ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

চিরচেনা শ্রেণিকক্ষে নেই প্রাণের স্পন্দন

ধীরা ঢালী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২৩:৪৯, ১৮ জুলাই ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
চিরচেনা শ্রেণিকক্ষে নেই প্রাণের স্পন্দন

‘নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।

ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।

বাদলের ধারা ঝরে ঝরো-ঝরো,   আউষের ক্ষেত জলে ভরো-ভরো,

কালিমাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনিয়েছে দেখ্ চাহি রে।’

রবি ঠাকুরের আষাঢ়ের কালিমাখা মেঘের মতোই আজ হাজার হাজার ক্যাম্পাস মাতোয়ারা শিক্ষার্থীর মনে কালো মেঘ এসে বাসা বেঁধেছে। ঘরের বাইরে বের হওয়ার তাড়া তাদের ধাওয়া করে চলেছে প্রতি মুহূর্তে।

ইট-পাথরে গড়া প্রাণের সেই ক্যাম্পাস আছে, অথচ সেখানে নেই কোনো প্রাণের স্পন্দন। শিক্ষার্থীদের খুনসুটিতে মাতোয়ারা ছিল যে শ্রেণিকক্ষগুলো সেখানে জমেছে স্বচ্ছ ধুলো আর একাকিত্বের ভিড়। প্রতিটি শিক্ষার্থীর পদচারণার আশায় অপেক্ষমাণ হয়ে আছে বিভাগগুলো। হাহাকার আর নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে শ্রেণিকক্ষগুলোর প্রতিটি কোণায় কোণায়। 

বলছি আমাদের সবার প্রিয় গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। যার প্রতিটি বালুকণায় মিশে আছে শিক্ষার্থীদের ভালোবাসার ছোঁয়া। অথচ এই দুর্যোগকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে বিষন্নতায়।

এ সব বিষয় নিয়ে কথা বলেন ভাষা-যোগাযোগ ও সংস্কৃতি (বাংলা) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুইটি মনি।  তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পাসে আমার পথচলা খুব বেশি দিনের নয়। এখন মনে হয় এটার সঙ্গে আমার জন্মজন্মান্তরের বন্ধন।  এই দুর্যোগে আমরা সবাই হয়তো বাধ্য হয়ে ঘরে অবস্থান করছি। কিন্তু আমার মন পড়ে আছে ক্যাম্পাসের প্রতিটি কোণায়। একাকিত্বের জাল আমাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। প্রতিটি মুহূর্তে অসহায়বোধ করছি। ’

শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর সম্পর্ক যে একই সুতোঁয় গাঁথা এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।  তারা হলেন একে অপরের পরিপূরক। শিক্ষার্থী ব্যতীত শ্রেণিকক্ষ যে কতটা বেদনাদায়ক, সেই অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন বাংলা বিভাগের শিক্ষক মো. কয়েছ আহমেদ।  তিনি বলেন, ‘এই দুর্যোগের মধ্যেও আমরা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে দায়িত্ব পালন করছি।  কিন্তু অতীতের দিনগুলোর মতো প্রাণখুলে একে অপরের সঙ্গে কথা বলতে পারছি না। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আমি সবসময় শ্রেণিকক্ষে গিয়ে দেখতাম আমার শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসছে কি-না। সেই ধারাবাহিকতায় আমি এখনো ক্লাসরুম পরিদর্শন করতে যাই। কিন্তু সেখানে নেই আগের মতো কোলাহল, নেই প্রাণের স্পন্দন। নেই কোনো শিক্ষার্থীর জিজ্ঞাসা। এখন কোনো শিক্ষার্থী এসে বলে না, স্যার আপনার সঙ্গে ক্লাস আছে।’

অনলাইনে চলছে ক্লাস, পরীক্ষা। রেজাল্টশিটও তৈরি হচ্ছে অনলাইনে।  থেমে থাকছে না কিছুই।  তবে সেখানে নেই শ্রেণিকক্ষের ব্লাকবোর্ড, টেবিল, বেঞ্চগুলোর দরদমাখা স্পর্শ।  নেই শিক্ষকদের ভালোবাসায় মোড়ানো শাসন।

এমনই এক দরদমাখা স্পর্শকাতর মুহূর্তের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন ইংরেজি সাহিত্য বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রকিবুল ইসলাম।  তিনি বলেন, ‘পরিবারের পর যেখানে একজন শিক্ষার্থী সবচেয়ে বেশি সময় কাটায় সেটা হলো তার শ্রেণিকক্ষ।  যেখানে তার বন্ধু তৈরি হয়। গড়ে ওঠে একটা সাময়িক পরিবার।  যেখানে থাকে হৈচৈ, গল্পের আড্ডা আরও কত কী!’

‘কিন্তু সবই যেন স্মৃতি হয়ে গেছে।  যে বেঞ্চে বসে চলতো কতো ঝগড়া, খুনসুটি।  সেখানে হয়তো ধুলো জমে গেছে। ক্লাসের ওই বোর্ডটাও অপেক্ষায় আছে কবে তার বুকে মার্কারের আঁচড় পড়বে।  সবাই অপেক্ষায় আছে এক সুস্থ পৃথিবীতে প্রাণ খুলে নিঃশ্বাসের’, বলেন তিনি। 

বিশ্ববিদ্যালয় বলতে আমরা বুঝি ইট-পাথরে মোড়ানো সুউচ্চ ভবন আর শিক্ষার্থীদের আনাগোনা। যেখানে তাদের তত্ত্বাবধানে থাকবেন শিক্ষকরা।  কিন্তু এর মধ্যেই কী সীমাবদ্ধতা!  এমন প্রশ্নের জবাবে ইংরেজি সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক সোনিয়া শিরীন বলেন, ‘এখন ক্যাম্পাসের গেটের ভেতরে ঢুকলেই বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা শূন্যতা বিরাজ করতে থাকে।  প্রথমেই চোখে পড়ে বাদামতলা, ঝালমুড়ি ও ভেলপুরি মামার চিরচেনা জায়গাটার দিকে। সেখানের বেঞ্চগুলোকে সর্বদা আমার শিক্ষার্থীরা মাতিয়ে রাখতো। ওদের হাসিমাখা মুখগুলোই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ-চাঞ্চল্যতা। পিঠা চত্বরের বেঞ্চগুলো যেন প্রতিটি মুহূর্তে আমার শিক্ষার্থীদের অপেক্ষার প্রহর গুনছে।’

ক্লাস-পরীক্ষা, উত্তীর্ণ হওয়াটাই কি শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবশ্যিকতার পূর্বশর্ত! না, ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে প্রতিটি শিক্ষার্থীর কোমল মনকে নৈতিকতায় ভরিয়ে দেওয়াটাই একজন শিক্ষকের নৈতিক দায়িত্ব। এমনই একজন মহৎপ্রাণ ব্যক্তিত্ব বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের শিক্ষক শেখ শহিদুল ইসলাম জনি।  এই দুর্যোগকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতিকে সামিল করে তিনি বলেন, ‘একজন প্রফেশনাল শিক্ষকের পক্ষে ছাত্র-ছাত্রীদের সংস্পর্শ ছাড়া থাকা বেদনাদায়ক এবং অনেকটাই অসম্ভব। সবুজে ঘেরা যে ক্যাম্পাস শিক্ষার্থীদের কোলাহলে মুখর থাকতো সেখানেও আজ নেই প্রাণের স্পন্দন।  শ্রেণিকক্ষগুলোকেও মৃত মনে হয়। করোনাভাইরাস উদ্ভূত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট আমাদের বাধ্য করেছে এই মর্মান্তিক পরিস্থিতি মেনে নিতে।’

অন্ধকার কেটে যেমন একমুঠো মিষ্টি রোদকে সঙ্গী করে  ভোরের সূর্য উঠে। তেমনি আমাদের উজ্জ্বল আলোয় আবারও প্রজ্জ্বলিত হবে প্রাণের ক্যাম্পাস গণ বিশ্ববিদ্যালয়।  ক্যাম্পাসের প্রতিটি বালুকণা ফিরে পাবে তার হারানো জৌলুশ।  আর আমরা ফিরে পাবো আমাদের চিরচেনা সেই আনন্দ-উল্লাসে মুখরিত  শ্রেণিকক্ষ।

 

গবি/মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়