ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

প্রকৃতির সুধা পানে রাতারগুল 

জাকারিয়া মোহাম্মদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:০০, ৫ আগস্ট ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
প্রকৃতির সুধা পানে রাতারগুল 

রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ। নিচে স্বচ্ছ নীল জলরাশি। জলের গভীরে অনেক দূর পর্যন্ত আগাছা দেখা যায়। মাঝেমধ্যে দেখা যায় ঘন সবুজ গাছপালায় আচ্ছাদিত টিলা। যেন ওই জল আর আকাশের মাঝে কেউ সবুজ রঙ লেপে দিয়েছে পরম যত্নে। 

শান্ত ও স্বচ্ছ জল কেটে তরতর করে এগিয়ে চলছে ইঞ্জিনচালিত নৌকা। উদ্দেশ্য বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন স্পট সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা-রাতারগুল।

দীর্ঘ চার মাস কোয়ারেন্টাইনে থেকে মনটা কেমন যেন লাগছিল। বদ্ধ পরিবেশে থেকে মনটাও আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল সংকীর্ণ কারাগারে। বিষিয়ে উঠছিল সবকিছু। তাই ঘুরতে বের হওয়া। বন্ধুদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঈদের দ্বিতীয় দিন৷ ভ্রমণে বৈচিত্র্য আনার জন্য স্থল পথের বদলে জলপথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত।

সিলেট শহর থেকে যাত্রা শুরু করলাম সকাল ৮টায়। সুরমা নদী থেকে যাত্রা শুরু করলেও ঘণ্টাখানেক পরই নদী ছেড়ে আমরা প্রবেশ করি একটা ছোট্ট খালে। খালের দুই পাশে ঘন বাঁশঝাড় আর ঘরবাড়ি। মাঝি ও তার সহকারিসহ আমরা ৮ জন। খাল পেরিয়ে আমরা এবার গিয়ে পড়লাম হাওরে।

নীল আকাশের নিচে হাওরের বিশাল জলরাশি মনে সম্ভ্রম জাগায়। মাঝিকে জিজ্ঞেস করে জানলাম সৌন্দর্যে ভরপুর এই হাওরের নাম বাঘা বড় হাওর। নামে বড় হাওর হলেও এটা সিলেটের অন্য হাওরের তুলনায় অনেক ছোট। কারণ সিলেটেই রয়েছে এশিয়ার সবচেয়ে বড় মিঠাপানির হাওর-হাকালুকি হাওর। রূপ বৈচিত্র্যে যা অনন্য।

হাওরের অপরূপ সৌন্দর্য দেখে চেঙ্গির খাল হয়ে আমরা প্রবেশ করলাম গোয়াইন নদীতে। প্রচুর ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলে এখানে। মনে হচ্ছে এই অঞ্চলের মানুষ এখনো যাতায়াতের জন্য নৌকার ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পারেননি। নদীর দুই ধারের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম রাতারগুলের দিকে। তীরে কখনো গাছের জঙ্গল, কখনো ছোট্ট বাজার আবার কখনো ছোট ছোট গ্রাম দেখা যাচ্ছে। নদীর পাড়ের বাড়িগুলো এখনো কাঁচা। চোখে পড়ল মাটির দেয়াল আর কাঁশের তৈরি চালের অনেক ঘর।

দেড়-দুই ঘণ্টা নৌকা চলার পর প্রবেশ করলাম রাতারগুলে। স্বচ্ছ পানির মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে নানা ধরনের গাছ। সারাবছর এভাবেই পানির মধ্যে থাকে গাছগুলো। জলে নিম্নাঙ্গ ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বনের গাছগুলো দেখতে বিভিন্ন সময়ে, বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে এখানে ভিড় করেন পর্যটকরা। এসবই এখানকার প্রধান আকর্ষণ।

বিশেষ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা (রাতারগুল) বা রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট বাংলাদেশের একমাত্র মিঠাপানির জলাবন এবং বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য। সিলেটের গোয়াইনঘাটে অবস্থিত এই বনের আয়তন ৩,৩২৫.৬১ একর। এর মধ্যে ৫০৪ একর বনকে ১৯৭৩ সালে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এছাড়াও ২০৪.২৫ হেক্টর বনভূমিকে ৩১ মে ২০১৫ তারিখে বাংলাদেশের বন অধিদপ্তর বিশেষ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা ঘোষণা করে।

এই বন মূলত প্রাকৃতিক বন হলেও বাংলাদেশ বন বিভাগ, বেত, কদম, হিজল, মুর্তাসহ নানা জাতের জলসহিষ্ণু গাছ লাগিয়েছে। এছাড়া জলমগ্ন এই বনে রয়েছে হিজল, করচ আর বরুণ গাছ। আছে পিঠালি, অর্জুন, ছাতিম, গুটিজাম। আছে বট গাছও। এখন পর্যন্ত এখানে সর্বমোট ৭৩ প্রজাতির উদ্ভিদের সন্ধান পাওয়া গেছে।

জলাবন দেখতে দর্শনার্থীদের জন্য একটা ওয়াচ-টাওয়ার নির্মাণ করেছে কর্তৃপক্ষ। ফলে অনেক উচ্চতা থেকে পুরো এলাকা দেখা যায়। আমাদের নৌকা সেই ওয়াচ-টাওয়ারের কাছে ভিড়লো। উপরে ওঠে দুইচোখ ভরে উপভোগ করলাম প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য।

দেখলাম পানিতে গোসল করছে অনেকেই। সাঁতার কাটছে তারা৷ স্বচ্ছ টলটলে পানি দেখে সাঁতার কাটার লোভ সংবরণ করা শক্ত। ফলে যা হওয়ার তাই হলো। পুরো এলাকা ঘুরে দেখার পর ফেরার পথ ধরলাম বিকেল ৪টার দিকে৷ সন্ধ্যের পর আকাশে উজ্জ্বল চাঁদ। চাঁদের আলোয় রহস্যময় হাওরে বইছে মৃদু হাওয়া। রাতের নীরবতা ভেঙ্গে শব্দ করে এগিয়ে চলে নৌকা।

 

লেখক: শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

চবি/মাহফুজ/মাহি 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়