ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

অতঃপর জেগে দেখি ঈদের বয়স একদিন...

অনি আতিকুর রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫৮, ৪ আগস্ট ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
অতঃপর জেগে দেখি ঈদের বয়স একদিন...

জীবনের প্রথম কোনো ঈদ; যেদিন নামাজ আদায় করে ঘরে ফিরে মাছ দিয়ে ভাত খেলাম। তাও আবার কোরবানির ঈদ। ভাবছেন, মাছ কোরবানি হয়েছে নাকি! না না, ঠিক তা নয়। পরিস্থিতির শিকার। অবশ্য মাছ খেতে যে অপছন্দ বিষয়টি একেবারেই তেমন নয়। তবে, মাংস ছাড়া কোনো উৎসব ‘কেমন কেমন’ লাগে তাই বলা আর কি!

যাহোক, মাছ খেয়ে ঈদ পালনের দিনটিতে আরেকটি রেকর্ড অর্জন হয়েছে। তা হলো- প্রথমবার বাড়ির বাইরে ঈদ পালন। আমার দু’দশক বয়সের জীবনে কখনো বাবা-মা, পরিবার ছাড়া ঈদ করার অভ্যাস নেই। বছরের দুটি দিন বাসায় খুব আনন্দ-আমেজেই কাটে আমাদের। তবে কোরবানির ঈদটা স্পেশাল মনে হয়। এজন্য এই ঈদে তিন ভাইবোন যে যেখানেই থাকি পারতপক্ষে বাড়ি ফিরি। 

আম্মু-আব্বুও সারা বছর সন্তানদের দূরে রেখে অভ্যস্ত হলেও এই সময়টা কাছে না পেলে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। বারবার ফোন করে খোঁজ নেন, কবে আসবো, কখন আসবো, ছুটি কবে, ক’দিন ছুটি থাকে ইত্যাদি-ইত্যাদি। সম্ভবত, সব বাবা-মায়ের বেলাতেই এটা ধ্রুব।

আমাদের এবারের ঈদটা কাটলো ঢাকায়। গুলশানের এক বহুতল ভবনের চার দেয়ালের মাঝেই। সঙ্গে ছিলেন আমার একমাত্র বোন। আমার সঙ্গে ছিলেন বললে ভুল হবে, আমিই তাঁর সঙ্গে ঈদ করলাম। কারণ, তিনি লেখাপড়া ও চাকরি সূত্রে ঢাকার বাসিন্দা। আর আমি এখন তারই বাসায়।

ঈদকে ঘিরে আমাদের তেমন কোনো বাড়তি প্রস্তুতি নেই। নতুন কেনাকাটা কিংবা আলাদা কোরবানি। আগের দিন শুক্রবার হওয়ায় পাঞ্জাবি-পাজামা পরেই জুমার নামাজ পড়লাম। এসেই খুলে রাখলাম। কারণ, ওগুলোই কাল পরবো।

জুমার নামাজ থেকে ফিরে দুপুরের খাবার শেষে ফোন নিয়ে বসলাম দুই ভাইবোন। নিজেদের ব্যস্ত রাখতে নেটে ডুবে গেলাম। কৃত্রিম এ ব্যস্ততার কারণটা হলো- ঈদের আগের দিনের আনন্দটা যেন আমাদের নস্টালজিক করে তুলতে না পারে। কার চাঁদরাতটা আরেকটি ঈদের মতো। চাঁদরাতের দিন থেকে ঈদের জন্য মধুর অপেক্ষার প্রতিটি সেকেন্ড-মিনিট-ঘণ্টাই যেন আনন্দের। কিন্তু আমরা দুই ভাইবোন তো সেটার উল্টো ফিল করছিলাম। 

কোনো জিনিসের উত্তম ব্যবহার না হলে তা উল্টো ক্ষতির কারণ হতে পারে। তেমনি, ঈদ খুশির বার্তা নিয়ে এলেও পরিবারহীন দূর পরবাসী হয়ে তা যেন কষ্টের কারণ হয়ে উঠেছে আমাদেরও। ফলে এই অপ্রত্যাশিত কষ্ট কিছুটা আড়াল করতেই এই নেট দুনিয়ার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলার অপচেষ্টা। অর্থাৎ একদিন পর যে ঈদ তা মনকে বুঝতে না দেওয়া। কারণ, বুঝতে পারলেই মন খারাপ হয়ে যাবে। চোখের সামনে ভেসে উঠবে আম্মু-আব্বুর মুখ, বাসায় থাকা বৃদ্ধ দাদা-দাদির মুখ।

কিন্তু শাক দিয়ে কি আর মাছ ঢাকা যায়? বারবার আড়াল করতে চাইলেও জোয়ারের পানির মতো মস্তিষ্কের শিরা-উপশিরা নিংড়ে বেরিয়ে আসছে স্মৃতির কণিকা। ছোটবেলার স্মৃতিও হাতছানি দিয়ে যাচ্ছে আমাকে ‘এই যে আমায় দ্যাখো’ বলে।

অনেক দিন ধরেই বাইরে থাকি কিন্তু বাড়ির কথা এত মনে পড়ে নি কখনো! কিন্তু এবার যেন মন মানছেই না। ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে শেকড়ের টানে। 

বাড়ির কথা মনে হতেই কল্পনায় ভেসে উঠছে নানা জিনিস। গ্রামের সেই মেঠোপথ, বাড়ির আঙিনা, সবুজ মাঠ, পুকুরপাড় কিংবা গ্রামের ঈদগাহ ময়দান। মনে পড়ছে, ফি বছর এ সময়ে কয়েক দিনের প্রস্তুতিসহ ব্যাগ গুছিয়ে রওয়ানা হওয়া।

দীর্ঘ যাত্রার পর গাড়ি থেকে নেমেই এলাকার মুখ পরিচিত ভ্যানে ‘ভাড়া না মিটিয়েই’ উঠে পড়া। গ্রামের রাস্তায় গায়ে বাতাস লাগিয়ে চলার সময় ভানচালককে এটা-ওটা প্রশ্ন করা। তার গভীরতাহীন উত্তর থেকেই এলাকার হাল-চাল অনুমান করা। চিরচেনা সেই রাস্তার দু’পাশে তাকানো আর বুক ভরে শ্বাস নেওয়া। জনপদে পৌঁছে কৌতুহলী চোখে অবকাঠামোর পরিবর্তন দেখা। তারপর বাড়ির দরজায় নেমে ‘আম্মু আম্মু, দাদি দাদি’ বলে চিৎকার করে দরজা খুলতে বলা। অতঃপর দরজা খোলামাত্র অনেক দিন পর আত্মার আত্মীয়দের মুখগুলো দেখতে পেয়ে সালাম বিনিময়ের পর খুশিতে জড়িয়ে ধরা। এসবই ভেসে উঠছে কল্পনার রঙিন স্ক্রিনে।

এর মধ্যে ফেসবুকের নতুন কোনো নোটিফিকেশন এলেই বিছানায় ফোন হাতে নিজেকে আবিষ্কার করি।

কিছুক্ষণ বাদেই আবার হারিয়ে যাই কল্পনায়। মনে পড়ছে- বাড়িতে কেনা এবারের কোরবানির পশুটা দেখতে কেমন? প্রিয় সন্তানদের দূরে রেখে আব্বু আম্মুর মুখটাই বা কেমন মলিন হয়ে আছে? স্মৃতিদের এমন খুনসুটি যেমন কষ্টের; তেমনি কল্পনার এ ছবিগুলো দেখতে পাওয়া মাঝে মাঝে স্বস্তিদায়কও বটে।

অদ্ভুত এই অবসরে স্মৃতি হাতড়ে ফিরে যাচ্ছি, গতবার কিংবা তারও আগের কোনো ঈদে। কি কি কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছিলাম সে দিনগুলোতে। চাঁদরাতের আনন্দ-ফুর্তি; রাতে দেরিতে ঘুমুতে যাওয়া। অতঃপর আম্মুর হাঁকডাক শুনে সকালে ধুপধাপ ঘুম থেকে উঠা; ঝিমুঝিমু চোখে গোসলখানায় সিরিয়াল ধরা। শীতকালের ঈদে কুসুম গরম পানিতে গোসল করা। নতুন পোষাক পরে ঈদগায়ে যাওয়া, নামাজ শেষে পরিচিতদের সঙ্গে কোলাকুলি করা। ফিরে এসে কোরবানিতে অংশ নেওয়া। বড়দের কাছে সেলামি নেওয়া, ছোটদের দেওয়া। আরও কত কি!

একবার অবশ্য সিন্ধান্ত হয়েছিল বাসায় যাচ্ছি ঈদ করতে। কিন্তু পরক্ষণেই শুনলাম, আপুর ছুটি কমে গেছে। তাই আর হলো না। এখানেও ফেসবুকে সবাইকে শুভেচ্ছা আদান-প্রদানেই কেটে গেলো ঈদের আগের রাত। সকাল সাতটায় ঈদের জামায়াত। বিশ মিনিট আগে জায়গা পেলাম। তড়িঘড়ি করে উঠে গোসল সেরে পাঞ্জাবি-পাজামা পরে সিঁড়িতে নামতে নামতেই বোতাম লাগালাম, ঘড়ি পরলাম। তারপর নামাজ শেষে ফিরে আসতেই আপু খেজুর খেতে দিলেন। তারপর ভাত, সাথে তরকারি হিসেবে বড় সড় মাছ। পরে বিভিন্ন মিষ্টান্নসামগ্রী। ভাবলাম কোরবানির ঈদে মাছ! এ কোন ঈদ রে বাবা! তারপরও আমি মুখ বুজে খেয়ে ফেললাম। ভাবলাম আহা ভাগ্য! 

মাঝে একবার আপুকে বলেই ফেললাম, এই প্রথম কোনো ঈদ, যেখানে আমার মাছ দিয়ে ভাত খেতে হলো। মনে মনে ভাবলাম, বাড়ি থেকে পাঠানোর আগ পর্যন্ত হয়তো মাংস খাওয়া নসিবে নেই। তবে কপালে থাকলে নাকি কান ধরে খাওয়ানো হয়। তেমনই হলো-সন্ধ্যায় রান্না করা দুই বাটি মাংস চলে এলো বাসায়। সাথে আরও অনেক মিষ্টান্ন। 

এগুলো পাঠিয়েছেন আমাদেরই এলাকার এক কাকি। উনারাও সপরিবারে ঢাকায় থাকেন। রাতে ওসবই খাওয়া-দাওয়া হলো। তারপর ঘুমালাম। অতঃপর ঘুম থেকে উঠে দেখি ঈদের বয়স একদিন।

 

লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

ইবি/মাহি 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়