ে সাথে সেই কথোপকথন, আড্ডা আজ শুধু মনে পড়ে। কোথায় যেন হারিয়ে গেলো সুখ-দুঃখে, আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠা দিনগুলো। কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে রইল শান্ত চত্বর, কাঁঠালতলা, রফিক ভবন, বিবিএ ভবন, বিজ্ঞান ভবন। আর আজ শুধু ঘরে বসে সেই দিনের অপেক্ষা, কবে কেউ ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করবে, দোস্ত আজ কি ক্লাশে কোনো অ্যাসাইনমেন্ট জমা নিবে?
শিক্ষার্থীদের মনে একটাই শূন্যতা, ক্যাম্পাসের কাটানো দিনগুলো। একটাই আক্ষেপ, লক ডাউনে একাকীত্ব। একটাই আশা, আবার ফিরে আসবে সেই আড্ডা। ‘নীল আকাশের নিচে চায়ের কাপে, আবার জমবে মেলা জগন্নাথে।’ এই প্রত্যাশাই সবার মনে। আশা করি আবার ফিরে আসব এক সুস্থ শহরে, আবার দেখা হবে ক্যাম্পাসে, আবার আড্ডা হবে, আবার গান গাইব লাল বাসের পেছনের দরজায়।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
জবি/সাদেক/মাহি
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন