ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

দেখা হয়েছিল শ্রাবণে

ধীরা ঢালী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০৮, ১২ জুলাই ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
দেখা হয়েছিল শ্রাবণে

জানালার কাচে ঘেরা বৃষ্টির সকাল। ভোর না হতেই ঝুমঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমি বিছানায় শুয়ে অনুভব করছি বৃষ্টির টুপটাপ ফোঁটার শব্দ। বিছানা ছেড়ে  উঠেই জানালার কাচে লেগে থাকা স্বচ্ছ বৃষ্টির পানি আলতো স্পর্শ করি। মুহূর্তেই মনে সজীবতা এসে ভিড় জমালো।

দিনটি ছিল ৮ জুন, ২০২০। এখন তো প্রতিটি দিনই আমার ‘ডে অফ’। আমি সাধারণত ছুটির দিনগুলোতে বাসায় সময় কাটাতে স্বাচ্ছন্দবোধ করি।  কিন্তু  আজ কী হলো জানি না, ছাতাসহ বাসা থেকে বের হলাম। আজ কোনো এক কারণবশত ক্যাম্পাসে রিকশাওয়ালা মামাদের তেমন আনাগোনা নেই।  তবে ছিল সবুজ প্রকৃতির অফুরন্ত উল্লাস। চারদিকে ঝকঝকে সবুজের সমারোহ,  সাথে  নীল আকাশ উজাড় করে দিয়েছে তার বর্ণহীন অনবরত বুলেটসম বৃষ্টির ফোঁটা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘টার্জান পয়েন্ট’ বরাবরই সবার খুব পছন্দের। আমারও! তবে আমার আবার দুপুর বা গোধূলি লগ্নের বৃষ্টি পছন্দ নয়। আমার পছন্দ সকালের নিরন্তর ঝুমঝুম বৃষ্টির সাথে এলোমেলো একঝাঁক জংলি হিমেল হাওয়া।

টার্জান পয়েন্টে বৃষ্টির ফোঁটা গুনতে গুনতে উদ্দেশ্যহীনভাবে হেঁটে চলেছি। উদাসীনতা আমাকে ভর করেছে। হঠাৎ মনে হলো আমাকে উদ্দেশ্য করে কেউ পিছু নিয়েছে। কে এই অপরিচিতা? তার কাছে নিজের মনকে ধরা দেওয়ার এত তাড়া আমার! ধীরে ধীরে আমার হাঁটার গতি শিথিল হয়ে আসছে। কয়েক সেকেন্ডের উদাসীনতায় পেছনে তাকাতেই সে মিলিয়ে গেলো ঝুমবৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায়।

মনে পড়ে গেলো বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের সেই বিখ্যাত উক্তি—‘হে পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছো!’ নিজেকে কপালকুণ্ডলার চরিত্রে দাঁড় করাতে তীব্র ইচ্ছে জাগলো।  কিন্তু আমার নবকুমার কোথায় মিলিয়ে গেলো!

১৬ জুন, ২০২০।  আমি আবারও টার্জানের পথ ধরে অপরিচিতাকে উদ্দেশ্য করে হেঁটে চলেছি।  অপরিচিতার সঙ্গে পরিচয়ের তীব্র ইচ্ছে আমাকে ধাওয়া করে চলেছে। তবে, আজকের চিত্র ছিল ভিন্ন। পাশ থেকে একজন অপরিচিত মানুষ এসে আমার হাতটি চেপে ধরে, সামনে ঘুরে দাঁড়ালো। অথচ আমাকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ সে দিল না। উল্টো আমাকে প্রশ্নে বিদ্ধ করতে সে একটুও স্থবির হলো না। আমাকে বললো, ‘এই সাতটি দিন তুমি কোথায় ছিলে? প্রতিটি দিন এই সময়ে তোমাকে খুঁজে চলেছি, শুধু তোমাকেই, টার্জানে।’

আমি বললাম, প্রতিটি দিনের প্রতিটি সেকেন্ড আমি তোমাকেই অনুভব করেছি। আমার মন বলছিল আবারও দেখা হবে। জীবনানন্দ যেমন প্রকৃতিকে নিরাশ করেননি, তুমিও আমাকে নিরাশ করতে পারো না। মুহূর্তেই একে অপরকে বললাম, ‘ভালোবাসি তোমাকে।’ আমাদের মাঝে ছিল না কোনো লোকদেখানো মনোভাব। একে-অপরকে চিনি না, জানি না অথচ হাতে-রেখে-হাত চলতে শুরু করলাম।

ভোরের সূর্য পূব আকাশে কালো মেঘের ভেলা নিঃশেষ করে আবারও পাড়ি জমিয়েছে পশ্চিম আকাশে অস্ত যাওয়ার উদ্দেশে। অথচ আমরা আমাদের স্ব স্ব নীড়ে ফেরার পথ যেন ভুলে বসেছি।  নতুন উন্মুক্ত এক নীড়ে বসবাসের বীজ বপন করে চলেছি।

দিনভর বিরতিহীন ভালোবাসার ছোঁয়ায় কেটেছে আমাদের। ফুচকা, ঝালমুড়ি, আর আমার অপছন্দের  বটের ঘরোয়া খাবার খেয়ে দিন কাটিয়ে দিলাম। তখনো আমাদের পরিচয় পর্বটা ঠিক হলো না। এই দীর্ঘ সময়ে আমাদের কথা হলো ঝুমঝুম নিরন্তর বৃষ্টির পথচলা নিয়ে, আর আমাদের আগামীর ভালোবাসায় সিক্ত রঙিন জীবনের পরিকল্পনা নিয়ে।

আমি রিকশায় উঠার পর তাকে বললাম, আমি ওইযে ভাষা শহীদদের নামে হলের টিচার্স কোয়ার্টারে থাকি। শুধু এতটুকুই।  তবে আমাদের  চোখের জলের ভাষা আশেপাশের মানুষকে বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখলো না আমরা কতটা একে-অপরের পরিচিত। রিকশায় বসে ভাবছি বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা সার্থক নয়, সার্থক আমি।

২৪ জুন, ২০২০। আমার বাসার ঠিকানায় চিঠি এলো। কিন্তু চিঠিটা কি নাম না জানা পরিচিতার! এই এক সপ্তাহ প্রতিটি মুহূর্তে নিজেকে দোষারোপ করেছি। কেন আমি তার পরিচয়  জানতে চাইলাম না? আবার ভেবেছি, সেও কেন চাইলো না। এটা ভেবে তার উপর অনেক অভিমান জমে আছে। অস্থিরতা কাজ করছে, খাম খুলে চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম। আশ্চর্যের বিষয় কপালকুণ্ডলার একটা উক্তিই যেমন হাজার হাজার রোমান্টিক কবি সাহিত্যিকদের কলমে এনে দিয়েছিল যৌবনমিশ্রিত প্রেমের দোয়াত, আর আমার নাম না জানা পরিচিতার এক উক্তিই আমাকে উপহার দিলো আমৃত্যু আঁকড়ে থাকার অফুরন্ত আবেগ মোড়ানো এক ভালোবাসার শক্তি  ‘দেখা হয়েছিল শ্রাবণে।’

লেখক: শিক্ষার্থী, গণবিশ্ববিদ্যালয়।

 

ঢাকা/মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়