আত্মহত্যা: দায়ী সমাজব্যবস্থা
মিথিলা দেবনাথ ঝিলিক || রাইজিংবিডি.কম
জিনগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই বেঁচে থাকার প্রবণতা রয়েছে মানুষের। দুঃসহ জটিল অবস্থার মধ্যেও সবাই বেঁচে থাকতে চায়। ব্যক্তির জিনগত বৈশিষ্ট্য, মানসিক অবস্থা, সাংস্কৃতিক ও আর্থসামাজিক পরিবেশ ও অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ের জটিল মিথস্ক্রিয়াই আত্মহত্যার জন্য দায়ী। মানুষ যখন সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সেই বিচ্ছিন্নতাই আত্মহত্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
সম্পর্কজনিত নানা জটিলতা, যেকোনো ব্যর্থতা (প্রেমে প্রত্যাখ্যাত, বিচ্ছেদ, পরীক্ষায় ফল বিপর্যয়, আকস্মিকভাবে সামাজিক অবস্থান পরিবর্তন ও কষ্টকর শারীরিক রোগ) ইত্যাদির কারণে অনেকে আত্মহত্যা করেন। কিন্তু এ ধরনের আত্মধ্বংসী প্রতিক্রিয়া কখনোই স্বাভাবিক নয়। এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতামত তুলে ধরছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মিথিলা দেবনাথ ঝিলিক।
মারিয়া জান্নাত মিষ্টি, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
হীনমন্যতা, বিষণ্নতা, হতাশা, নিজের প্রতি বিতৃষ্ণাসহ নানা কারণে আত্মহননের পথ বেছে নেন অনেকে। মনে রাখা উচিৎ দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী। দুনিয়ায় পাওয়া সামান্য কষ্ট থেকে মুক্তির জন্য আমরা আত্নহত্যা করি। কিন্তু আত্মহত্যার জন্য পরকালের নির্ধারিত যে শাস্তি তা বহুগুণে বেদনাদায়ক। কোনো ধর্মই আত্মহত্যাকে সমর্থন করে না। সবার উচিৎ এ ধরনের জঘন্য কাজ থেকে নিজেদের বিরত রাখা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা ও ধৈর্য ধারণ করা।
আত্মহত্যার পেছনে সমাজই অনেকাংশে দায়ী। মানুষের সঙ্গে মানবিক আচরণ করা জরুরি। আত্মমর্যাদা রক্ষার জন্যই মানুষ আত্মহত্যা করে। তাই মানুষকে মর্যাদা দিতে হবে। আসুন আত্মহত্যাকে না বলি। জীবনকে ভালোবাসতে শিখি।
হিরা সুলতানা, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ
কেন মানুষ নিজের প্রিয় জীবনটাকে স্বেচ্ছায় বিসর্জন দেয়? অনেকে মনে করেন, শুধু অভাব-অনটন কিংবা আর্থিক সমস্যার কারণেই মানুষ আত্মহত্যা করে। কিন্তু সবসময় এটি সঠিক নয়। একাডেমিক কিংবা ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সফল মানুষটিও আত্মহত্যা করে।
বলিউড অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের আত্মহত্যার কথা জানি আমরা। কেন একজন সফল অভিনেতা আত্মহত্যা করলেন? সে প্রশ্ন বারবার উঠে আসছে। ঢাবি ছাত্র এক মেয়েকে ভালোবাসে আত্মহত্যা করে ফেলেছেন। মৃত্যুর আগে তিনি ফেসবুকে বারবার জানান দিয়েছেন। এরকম অসংখ্য আত্মহত্যার খবর আমরা রোজই পাই।
মানসিক অসুস্থতার কারণেই ঘটে আত্মহত্যা। ডিপ্রেশন। এই ডিপ্রেশন জিনিসটা আসলে কী? কেন এ ডিপ্রেশনে ভোগে মানুষ? ডিপ্রেশন হচ্ছে সেই রোগ যেটি মূলত চাওয়া-পাওয়ার পার্থক্যের কারণে সৃষ্টি হয়। এই ডিপ্রেশন মূলত অনেকটাই সামাজিক আর পারিবারিকভাবে সৃষ্ট। অমুকের ছেলের এত রেজাল্ট, তোর নাই কেন? ওমুকের দুটা গাড়ি, আমাদের নাই কেন? আমার কী নাই যে, সে আমাকে ছেড়ে চলে গেল? এরকম শত শত প্রশ্ন মনে জেগে ওঠে। হীনম্মন্যতা সৃষ্টি হয় এভাবে। সেখান থেকেই আসে আত্মহত্যা।
সমাজ আরোপ করে- বিসিএস ক্যাডার হওয়া লাগবেই, নইলে জীবন বৃথা। জিপিএ ফাইভ লাগবেই ইত্যাদি। এসব নিয়ে মনের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া নানা জল্পনা-কল্পনা কাছের বন্ধুটিও হয়তো বুঝতে পারে না। এভাবে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে একসময়। এভাবে মানসিক স্বাস্থ্য অবহেলিত হতে থাকে। এরপরই আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
সচেতন হওয়া দরকার সবার। অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বের হতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবতে হবে। ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলার চেষ্টা করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে সাফল্য না পাওয়ার জন্য চলে যাচ্ছি, সেটুকু কি আদৌ প্রয়োজন আছে? এভাবে ভাবলে হয়তো আত্মহত্যা কিছুটা হ্রাস পাবে।
সাদিয়া নওশিন বিন্তি, পরিসংখ্যান বিভাগ
যুবসমাজে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আত্মহত্যার পেছনে অনেক কারণ আছে। মূখ্য কারণ ডিপ্রেশন। যারা ডিপ্রেশনে ভোগেন তারা বন্ধু বা পরিবারের সঙ্গে কথা বলুন। পরিবারের সদস্য বা বন্ধু কিংবা সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলে অনেকটা আশ্বস্ত হওয়া যায় বিপদকালে।
আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়- এ কথা বলার জন্য বলা নয়। কাজেও প্রকাশ করতে হবে। আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে এমন মানুষকে সঙ্গ দিতে হবে আমাদের। সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে তাদের প্রতি।
তানজিলা তাবাসসুম অন্তি, ফিন্যান্স বিভাগ
আত্মহত্যা একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যা। এটিকে গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র (ডব্লিউএইচও) মতে বিশ্বজুড়ে বছরে প্রায় ৮ লাখের মতো মানুষ আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করে থাকেন। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করছেন। আর সাম্প্রতিক তথ্যানুসারে বর্তমানে বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১১ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করেন। দেখা গেছে, ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর পেছনে দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে আত্মহত্যা।
আত্মহত্যা প্রবণতারোধে করণীয়
১. সঙ্গে সঙ্গে রায় না দিয়ে তারা কী বলছে শুনুন। তাদের অভিজ্ঞতা বা আবেগকে অশ্রদ্ধা করবেন না।
২. আত্মহত্যা প্রতিরোধে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ব্যাপকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
৩. মাদকাসক্ত ব্যক্তি, মানসিক রোগী, অভিবাসী, বেকার ও সাংস্কৃতিকভাবে শ্রেণিচ্যুতদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। এ কারণে তাদের প্রতি বিশেষ সহায়তা কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন।
৪. আমাদের দেশে যৌতুক, পারিবারিক নির্যাতন এবং উত্ত্যক্তকরণের ফলে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। এসব দূর করার জন্য প্রয়োজন নারীশিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়ন। নারীর প্রতি নারী-পুরুষ সবার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করাও আত্মহত্যা প্রতিরোধের অন্যতম উপায় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
রুকাইয়া মিজান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। সমাজবিজ্ঞানীরা আত্মহত্যাকে সামাজিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করেছেন। প্রখ্যাত ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম তাঁর ‘The Suicide’ গ্রন্থে আত্নহত্যার ৪টি কারণ তুলে ধরেছেন। এগুলো হলো- আত্মকেন্দ্রিকতা, নৈরাজ্য, পরার্থ ও হতাশা। আত্মহত্যার কারণ হিসেবে আমরা খুঁজে পাচ্ছি প্রেমে ব্যর্থতা, হতাশা, বিশ্বাসঘাতকতা, ব্ল্যাকমেইল, বেকারত্ব, পরীক্ষায় ফেল বা আশাহত ফলাফল, বঞ্চনা, তীব্র মানসিক চাপ ও পারিবারিক জটিলতা।
চিকিৎসকরা আত্মহত্যাকে মানসিকচাপের চড়ম রূপ বলে গণ্য করেছেন৷ এই আত্মহত্যাকে নিমূর্ল করতে সমাজের সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন। আর মানবিকতার বিকাশ ছাড়া হয়তো এর নির্মূল কোনোদিনই সম্ভব না।
জবি/মাহফুজ/মাহি
আরো পড়ুন