ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

বাইশ পেরিয়ে তেইশে গবি 

অনিক আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০৮, ১৩ জুলাই ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
বাইশ পেরিয়ে তেইশে গবি 

৩২ একরের ছোট্ট ক্যাম্পাস, কিন্তু হাজারো শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ গড়ার মাধ্যম। উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হওয়ার পর দেশের লাখো শিক্ষার্থীর স্বপ্ন নিভে যাওয়ার শঙ্কা থাকে শুধু আর্থিকভাবে খুব বেশি সচ্ছল না হওয়ার কারণে। এদের কথা বিবেচনা করে, তাদের ভবিষ্যতকে একটি সুন্দর পরিণতি দিতে বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে গড়ে ওঠে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

এই প্রতিষ্ঠানের বদৌলতে সেসব শিক্ষার্থীর সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। বলছি বাইশ পেরিয়ে তেইশ বছরে পদার্পণ করা সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা।  আজ ১৪ জুলাই দেশের অন্যতম বৃহৎ এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।

রাজধানীর অদূরে সাভার উপজেলার নলাম গ্রামে ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় গণ বিশ্ববিদ্যালয়। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক জাতি গঠন ও দেশের বিদ্যমান দারিদ্র্যের বিপরীতে উচ্চ শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ প্রতিষ্ঠানটি।

প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই সমাজের নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা যেন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয়, সেদিকে লক্ষ রেখে কাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।  তারই অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে অত্যন্ত কম, যা দেশের অন্যান্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তুলনা করলেই বুঝা যায়। টিউশন ফি কম হলেও শিক্ষার্থীরা তাদের প্রাপ্য কোনো সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না।

অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, গ্রাম ও শহুরে আবহের মিশেলে গড়া প্রতিষ্ঠানটিতে রয়েছে ‘উ’ আকৃতির বিশাল একাডেমিক ভবন। বর্তমানে এখানে ৪টি অনুষদের আওতাধীন ১৬টি বিভাগ চালু রয়েছে।  এছাড়া বেশ কয়েকটি মাস্টার্স কোর্সও চালু আছে।

শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ক্ষেত্রে সহায়তার জন্য যাবতীয় সব প্রয়োজনীয়তা পূরণ করা হয়েছে এবং বাকিগুলো পূরণের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধির জন্য বিষয়ভিত্তিক হাজারো বইসমৃদ্ধ সুবিশাল গ্রন্থাগার, আধুনিক উপকরণ সমৃদ্ধ ল্যাবরেটরি, এজলাস, ভেটেরিনারি হাসপাতাল, ফ্রি ওয়াইফাই সুবিধা ইত্যাদি সবই রয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনামকে এক ধাপ এগিয়ে নিতে ভূমিকা পালন করে চলেছে সর্বশেষ চালু হওয়া ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস অনুষদ। ২০১৬ সালের মে মাসে চালু হওয়া বিভাগটি বর্তমানে দেশের প্রথম ও একমাত্র প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গণ বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ানো হয়। অন্যান্য বিভাগের সাথে তাল মিলিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রেও দারুণ গতিতে এগিয়ে চলেছে নব্য প্রতিষ্ঠিত এই বিভাগটি।

ভেটেরিনারি শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সুবিধাদির সিংহভাগই প্রদান করতে সক্ষম হয়েছে কর্তৃপক্ষ। ভেটেরিনারি ছাড়াও মেডিকেল ফিজিক্স অ্যান্ড বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং, ফিজিওথেরাপি, বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজির মতো বিরল বিষয়ে অধ্যয়নের সুযোগ রয়েছে।

প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই অসাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে বেশ কিছু ব্যতিক্রমধর্মী পরিচয়। পূর্বেও বিভিন্ন বিষয়ে ব্যতিক্রম কিছু করে সুনাম অর্জন করা গণ বিশ্ববিদ্যালয় বছর দুয়েক আগে দারুণ এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। সমাজের অবহেলিত, নির্যাতিত, লাঞ্ছিত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ তথা হিজড়াদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে কাজের সুযোগ করে দিয়েছে প্রশাসন। নিয়োগের পূর্বে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ সদস্যের একটি টিম।

নারীর ক্ষমতায়নের জন্যও ব্যতিক্রমী হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়ে শিক্ষার্থীরা খেলাধুলায় অংশ নিলে ২৫ শতাংশ টিউশন ফি মওকুফের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এতে নারী শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করছে এবং বিভিন্ন বড় বড় টুর্নামেন্ট জয় করছে প্রতিনিয়ত।

গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যতিক্রমধর্মী আরেক পরিচয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ। দেশের প্রথম ও একমাত্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে শুধু এখানেই রয়েছে ছাত্র সংসদ।  দুই বছর পরপর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়। অত্যন্ত সুষ্ঠু পরিবেশে শিক্ষার্থীদের ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচন হয়।

এমনিতে ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও সুস্থ ধারার রাজনীতি চর্চায়ও শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি পূরণে কাজ করে চলেছে ছাত্র সংসদ। এছাড়াও দেশের প্রথম ও একমাত্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ২০১৩ সালে যাত্রা শুরু করে গণ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (গবিসাস)। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই অত্যন্ত সফলতার সাথে কাজ করে যাওয়া গবিসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ও সুনাম অক্ষুন্ন রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।

সংগঠন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রায় দারুণ ভূমিকা রাখে। ক্যাম্পাসে বর্তমানে ১৮টি সংগঠন রয়েছে, যাদের মধ্যে বেশকিছু সংগঠন সত্যিকার অর্থেই প্রশংসনীয় কাজ করছে। রক্তদাতা সংগঠন বৃন্ত, ডা. এড্রিক বেকার ব্লাড ফাউন্ডেশন, সাংস্কৃতিক সংগঠন অগ্নিসেতু, ডিবেটিং সোসাইটি, সাধারণ ছাত্র পরিষদ, মিউজিক কমিউনিটি, কালেরকন্ঠ শুভসংঘ, সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট সেন্টারসহ সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ কাজ করার চেষ্টা করছে।

গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব গৌরবময় অর্জন তথা সাফল্যের ক্ষেত্রে খেলাধুলার ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। ক্রীড়াক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।  শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার সুযোগ-সুবিধাকে অগ্রাধিকার দিতে রয়েছে কেন্দ্রীয় ফুটবল ও ক্রিকেট মাঠ, বাস্কেটবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন ও টেনিস কোর্ট।

সরকারের খেলাধুলার প্রতি গুরুত্বের দিকটাকে সম্মান জানিয়ে এখানে পড়ালেখার পাশাপাশি ক্রীড়াক্ষেত্রকে আলাদাভাবে স্থান দেওয়া হয়েছে। প্রতিবছরে দুইবার ক্রীড়া উৎসবে মেতে ওঠে পুরো ক্যাম্পাস। ফুটবল, ক্রিকেট, হ্যান্ডবল, ভলিবল, বাস্কেটবলসহ নানা ইভেন্টে আন্তঃবিভাগীয় টুর্নামেন্ট হয়।

ব্যতিক্রমধর্মী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি পাওয়া প্রতিষ্ঠানটি ক্রীড়াক্ষেত্রেও রেখেছে ব্যতিক্রমধর্মী পরিচয়। এত দিন ক্রিকেট বাদে খেলাধুলার প্রতিটি ইভেন্টে মেয়েরা অংশগ্রহণ করলেও গত বছর প্রথমবারের মতো দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে মেয়েদের ক্রিকেট চালু করা হয়েছে।

ধারাবাহিকভাবে খেলাধুলাকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দেওয়ার পুরস্কারও পেতে শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। গত বছরের মার্চ-এপ্রিলে দেশের সরকারি-বেসরকারি ৬৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গবন্ধু আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় স্পোর্টস চ্যাম্প’১৯। এতে মোট ১০টি ইভেন্টের সাতটিতে অংশগ্রহণ করে চারটিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে গণ বিশ্ববিদ্যালয়।  ইভেন্ট চারটি হচ্ছে-মেয়েদের ফুটবল, ক্রিকেট, হ্যান্ডবল ও ছেলেদের ফুটবল।

প্রতিযোগিতার সমাপনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু জাতীয় ফুটবল স্টেডিয়ামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিজয়ীদের নিজ হাতে পুরস্কার প্রদান করেন। এছাড়া গত বছর অনুষ্ঠিত ফারাজ গোল্ডকাপ ফুটবলেও চ্যাম্পিয়ন হয় গণ বিশ্ববিদ্যালয়।

শুধু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েই নয়, জাতীয় পর্যায়ে ক্রীড়াক্ষেত্রেও অবদান রাখছে এখানকার খেলোয়াড়েরা। বাংলাদেশ জাতীয় প্রমীলা ফুটবল দলের অধিনায়ক সাবিনা খাঁতুন, জাতীয় প্রমীলা হ্যান্ডবল দলের তারকা খেলোয়াড় ছন্দা রানী সরকার গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবিষ্কার।  এছাড়াও আরও বেশ কিছু খেলোয়াড় রয়েছে, যাদের ক্রীড়া নৈপুণ্য গর্ব করার মতো। 

উদ্ভাবনেও পিছিয়ে নেই প্রতিষ্ঠানটি। গত বছরের শেষের দিকে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের (সিএসই) শেষ বর্ষের ৬ শিক্ষার্থী উদ্ভাবন করেন রোবট ‘মিরা’। বিভাগ থেকে দেওয়া প্রজেক্টের অংশ হিসেবে উদ্ভাবনকৃত এই রোবট দেশের নামকরা টেলিভিশন, পত্রিকা, ম্যাগাজিনগুলোতে ফলাও করে প্রচার হয়।

উদ্ভাবনের নেশা চলতি বছরেও থেমে থাকেনি।  তবে এবারের উদ্ভাবন শুধু ক্যাম্পাস নয়, বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের জন্যই উপকারী এবং সময়োপযোগী। এ বছরের মার্চে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হলে র‌্যাপিড টেস্ট কিট উদ্ভাবনের ঘোষণা দেয় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।

ঘোষণা অনুযায়ী নানা বাধা পেরিয়ে করোনা টেস্টিং কিট উদ্ভাবন করে তারা। আর এই উদ্ভাবক টিমের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. বিজন কুমার শীল। মাত্র ৫ মিনিটে ফলদায়ক এই কিট করোনার সার্বিক পরিস্থিতি নির্ধারণে দারুণ ভূমিকা রাখবে।  যদিও সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এখনো এই কিটের অনুমোদন মেলেনি।

এমনই নানা উদ্ভাবনের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে গণ বিশ্ববিদ্যালয়।  সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এমন দুর্বার গতিতে পথচলা সামনে আরও ভালো কিছুরই ইঙ্গিত দেয়।  যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আরও এগিয়ে যাবে প্রাণের ক্যাম্পাস।  সমৃদ্ধ হবে অর্জনের ভান্ডার, এগিয়ে যাবে দেশ। বাইশ পেরিয়ে তেইশ বছরে পদার্পণকালে এটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার চাওয়া।

লেখক: শিক্ষার্থী, ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস অনুষদ (৩য় বর্ষ), গণ বিশ্ববিদ্যালয়। 


গবি/মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়