ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

চামড়া শিল্পে দুর্দিন, প্রয়োজন সমন্বিত নীতিমালা

আহমেদ ফাহিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:০৭, ১২ আগস্ট ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
চামড়া শিল্পে দুর্দিন, প্রয়োজন সমন্বিত নীতিমালা

দেশের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানি খাত হলো চামড়া শিল্প। এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াজাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার মাধ্যমে এদেশের অর্থনীতির চাকা সচল হয়। রপ্তানি খাতে বর্তমানে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের অবদান প্রায় ৯ শতাংশ। 

জিডিপি ও শিল্পোৎপাদনে চামড়ার অবদান যথাক্রমে ০.৬ শতাংশ ও ২ শতাংশ। ২০২১ সালের মধ্যে চামড়া খাত থেকে ৫০০ কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ২০১৭ সালে চামড়াকে ‘প্রডাক্ট অব দ্য ইয়ার’ ঘোষণা করেছিল সরকার। কিন্তু গত কয়েক বছর যাবত এই খাতে কমেছে আয়। ফলে বিপর্যয়ের মুখে এই শিল্প।

বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)- এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চামড়া শিল্পের রপ্তানি আয় ছিল ১১৬ কোটি ৯ লাখ ৫ হাজার মার্কিন ডলার যা ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ বেড়ে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে হয় ১২৩ কোটি মার্কিন ডলার। এরপর থেকেই এ শিল্পের আয় নিম্নমুখী হতে শুরু করে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চামড়া শিল্পের রপ্তানি আয় ২০১৬-১৭ অর্থবছরের চেয়ে ১২ দশমিক ০৩ শতাংশ কমে দাঁড়ায় ১০৮ কোটি ৫৫ লাখ ১ হাজার মার্কিন ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ শিল্পের রপ্তানি আরও কমে হয় ১০১ কোটি ৯৭ লাখ ৮ হাজার মার্কিন ডলার যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরের তুলনায় ৬ দশমিক ০৬ শতাংশ কম। সবশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে চামড়া শিল্পের রপ্তানি আরও কমে হয় ৭৩ কোটি ৯৩ লাখ ৯ হাজার মার্কিন ডলার।

চামড়া শিল্পের প্রধান কাঁচামাল চামড়ার দাম গত এক দশকে কমেছে প্রায় অর্ধেক। কিন্তু চামড়া ও চামড়াজাত সব পণ্যের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। বাংলাদেশে প্রতি বছর ১ কোটি ৬৫ লাখ পিস কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয় অর্থাৎ সব মিলিয়ে ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। আর এই চামড়ার প্রায় অর্ধেকই পাওয়া যায় কোরবানি ঈদের সময়। করোনা ও বন্যার কারণে এবার কমেছে কোরবানির সংখ্যা, ফলে চামড়া সংগ্রহের পরিমাণ ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কমেছে। চামড়ার দামও হয়েছে নিম্নগামী।

এ বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, যা গত বছরগুলোর তুলনায় ২০ থেকে ২৯ শতাংশ কম। গত দুই বছরে (২০১৮ ও ২০১৯) কোরবানি ঈদে ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ছিল ৪০-৫০ টাকা এবং প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়ার দাম ছিল ১৮-২০ টাকা। এ বছরের  বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত দাম অনুযায়ী, ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৩৫ থেকে ৪০ টাকা নির্ধারণ হয় এবং ঢাকার বাইরে নির্ধারণ হয় প্রতি বর্গফুট ২৮ থেকে ৩২ টাকা। সারাদেশে খাসির চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় প্রতি বর্গফুট ১৩ থেকে ১৫ টাকা।

সরকারের নির্ধারিত দাম অনুযায়ী বড় আকারের গরুর চামড়ার দাম পড়ার কথা ১২শ থেকে ১৬শ টাকা। মাঝারি গরুর চামড়ার দাম ৮০০ থেকে ১১০০ টাকা এবং ছোট আকারের গরুর চামড়ার দাম ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু কোনো ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়নি। মনে হচ্ছে পানির দরে বিক্রি হয়েছে কোরবানির পশুর চামড়া। অনেকে দাম না পেয়ে চামড়া পুঁতে রেখেছেন আবার কেউ কেউ ফেলেছেন নদীতে। শুধু এবারই নয়, গত কয়েক বছর ধরে চামড়ার দামে এ বিপর্যয় চলছে।ফলে অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ি চামড়া কিনে ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে না পারায় সর্বস্বান্ত হয়েছেন। 

বর্তমানে বিশ্ববাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের ২২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজার রয়েছে। বিশাল ওই বাজারে বাংলাদেশ মাত্র ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করে। উৎকৃষ্ট মানের পশু চামড়া উৎপাদনে বহুকাল ধরে এদেশের সুখ্যাতির পাশাপাশি  আন্তর্জাতিক বাজারে এদেশের পাদুকা ও অন্যান্য  চামড়াজাত পণ্যেরও রয়েছে বিপুল চাহিদা। চামড়া শিল্প থেকে প্রতি  বছরে বাংলাদেশ এক বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করে থাকে। এ খাতের সম্ভাবনা দিন দিন বাড়লেও দীর্ঘসময় যাবত চামড়া রফতানি আয় নিম্নমুখী হয়েছে এবং কাঁচা চামড়ার দামও হয়েছে নিম্নমুখী।

বিশেষজ্ঞদের মতে, চামড়া শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে এ খাতে ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির পাশাপাশি সম্ভাবনাময় এ শিল্প খাতে প্রায়  ৫০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান তৈরি করা সম্ভব। চামড়া শিল্পে ধস কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন এই  শিল্পের আধুনিকীকরণ ও রপ্তানি বাড়ানো। এ ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রয়েছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ঘাটতি, ট্যানারির অবকাঠামোগত উন্নয়নের ঘাটতি। জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার জন্য সম্ভাবনাময় এই শিল্পের উন্নয়নের  বিকল্প নেই। এই শিল্পের অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। চামড়া শিল্পকে এগিয়ে নিতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে-

১. চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের উপকরণের অভাব দূরীকরণের পাশাপাশি লবণ ও অন্যান্য ব্যবহৃত কেমিক্যালের মূল্য না বাড়ানো

২. ট্যানারির অবকাঠামোগত ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন

৩. সরকারের আর্থিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং প্রশিক্ষিত জনবল তৈরির লক্ষ্যে আরো লেদার টেকনোলজি ইনস্টিটিউট স্থাপন ও কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে।

৪. ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা ও চামড়া শিল্পের জন্য আলাদা শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।

৫. চামড়া শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে।

৬. চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধিতে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকে আরো কার্যকর করতে হবে।

৭. উপযুক্ত নীতিমালা নির্ধারণ করা।

৮. চামড়ার মৌসুমে সরকারের পক্ষ থেকে সহজ শর্তে ঋণসহ চামড়া চোরাচালান বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ।

৯. চামড়া সংগ্রহে সঠিক ব্যবস্থাপনা, বাজার মনিটরিং, দ্রুত সংরক্ষণ, পরিবহন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ।

১০. উন্নতমানের চামড়া প্রস্তুত করার সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি  বহুমুখী চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনে উদ্যোক্তাদের সুযোগ বৃদ্ধি।

 

লেখক: শিক্ষার্থী, নোবিপ্রবি

নোবিপ্রবি/মাহফুজ/মাহি

রাইজিংবিডি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়