ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের সংকট

সবুজ খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪২, ১৮ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের সংকট

বাগদাদের উপকণ্ঠের সুফি আস্তানার কর্তা জামালের কাছে মাওলানা জালালুদ্দিন রুমির গুরু বুরহানউদ্দিন একবার একটি চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘প্রিয় বন্ধু, আমার ছাত্র রুমির ছাত্র আমি। আমার ছাত্র রুমি এমন একজন মানুষ, যিনি সব জিনিসের তলদেশ থেকে সারমর্ম তুলে আনতে পারেন। আমি তার গুরু ঠিকই, কিন্তু তার কাছে থেকে আমি অনেক বেশি শিখছি।’ একজন গুরু কতটা নিরহংকার হৃদয়ের অধিকারী হলে এত সুন্দর একটি কথা বলতে পারেন! কতটা নিষ্কলঙ্ক অন্তর থাকলে এমন সুবিবেচক কথা মানুষ বলতে পারেন। পত্রের ওই কথাটা একটা সময় খুব স্বাভাবিক ছিল। সময়ের ব‌্যবধানে বর্তমানে যেকারো কাছে পত্রের কথাটা অস্বাভাবিক মনে হবে অবশ্য।

বর্তমানে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কটা খুবই দূর্বল, খুবই রূঢ়। গত কয়েকমাস আগেও দেখলাম ফেনীতে মাদরাসার এক ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে শিক্ষকের বিরুদ্ধে। আবার গত মার্চে ময়মনসিংহে শিক্ষকের দেয়া পড়া মুখস্থ করতে পারেনি বলে পেটাতে পেটাতে ছাত্রকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। শেষে বাঁচানোই যায়নি ওই ছাত্রকে। আবার যে শিক্ষককে বাবার স্থান দেয় একটা ছাত্রী, সেই ছাত্রীই ধর্ষিত হচ্ছে তার কাছে। এরকম অসম্মানজনক হাজারো ঘটনা ঘটে চলছে চারদিকে। শিক্ষক পেটাচ্ছেন ছাত্রকে, আর ছাত্র পেটাচ্ছেন শিক্ষককে। বাহ্! কী বিশৃঙ্খল একটা সময়ে দাঁড়িয়ে আছি আমরা।

একটা প্রবাদ আছে, ‘বাবা-মা জন্মায় ভূত, শিক্ষক জন্মায় পুত’। অর্থাৎ বাবা-মা সন্তান জন্ম দেয় ঠিকই, কিন্তু সেই সন্তানকে ‘মানুষ’করেন শিক্ষক। কিন্তু আদৌ কি মানুষ হচ্ছে ছাত্ররা? আদৌ কি শিক্ষকের কাছে থেকে ভালো কিছু পাচ্ছেন ছাত্ররা? ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে যে সম্পর্ক থাকা দরকার, তা কি আদৌ আছে? আদৌ কি ভালোবাসা, মহানুভবতা, সম্মানবোধ, নম্রতা আছে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মাঝে?

শুরুতে যে পত্রের কথা উল্লেখ করেছিলাম, এ রকম হাজারো গল্প আছে ছাত্র-শিক্ষক নিয়ে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তা আজ শুধুই পুস্তকে শোভা পাওয়া গল্প! তা এখন শুধু ইতিহাসের পাতাতেই লেখা আছে। বাস্তব জীবনে এর ছিটেফোঁটাও নেই, থাকলেও খুব কম। এখন ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক নিয়ে বইয়ের পাতায় পরে থাকা লেখাগুলো নীতিবাক‌্য হিসেবেই গণ‌্য হয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে বর্তমানে ছাত্র-শিক্ষকের মাঝ থেকে সম্মানের সম্পর্কটা কেন বিনষ্ট হয়ে গেল? সে বিষয়টা খোঁজা জরুরি। সে বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করা জরুরি। কেননা ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কটা যদি ভালো না হয়, এখনকার মতো চলতেই থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো শিক্ষা নামক জিনিসটাই হারিয়ে যাবে। বিলীন হয়ে যাবে ছাত্র শিক্ষকের সুবন্ধন। ছাত্র হারাবেন জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান রত্ন সুশিক্ষা, আর শিক্ষক হারাবেন ছাত্রের কাছ থেকে পাওয়া সন্মান, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার জায়গাটা।

ভয়ের সংস্কৃতি: বাঙালির ভয়ের সংস্কৃতি নতুন কিছু না। ভয় দেখিয়ে কার্যসিদ্ধির প্রয়াস আমাদের রক্তে মিশে আছে। ছোটবেলায় একটা শিশু খাবার না খেলে, ঘুম আসতে না চাইলে বাবা-মা বলতো- ঘুমাও নাহলে শিয়াল এসে ধরে নিয়ে যাবে, বাইরে ভূত আছে। স্কুলে যেতে না চাইলে বকাবকিসহ নানা ভয়ভীতি তো আছেই। নানাভাবে নানা ধরনের ভয় দেখিয়ে শিশুদের পরিচালনা করা হয় ছোটবেলা থেকেই। এই যে শিশুর মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দেয়া হলো, তা বড় হলেও থেকে যায় তার মধ্যে।

ছোট ভাইকে প্রশ্ন করলাম, তুই তো স্কুলে পড়াশুনা করিস; কি কি বৈশিষ্ট্য থাকলে একজন শিক্ষককে ‘শিক্ষক’ বলা যায়? সে বলল, ‘শিক্ষক হচ্ছেন কিছুটা গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ, তার রাগ থাকে, তার হাতে বেত থাকে, তিনি পড়া দিয়ে দেন আবার পড়া নেন, পড়া না পারলে মারেন ও বকা দেন।’ প্রশ্ন করলাম ছোট ভাইকে শিক্ষকদের দেখে ভয় লাগে তোর? জবাবে বলল, ‘ভয় তো লাগবেই।’ ছোট ভাইটার কথা শুনে অবাক হলাম না, কেননা এটাই স্বাভাবিক, আমাদের চারপাশের অধিকাংশ শিক্ষকেরাই এই বৈশিষ্ট‌্যগুলো ধারণ করেন।

একজন শিক্ষক যখন একজন ছাত্রের কাছে ভয়ের কারণ হন, ওই শিক্ষকের কাছে ছাত্ররা কী শিখবে? একটা ছাত্রের বারবার ভুল হবে এটাই স্বাভাবিক, ভুল না হলে সে কী আর শিখতে আসত? তার বারবার ভুল হয় বলেই তো সে গুরুর কাছে শিখতে আসে। আর গুরু বসে থাকে একটা লাঠি নিয়ে, ভুল হলেই পিটুনি, ভুল হলেই বকুনি, ভুল হলেই পরীক্ষার খাতায় নম্বর কম, ভুল হলেই অপমান।

ছাত্ররা ক্লাসের ভেতর সারাক্ষণ ভয়ে থাকেন, স্যার কখন কী বলে বসেন, কখন কী করে-না করে! ভয়েই ছাত্ররা শিক্ষকদের কাছে যেতে চায় না। আর এভাবে ভয়ভীতি থেকে চাত্র-শিক্ষকদের মাঝে একটা দূরত্ব তৈরি হয়। যার সাথে যার দূরত্বটা বেশি, তার সাথে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতাও অনেক কম, তার প্রতি ভালোবাসা ও সম্মানবোধটাও কম থাকে।

শিক্ষকদের উচিৎ ছাত্রদের কাছে কাছে থাকা, ছাত্রদের বোঝার চেষ্টা করা। ভয় দেখিয়ে নয়, ভালোবেসে ছাত্রদের শিক্ষা দিতে হবে। এ ছাড়া প্রতিটা সম্পর্কের একটা ভিত্তি থাকে; ভিত্তিটা হচ্ছে সম্মানবোধ। একজন শিক্ষক বলতে পারেন যে, আমার ছাত্রকে আমি সম্মানবোধ কীভাবে দেখাব, তাকে তো আমার স্নেহ করতে হবে। হ্যা, স্নেহ তো অবশ্যই করতে হবে, সন্মানবোধও থাকতে হবে। সম্মানবোধ সবসময় সম্পর্ককে শক্তিশালী করে।

বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘আমি জানি যে, আমি কিছু জানি না।’ যখন একজন মানুষ নিজেকে পরিপূর্ণ মনে করেন, তখন তার মধ্যে জ্ঞান আহরণের স্পৃহা কমে যায়। যদি কারো মধ্যে এই বোধটা কাজ করে যে, আমি অনেক কিছু জানি, আমি সব জানি, তখনি তার মধ্যে জন্ম নেয় অহংকারবোধ। আর এই অহংকারবোধ জন্ম দেয় ইগো (অহম), যা একজন শিক্ষক তথা মানুষের জ্ঞানকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। এই ‘অনেক কিছু জানি’ প্রবণতাটা সমসাময়িক শিক্ষকদের মধ্যে খুব বেশি দেখা যায়।

সক্রেটিস শুধু একজন দার্শনিকই ছিলেন না, ছিলেন একজন শিক্ষকও। প্লেটোর মতো দার্শনিক তৈরি করে গেছেন তিনি। সক্রেটিসের দর্শন আজও মানুষ খোঁজে, আজও তার কথাগুলো স্মরণ করে মানুষ। কারণ তার মধ্যে এই বোধটা ছিলো যে, ‘আমি জানি যে, আমি কিছুই জানি না’। আর এই বোধটা যখন মানুষের মধ্যে থাকে, তখন সে চায় তার জ্ঞানের ভাণ্ডারকে ভারী করতে আরো অনেক কিছু শিখতে। একজন শিক্ষককে মনে রাখতে হবে, সে যা জানে তা লিমিটেড। জানার কোনো শেষ নেই, সুতরাং সে নিজেও অপরিপূর্ণ।

সম্পর্কটা শুধু শ্রেণিকক্ষেই সীমাবদ্ধ। সম্প্রতি দেখা যায়, ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে সম্পর্কটা থাকে শুধু ক্লাসরুমেই। ক্লাসরুমকেই জ্ঞান আদান-প্রদানের একমাত্র সোর্স হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছে। অথচ শিক্ষকের সাথে বাইরে গল্প করেও শেখা যায়, সে পরিবেশটা সৃষ্টি করা। ছাত্ররা শিক্ষকদের সান্নিধ্যে যেতেই ভয় পায়, আবার বাইরে গল্প, আড্ডা বা আলোচনা কীভাবে!

কিন্তু একটা সময় ছিলো যখন শুধু ক্লাসরুম নয়, বাইরেও শিক্ষকদের সাথে নির্দিধায়, নির্বিঘ্নে চলাফেরা করার সুযোগ পেত ছাত্ররা। সক্রেটিসকে অনেক শিক্ষক রোল মডেল হিসেবে দেখেন, কিন্তু তার আদর্শ মানে কতজন? সক্রেটিস ছাত্রদের শিক্ষা দিতেন যেকোনো সময়, যেকোনো স্থানে। ছাত্রদের সাথে গল্প, আড্ডাও দিতেন তিনি। এসব একজন শিক্ষকের মর্যাদা কমায় না, বরং একজন মহান শিক্ষক হতে সাহায‌্য করে।

একরৈখিক পাঠদান। সম্প্রতি শিক্ষকদের মধ্যে এই প্রবণতাটা খুব বেশি লক্ষ‌্যণীয়। হাইস্কুলে থাকতে ইংরেজি শিক্ষকের ক্লাসে একটা শব্দের অর্থ জানতে চেয়েছিলাম, এই দোষে তিনি আমাকে বেতের বাড়ি দিয়েছিলেন।! আরেকবার গণিত শিক্ষকের কাছে একটা অংকের সমাধান চেয়েছিলাম বলে বকুনি খেয়েছিলাম! তাদের সাইকোলজি এমন ছিলো যে, ক্লাসে তারা যা পড়াবেন ছাত্রদের তাই পড়তে হবে। তারা যা বলবেন তাই শুনতে হবে। ক্লাস মানে শিক্ষক বলেই যাবেন আর ছাত্ররা তা শুনেই যাবেন।

বর্তমানে অবশ্য শিক্ষকদের মাঝ থেকে এমন প্রবণতা কিছুটা কমেছে। তবে প্রাইমারি বা হাইস্কুলগুলোতে আজও এই অবস্থা চলছে। অধিকাংশ শিক্ষকই একরৈখিকভাবে পড়াতে পছন্দ করেন। ফলে ছাত্রদের সৃজনশীলতা নষ্ট হচ্ছে, আদান-প্রদানমূলক শিক্ষা ধ্বংস হচ্ছে, আর দূরত্বটাও বাড়ছে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যকার।

লেখক: শিক্ষার্থী, জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ‌্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।

 

এসইউবি/সবুজ খান/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়