ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

‘আমার কাছে শিক্ষক মানে সবাই সমান’

হোসনেয়ারা হিমু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৫১, ১৫ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘আমার কাছে শিক্ষক মানে সবাই সমান’

মাত্র অনার্সে পড়ছি। এই ক্ষুদ্র জীবনে অনেক বেশি শিক্ষকের সান্নিধ্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে, আমি সৌভাগ্যবান যে আমার এই ছোট্ট শিক্ষাজীবনে বেশ কিছু মানবিক শিক্ষকের সাহচর্য পেয়েছি। সব শিক্ষকের প্রতিই আমি শ্রদ্ধাশীল। প্রিয় শিক্ষক বলে মাত্র একজন শিক্ষককে বাছাই করা আসলেই কঠিন। কারণ, শিক্ষক বলতে সবাই সমান। 

যদি একজনকে প্রিয় বলি, তাহলে বাকি সবাই কি অপ্রিয়? তা হয় না, আমি সমানভাবে সবাইকে ভালোবাসি এবং শ্রদ্ধা করি। তবে হ্যাঁ, কাউকে বেশি মনে পড়ে। একে যদি বেশি প্রিয় বলে, তাহলে তাঁরা হলেন-ড. মো. মাহবুবুল আরফিন, রফিকুল ইসলাম রাকিব, শরিফুল ইসলাম জুয়েল, জেসমিন আক্তার। এই চারজন শিক্ষক।

পরিবারের মধ্যে আব্বু প্রিয়, না আম্মু প্রিয় এই কথা যদি আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করেন আমি যেমন বলতে পারবো না একজন প্রিয়। তেমনি করে আমি বলতে পারব না এই চারজন শিক্ষকের মধ্যে একজন প্রিয়। একজন নয়, চার জনই আমার প্রিয় শিক্ষক। তাঁরা আমার এই ক্ষুদ্র জীবনের চলার পথে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা, উৎসাহ যুগিয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় আসার আগে অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে বাইরের নির্মম-নিষ্ঠুর পরিবেশের মুখোমুখি হয়ে আসে। বাইরের স্বার্থপর পরিবেশের সাথে কীভাবে খাপ খাওয়াতে হয় তারা শিখে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগেই। কিন্তু আমিই হয়তো একমাত্র ব্যক্তি, যে কিনা স্কুল, কলেজ, কোচিং, কোনো কিছুর জন্য পরিবারকে ছেড়ে বাইরে থাকিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পা বাড়ানোই  আমার জীবনের প্রথম পরিবার ছেড়ে বাইরে থাকার জীবন শুরু। সবাইকে ছেড়ে, চেনাজানা মায়া- জড়ানো পরিবেশ, পরিবার, শহর ছেড়ে অচেনা নিষ্ঠুর পরিবেশে এসে যখন আমি কষ্টে ভেঙে পড়েছিলাম তখন আমার এই কষ্টের সময়, সংকটময় সময়ে সবচেয়ে আমার পাশে পিতা-মাতার মতো ছায়া হয়ে  থেকেছেন  আমার এইচারজন প্রিয় শিক্ষক।

আমার বিভাগের মধ্যমণি সভাপতি ড. মো. মাহবুবুল আরফিন, যিনি শুধু আমার নয় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছে তার পরিবারের খোঁজখবর, আর্থিক অবস্থা, পড়াশোনার খোঁজখবর নিয়ে থাকেন।

ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম ট্যুর ছিল মুজিবনগর। এটা শুধু বিভাগের ১ম ট্যুর ছিল না, আমার জীবনেরও প্রথম ট্যুর ছিল। যাওয়ার সময় আমি বাসের মধ্যে চুপচাপ ছিলাম। শরিফুল ইসলাম জুয়েল স্যার আমাকে বললেন, এই মেয়ে মন খারাপ কেন? আমি যেন মন খারাপ করে না থাকি এই জন্য স্যার তখন বললেন এবার গান গাইবে হোসনেয়ারা। তিনি আরও শিক্ষার্থীকে এভাবে বলেছিলেন চুপচাপ কেন এবার গান গাইবে অমুক, অমুক। কিন্তু অনেকেরই হয়তো কথাগুলো শুনে চোখ ভিজেনি, হৃদয় ছুঁয়ে যায়নি। কারণ তারা এরআগেও হয়তো বাইরের স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের ভালোবাসা কেমন সেটা অনুভব করেছেন।

রফিকুল ইসলাম রাকিব স্যার তিনি আমাকে বলেন, আপনি শুধু ভালো করে পড়াশোনা করবেন। কথাটা শোনার সাথে সাথে দুচোখ জলে ভিজে গিয়েছিল। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো দিকনির্দেশনা দেয়ার মতো কেউ থাকে না। রুমে একা একা ফেরার পথে সারাটাপথ এটাই মনে হয়েছিল, আমাকে ভালো করে পড়তে হবে, আমাকে অনেক বড় হতে হবে।

জেসমিন আক্তার ম্যাম, যিনি আমার সব ধরনের খোঁজ নিয়ে থাকেন। রুমে আটজন থাকায় অনেক সময় রান্নায় সিরিয়াল পড়ে যেত। আমি প্রায় দিনই রান্না করতে পারতাম না। ডাইনিংয়ে খাবার খেলে অসুস্থ হয়ে যেতাম। শিক্ষিকা জেসমিন আক্তার, এই মানুষটা আমার অসুস্থতার সময় খোঁজ নিয়েছেন। রাইচ কুকারে কীভাবে তরকারি রান্না করা যায় শিখিয়ে দিয়েছেন। আমার সকল প্রকার খোঁজখবর নিয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকই কোনো শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করেন না আপনার পরিবারের কী অবস্থা, আপনাকে ভালো করে পড়তে হবে, আপনার মন খারাপ কেন, আপনি খাইছেন কি না, রান্না এভাবে করবেন। এই কথাগুলো যখন আমাকে বলে তখন পিতা-মাতাকে ছেড়ে থাকার শূন্যতার মাঝে, কষ্টের মাঝে চিৎকার দিয়ে বলতে ইচ্ছা হয় আব্বু, আম্মু আমি তোমাদের ছেড়ে এসেছি, কিন্তু তোমাদের মতো করে ভালোবাসার মতো আরেকটা পরিবারের ছায়া আমি পেয়েছি।

শিক্ষক যারা আমাকে কখনো পিতা, বন্ধু ভাইয়ের মতো, শিক্ষিকা কখনো মা এবং বোনের মতো ভালোবাসেন, অনুপ্রেরণা দেন।   আমার পিতা-মাতার মতো চারজনই আমার খুবই প্রিয়।

তাঁদের ভালোবাসা, তাঁদের হাসিমুখ আমার মধ্যে এক ধরনের অনুপ্রেরণা জোগায়। আমাকে অনেক বড় হতে হবে, আমাকে কিছু করতে হবে এমন। যেরকমটা আমার পিতা মাতার মুখ দেখলেও মনে হয়। তাঁদের মন খারাপের চেহারা আমাকে হাজারো চিন্তায় ফেলে দেয়। আমি কি কোনো বেয়াদবি করেছি? আমি কি কোনো অন্যায় করেছি? নাকি তাঁদের অন্য কোনো কারণে মন খারাপ। এরকম হাজারো চিন্তা আমাকে প্রতিনিয়ত ভাবাতে থাকে।

তাদের আদর্শ, শিক্ষা, ভালোবাসা কতটা গভীর না হলে একজন শিক্ষার্থীর মাঝে এমনভাবে ছাপ ফেলতে পারে ও ভাবাতে পারে। শিক্ষক যে কীভাবে একটি হতাশাগ্রস্ত, নির্জীব প্রাণে নব প্রেরণা সৃষ্টি করতে পারেন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষকরা। বলা হয়ে থাকে বাবা-মায়ের পরই শিক্ষকের স্থান। আমার কাছে এই কথাটি কোনো অংশেই মিথ্যা নয়।

দেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষকের মতো আদর্শ শিক্ষকের পদ স্পর্শে সমৃদ্ধ হয়ে উঠুক এটাই আমার প্রত্যাশা।

লেখক: শিক্ষার্থী, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

 

ইবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়