ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

করোনার লক্ষণ শনাক্ত করবে মুনের রোবট

ফারহান ইশরাক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:০১, ৬ জুলাই ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
করোনার লক্ষণ শনাক্ত করবে মুনের রোবট

সদ্য কৈশোর পেরোনো বাংলাদেশি তরুণ একটি রোবট বানিয়েছেন, যা দিয়ে করোনার লক্ষণগুলো শনাক্ত করা যাবে, আর সেই অনুযায়ী নেওয়া যাবে প্রতিরোধক ব্যবস্থা। শুনতে অবাক লাগলেও এমন অভূতপূর্ব কাজই করে দেখিয়েছেন যশোরের ছেলে সেখ নাঈম হাসান মুন।

খুব ছোটবেলা থেকেই রোবট নিয়ে আগ্রহ মুনের। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়াকালে ইন্টারনেটের সাথে পরিচয় তাঁর। যে বয়সে দেখার কথা কার্টুন কিংবা মজার কোনো কিছু, সে বয়সে মুন ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটি করতেন রোবট নিয়ে। এতটুকু বয়সেই রোবটের ভিডিও, আর্টিকেল দেখে দেখে তাঁর সময় কাটতো। সবকিছু তখনই না বুঝলেও মনের মধ্যে রোবট তৈরির বাসনা তখন থেকেই। এরপর ক্লাস সেভেনের ফাইনাল পরীক্ষায় গণিতে পেলেন ১০০ এর মধ্যে ২। অন্য কেউ হলে নিজেকে নিয়ে হতাশ হয়ে পড়তো, কিন্তু মুন ভাবলেন অন্য কথা। তাঁর মনে হলো তিনি সবার থেকে আলাদা, তাই পরীক্ষার নম্বরটিও পেয়েছেন আলাদা। এটাই হয়ে গেলো তাঁর জীবনের এক টার্নিং পয়েন্ট।

তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন পড়াশোনার পেছনে সময় না দিয়ে নতুন কিছু করার, যে স্বপ্ন ছেলেবেলায় দেখেছিলেন, সেটিই সত্য করবেন। আর তাই যখন তাঁর অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার কথা, বাসার সবার চোখ এড়িয়ে তিনি স্কুল ফাঁকি দিতে লাগলেন। বাবা-মা জানত ছেলে স্কুলে, কিন্তু মুন তখন ব্যস্ত প্রোগ্রামের খুঁটিনাটি জানতে৷

পুরো বছরজুড়ে অনলাইন স্কুলের মাধ্যমে প্রোগ্রামিং শিখলেন। সাইবার সিকিউরিটি নিয়েও পড়াশোনা করলেন প্রচুর। আর এর সবই ঘটতে লাগল বাসার সবার চোখ এড়িয়ে। কিন্তু বছরের শেষে বাঁধল বিপত্তি। অষ্টম শ্রেণি শেষে সবাইকে জেএসসি পরীক্ষা অংশ নিতে হয়, কিন্তু মুনের বাবা-মা দেখলেন ছেলে তো অষ্টম শ্রেণিতে পড়েইনি! ছেলের এমন কাণ্ডে বাবা-মা হতবাক। আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীরাও নানা কথা বলাবলি শুরু করল। তাই বাধ্য হয়েই মুনকে নতুন করে স্কুলে ভর্তি হতে হলো।

এবারের স্কুলের জীবন হলো আগের চেয়ে কঠিন। বাবা-মার কড়া শাসনে চলতে লাগল তাঁর জীবন। মনের মধ্যে ভয়, পড়াশোনার জন্য প্রোগ্রামিং কি তবে ছেড়ে দিতে হবে। এই দুশ্চিন্তার মাঝেই ঘটল দারুণ এক ঘটনা। সে বছরই প্রোগ্রামিংয়ে পেলেন দুটি পুরস্কার। সেও আবার যেনতেন পুরস্কার নয়, দুটোই স্বর্ণপদক। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস তৈরি হলো মুনের মধ্যে। বাবা-মাও বুঝলেন ছেলেকে তাঁর স্বপ্নের রাজ্যে বিচরণ করতে দেওয়া উচিৎ। সেই থেকে মুনকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। দিনের পর দিন কাজ করেছেন নিজের স্বপ্ন নিয়ে।

২০১৬ সালে নিজে নিজেই তৈরি করলেন একটি সাইবার এক্সপার্ট ড্রোন। স্বনামধন্য একটি প্রতিষ্ঠান থেকে কাজের ডাক এলো, কিন্তু বাবা-মা ছেলেকে একা ছাড়তে নারাজ। তাই ঘরে বসেই নিজের বিজ্ঞানধর্মী গবেষণা চালিয়ে যেতে লাগলেন মুন। ২০১৭ তে প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় হলেন চ্যাম্পিয়ন। পাশাপাশি টিভি রিয়েলিটি শো সেরা উদ্ভাবকের খোঁজের প্রথম ১৫ জনের মাঝে স্থান করে নিলেন। এর ফলে এটুআই (Access to information) এর সাথে কাজ করার সুযোগ পেলেন মুন। পরিচয় হলো তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের সাথে। মুন কাজ শুরু করলেন আইসিটি ডিভিশনের সাথে। ২০১৮ সালে স্টার্টআপ বাংলাদেশের সাথেও কাজ করলেন পুরোদমে। আর এর পাশাপাশি চলছিল নিজের স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে চলা।

ছোট থেকেই সবকিছু নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভালোবাসতেন মুন। তাই তৈরি করলেন কারিগরি শিক্ষার অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘মজার পাঠশালা’। এর মাধ্যমে নিজের স্বপ্নগুলোকে ছড়িয়ে দিতে লাগলেন আরও হাজারো স্বপ্নবান শিক্ষার্থীদের মাঝে। ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন নিজের রোবটিক্স প্রতিষ্ঠান ‘বঙ্গবটস’। রোবট বানানোর কাজ চলতে লাগল নতুন গতিতে। পরিকল্পনা ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে এমন একটি রোবট বানাবেন, যা বঙ্গবন্ধুর জীবনের গল্প বলতে পারবে। সে অনুযায়ী কাজও শুরু করেছিলেন, কিন্তু বাঁধ সাধল করোনা। মুন ভাবলেন, এ সময়ে মানুষের উপকার করতে পারে এমন কোনো রোবট তৈরি করা দরকার। তাই তাঁর টিম নিয়ে কাজ শুরু করলেন। তিন মাসের মাথায় তৈরি হলো তাঁর রোবট। রোবটটির নাম দিলেন ‘খোকা’।

এই রোবটটি করোনার লক্ষণগুলো শনাক্ত করতে পারবে। লক্ষণ দেখা দিলে কী পদক্ষেপ নিতে হবে একজন রোগী রোবটটির মাধ্যমেই সেটি জানতে পারবেন৷ ফলে চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে ঘরে বসেই প্রাথমিক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে। এতে রোগীর অর্থ ও সময় দুটোই সাশ্রয় হবে। ঘর থেকে বেরোলে করোনার ঝুঁকি বাড়ার যে সম্ভাবনা, সেটিও অনেকাংশে কমে আসবে।

মুন এখন পর্যন্ত বিভিন্ন মডেলের ২৮টি রোবট তৈরি করেছেন। ‘খোকা’ রোবটটি তিনি মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করেছেন। মুন প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন, এই রোবটটি যদি ব্যাপকহারে উৎপাদন করে সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, তাহলে এই মহামারির মাঝেও মানুষের অনেক উপকার হবে, কল্যাণ হবে দেশের সবার। আর মানুষের জন্য কিছু করতে পারাই হবে তাঁর কাজের আসল পুরস্কার।

লেখক: শিক্ষার্থী, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

ঢাবি/মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়