ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

অনুভবে জামালপুর

অধ্যাপক মালেকা আক্তার চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০০:৪৫, ২২ জুলাই ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
অনুভবে জামালপুর

আজ শ্রাবণের সন্ধ্যায় জামালপুরের বাড়িতে অঝোর ধারায় ঝরে পড়া টিনের চালে বৃষ্টির কাব্যিক শব্দে মনটা কেবলই উদাস হয়ে যাচ্ছে। খেয়ালী বর্ষা এসেছে ভাঙা-গড়ার অনিবার্য শিল্পী হয়ে। মানব মনে প্রশান্তির অবিরল ধারায় স্মৃতির সীমানায় অবগাহনের অঙ্গীকারে ঋদ্ধ সময়ের আবেদন ছুঁয়ে।  মনে পড়ছে ফেলে আসা দুর্দান্ত সেসব সোনালি দিনের গল্প।

সহজাতভাবেই মানুষ বিস্মৃতিপ্রবণ। পুরনো স্মৃতিগুলো চলার পথের নব আয়োজনের ধুলোবালির আস্তরণ পড়ে ম্লান হয় বলেই চঞ্চল মন সামনে বাড়তে শিখে। এগিয়ে চলার সাহস পায়। তবুও কিছু স্মৃতি, কিছু অনুভূতি কখনোই পুরনো হয় না। আপন মহিমায় দ্যুতি ছড়ায়, ভাবায়, হাসায় এবং কাঁদায় ।

আজন্ম লালিত যে শহরের সবুজ শ্যামলিমার প্রাণ প্রাচুর্যে আমি জন্মেছি। বেড়ে উঠেছি। স্কুল- কলেজের গণ্ডি পেরিয়েছি। সেটি আমার প্রাণের প্রিয় শহর জামালপুর। অবসরপ্রাপ্ত বাবার ঘরে কলেজের পাঠ শেষ হওয়ার পূর্বেই প্রাক-প্রেমের ঘোর নিয়ে কিশোরী বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে বসা।

শুরু হয় কিশোরী কন্যার সংসারধর্ম। পড়াশোনা-সন্তান পালনের গুরু দায়িত্ব। অবশেষে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে শিক্ষা ক্যাডারে যোগদান। জীবনটাকে জটিল এক সংসারে থিতু করলেও যাপিত জীবনে সুখ ও দুঃখের ভেলায় ভেসে রঙিন প্রজাপতির মতোই পুরো জামালপুর মাতিয়েছি মনের রঙে রাঙিয়ে। বহতা সময়ের রাশ টেনে আনন্দ উপভোগ করেছি স্বজন-পরিবার-পরিজন, বন্ধু-পরিচিতজনদের সঙ্গে। সে স্বাধীনতা আমার উদারমনা স্বামী হাসমত আলী চৌধুরী যেমন দিয়েছেন, তেমন তিনি নিজেও সেসব উপভোগ করতেন।

জামালপুরে সরকারি জাহেদা সফির মহিলা কলেজে চাকরির সুবাদে কলেজ আর বাড়ির পার্থক্য তেমন ছিল না। কলেজ ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে এখানকার সব কিছু ছিল আমার অবাধ বিচরণের জায়গা। এক কথায় বাঁধনহারা আর ছন্নছাড়া আমি। স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছি মনের আনন্দে।

পেশাগত কারণেই স্ট্যাডি লিভ নিয়ে এমফিল ও পিএইচডি করার উদ্দেশ্যে ২০০৭ সালে গেলাম ঢাকা শহরে। মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুরু হলো এমফিলের শিক্ষার্থী হিসেবে ‘বেগম ফয়জুন্নেছা’ হলের আবাসিক ছাত্রী হয়ে পথচলা। সন্তানদের পড়াশুশোনার পাশাপাশি নিজেরটাও চলেছে সমানতালে এই জামালপুরে আসা যাওয়ার মাঝেই।

বেড়েছে পেশাগত ব্যস্ততা। সবকিছু মিলে জামালপুরের টানে বেশ খানিকটা ভাটা পড়লেও ঢাকা ছেড়ে যখনই নিজ শহরের দিকে পা বাড়িয়েছি তখন অন্যরকম এক আনন্দে মনটা নেচে উঠেছে। বাসায় চায়ের কাপে আড্ডার ঝড় উঠেছে গভীর রাত পর্যন্ত। রঙিন সে দিনগুলো চাইলেও কি আর ফিরে পাওয়া যাবে!

বৈশ্বিক মহামারির কবলে পড়ে দীর্ঘ লকডাউনের সময়টিতে জামালপুরে আসা হয়ে ওঠেনি। ছোটোবেলা থেকেই শুনে এসেছি জামালপুর এক গলির শহর। যদিও বর্তমান সরকারের সুদৃষ্টিতে জামালপুর এখন উন্নত জেলা শহরের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। দৃশ্যমান হয়েছে শহরের প্রাণকেন্দ্রে কালচারাল ভিলেজসহ শিল্পকলা একাডেমি।

প্রিয় শহরের পরিচিত কতো দোকান, মার্কেট, সু-উচ্চ ভবন আগ‌্রহভরে দেখছিলাম। জামালপুরের কোল ঘেঁষে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের শাখানদী প‌্রবাহিত। রিকশায় যেতে যেতে নদীর পানিতে প্লাবিত তীরবর্তী গ‌্রামের ঘর-বাড়ি ও গাছ-পালা আধডোবা হয়ে থাকার মতো দৃশ্য চোখে পড়লো। সারাদেশেই বাড়ছে বন্যার পানি। প্লাবিত হচ্ছে গ‌্রামের পর গ‌্রাম। জামালপুর সদর, ইসলামপুর, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়িতে পানি বেড়েই চলেছে। নদী ভাঙ্গনও থেমে নেই। পানি প‌্রবাহিত হচ্ছে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে। পানীয় জল এবং খাদ্য সংকটসহ ঔষধ-পথ্যের অভাবে প‌্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ চরমে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোভিড-১৯ মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশাপাশি বন্যাকবলিত মানুষের দুর্ভোগ আমলে নিয়ে বিভিন্ন সেবা সেক্টরকে নিয়মিত সেবা দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। এটা প্রশংসার যোগ্য।

হেঁটে নদী তীরের বাঁধের ওপর দিয়ে ব‌্রিজে চলে গেলাম। কোনো তাড়া ছিলো না ঘরে ফেরার। ব্যস্ততা ছিলো না রান্না করার। সময়টুকু নিজেকেই দিলাম। স্মৃতির আবেগঘন ওড়াউড়ি মনের পর্দাতে দেখতে পারছিলাম মনে হয়। চেনা নগরীর আজ সবই প্রায় অচেনা মনে হয়। তারওপর মাস্কের বাড়তি সুরক্ষা সংযোজনে চেনা-অচেনা সবই সমান।

দূরে গাছ-পালার সারিতে সবুজের সমারোহ। আধ ডোবা খড়ের গাদা আর ডুবন্ত প্রায় বাড়িগুলোকে কোনো শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতো মনে হচ্ছিলো। ব‌্রিজের দু’পাশের রেলিংয়ে শালিক পাখি আর কাক পাখির কাব্যিক বিচরণ প‌্রকৃতির কোলে যেনো অন্যরকম মাত্রা পেয়েছে। মাঝে মধ্যে দু’একটা ইঞ্জিন চালিত নৌকার ভট ভট শব্দেও মেঘলা গোমট আবহাওয়ায় মন্দ লাগছিলো না।

 

লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ ও সাধারণ সম্পাদক, শিক্ষক পরিষদ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা।

 

ঢাকা/মাহফুজ/মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়