ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

যে রিভার ভিউতে গাঁথা দুই বধ্যভূমির নির্মমতা

মোঃ আজম খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪৮, ২৩ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যে রিভার ভিউতে গাঁথা দুই বধ্যভূমির নির্মমতা

মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের নির্মমতার সাক্ষী হয়ে আছে বাংলাদেশের অনেক বধ্যভূমি। যেখানে এদেশের মুক্তিকামী মানুষদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।

এরকমই একটি বধ্যভূমি বরিশাল জেলার ‘ত্রিশ গোডাউন’। এখানে গড়ে তোলা হয়েছে স্মৃতি স্তম্ভ ও রিভার ভিউ পার্ক। এটি বর্তমানে বরিশাল জেলার একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান। প্রতিদিন এখানে বেড়াতে আসেন কয়েক হাজার দর্শনার্থী। কিন্তু তাদের অনেকেই হয়তো এর ইতিহাস জানেন না।

মনে করা হয়, বরিশাল বিভাগের সব চাইতে বড় বধ্যভূমি ছিল এটি। ধারণা করা হয় এখানে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল।

‘ত্রিশ গোডাউন’বধ্যভূমি বরিশাল ওয়াপদা কলোনির পাশে। স্থানটি নদীর পাড়ে হওয়ায় হত্যাযজ্ঞের পর লাশ নদীতেই ফেলে দেয়া হতো। বর্তমান বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজও এখানে। ওয়াপদা কলোনিকে যুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদাররা মিনি ক্যান্টনমেন্টে পরিণত করে।

‘ত্রিশ গোডাউন’নামে একটি বধ্যভূমিকে নির্দেশ করলেও মূলত এখানে একসাথে দুটো বধ্যভূমি রয়েছে।

এর একটি ওয়াপদা কলোনির দক্ষিণ পাশে সাগরদী খালের উপর অবস্থিত ‘বাঙ্কার ব্রিজ’নামে পরিচিত ব্রিজ।এই ব্রিজের উপর এনেই দাঁড় করিয়ে গুলি করে নিরীহ মানুষের হত্যা করে সাগরদী খালে ফেলা হতো। অন্যটি হলো ত্রিশ গোডাউন কম্পাউন্ডের পেছন গেট থেকে নদীর পাড় পর্যন্ত বিস্তৃত প্রায় ত্রিশ বিঘা ধানী জমির পুরোটা। মূলত স্থান দুটি প্রায় একসাথে হওয়ায় এদের একটি বধ্যভূমি হিসেবে গণ্য করা হয়।

’কিশোর ইতিহাস: বরিশাল জেলা’নামের গ্রন্থে বলা হয়েছে, নগরী ছাড়াও গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, বানারীপাড়া, উজিরপুর, বাকেরগঞ্জ, স্বরূপকাঠি থেকে নারী-পুরুষ ধরে এনে সিলিংয়ে ঝুলিয়ে অত্যাচার করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হতো এবং পরে গুলি করে হত্যা করা হতো। প্রতি রাতেই হানাদাররা ১০-১৫ জনকে হত্যা করতো।

জানা যায়, ১৯৭১ সালের ৪ মে পাকিস্তানি হানাদাররা পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিস ও আবাসিক বাড়িগুলো দখল করে নেয়। স্থানীয়দের ধরে এনে টর্চার সেলে পরিণত করে। প্রথমে তারা বরিশালের তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক কাজী আজিজুল ইসলামকে এখানে এনে হত্যা করে।

 

 

এরপর ধীরে ধীরে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্তচর, এলাকাবাসী ও বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষদের ধরে এনে নির্মমভাবে অত্যাচার করতো না হয় সরাসরি গুলি করে হত্যা করতো। তারা হাজী আদম আলীকে আহ্বায়ক করে শহরে একটি শান্তি কমিটি গঠন করে। এরপর তারা শহরে লুটতরাজ করে বেড়াতো। রিফিউজিদের দিয়ে এসব কাজ বেশি করতো। এছাড়াও তারা মানুষদেরকে ধরে এনে নদীর পাড়ে একত্রে দাঁড় করিয়ে সরাসরি গুলি করে হত্যা করতো।

তারা বিভিন্ন গ্রাম থেকে নারীদের এনেও নির্মম অত্যাচার করতো এবং ধর্ষণ করতো। তারা নারীদেরকে উলঙ্গ করে রুমের মধ্যে বন্দি করে রাখতো। নারী ধর্ষণ ও অত্যাচারের কথা জানতে পেরে আদম আলী তৎকালীন জেলা প্রশাসককে জানান। কিন্তু এখানের মেজর ইয়াহিয়ার নির্দেশ ছিল তাদের কিছু বলা যাবে না। এরপরই আদম আলী শান্তি কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন।

ওয়াপদায় প্রায় পঞ্চাশটি বাঙ্কার ছিলো। বরিশাল পৌরসভার তিন-চার জন সুইপারকে সার্বক্ষণিক নিযুক্ত করা হয়েছিল শুধু লাশগুলো ঠেলে নদী ফেলে দেবার জন্য। এভাবেই প্রতিদিনই মানুষ ধরে নিয়ে আসা হতো এবং হত্যা করা হতো। তবে কত মানুষকে এভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা কেউ জানতে পারেনি।

ওয়াপদায় পাকসেনাদের নির্মম অত্যাচার সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধা এ এম জি কবীর ভুলু বলেন, ‘বাটাজোর এলাকায় নৌকায় স্টেনগানসহ জুলাই মাসে ধরা পড়ি আমি, আমার বন্ধু আনোয়ার ও নৌকার মাঝি। ধরা পড়ার পর ওরা আমাদের প্রচন্ড টর্চার করে। এরপর ওয়াপদা টর্চার সেলে নিয়ে আসে। তারা মাঝিকে ছেড়ে দেয়, ওদের নির্মম অত্যাচারের আনোয়ার মারা যায়।’

তিনি বলেন, ‘হানাদাররা আমাকে রশিতে বেঁধে অত্যাচার করেছে, পায়ে তলা ও পেট কাচ দিয় ক্ষতবিক্ষত করেছে, চড় দিয়ে আমার বাম কান নষ্ট করে দিয়েছে। এভাবে আমাকে প্রায় ১৯ দিন নির্মমভাবে অত্যাচার করে।’

বর্তমানে ওয়াপদা ও ত্রিশ গোডাউন বধ্যভূমিতে সংঘটিত এসব পৈশাচিক কর্মকাণ্ড ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে সংরক্ষিত করার জন্য বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের উদ্যোগে সরকারি অর্থায়নে স্মৃতি স্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। এ ছাড়াও দর্শনার্থীদের জন্য সাগরদী খাল পার থেকে ত্রিশ গোডাউন ব্রিজ পর্যন্ত বিভিন্ন গাছ, বসার স্থান নির্মাণ করা হয়েছে। ওয়াপদার বাঙ্কারগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে মিনি হলরুম। ওয়াপদার ভিতরের রাস্তা, টর্চার সেল সংরক্ষণ করা হয়েছে। এছাড়া পুরো কম্পাউন্ডে দেয়ালের বেষ্টনী নির্মাণ করা হয়েছে।

নদী তীরের ত্রিশ বিঘা জমিতে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতি স্তম্ভ ও রিভার ভিউ পার্ক। এসব দেখে মানুষ পাকিস্তানি হানাদারদের নির্মমতা জানতে পারে এবং কীর্তনখোলা নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে।

লেখক: শিক্ষার্থী, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।



বরিশাল/মোঃ আজম খান/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়