ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

যে বইয়ে গুরু-শিষ্যের মিতালি 

মেহেদী হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০৪, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০  
যে বইয়ে গুরু-শিষ্যের মিতালি 

বাংলাদেশি লেখক, ঔপন্যাসিক, কবি ও চিন্তাবিদ আহমদ ছফার লেখা ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইটির কথা বলছি। বইটি পড়ার পর এক রকমের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক স্যার কিছু লিখে যাননি।

অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে নিয়ে লেখা বইটিতে ওঠে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান, দাবাড়ু নিয়াজ মোরশেদকে ছোটবেলায় দাবা খেলা শেখানোর আলোচনা, সমাজের সাধারণ ও এলিট শ্রেণির মানুষের মনস্তাত্বিক কাঠামো, পুরান ঢাকার খাদ্যাভ্যাসের কিয়দাংশ, অমর্ত্য সেনের অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা, জাতীয় কবি নজরুলের বাঁশি শোনা, রবীন্দ্রনাথ, দেবেন ঠাকুর, কেশব সেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কিংবা শেক্সপিয়র ও রাশিয়ার সামান্তবাদ নিয়ে সমালোচনা।

পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের সঙ্গে রাজ্জাক সাহেবের স্মৃতিকথার সুন্দর বর্ণনা আছে বইটিতে। আহমদ ছফা রাজ্জাক স্যারের ছাত্র। ছাত্র শিক্ষকের এমন মেলবন্ধন আর আন্তঃসম্পর্ক সত্যিই ভাবিয়ে তোলে। আবদুর রাজ্জাক স্যার- এক পায়া ভাঙা কাঠের চৌকিতে থাকতেন। মোটা খদ্দেরের কাপড় পরতেন। ছেঁড়া গেঞ্জি আবার তাতে বড় বড় ফুটো। কথা বলতেন পুরান ঢাকার ভাষায়।

বাজার করতেন নিজে। আবার রান্নাও জানতেন। নিজে লেখালেখি না করলেও রাজনীতি, ধর্ম, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, বিশ্ব ইতিহাসের উত্থান-পতন কিংবা শিল্পসাহিত্য বিষয়ে গড়গড় করে বিশেষজ্ঞের মতো মতামত দেওয়ার ক্ষমতা রাখতেন।

আহমদ ছফা অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের উচ্চারিত বিভিন্ন কথার ব্যাখ্যা করেছেন। কোথাও স্যারের বক্তব্যের সঙ্গে নিজের বক্তব্য সুনিপুণভাবে জুড়ে দিয়েছেন। স্যারের কথার উপযুক্ত পরিপ্রেক্ষিত উপস্থাপন করেছেন। লেখক এখানেই মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন।

শুধু তাই নয়, এমন জ্ঞানী ব্যক্তির কথার প্রতিবাদও করেছেন লেখক। আবার শিক্ষক হয়েও ছাত্রকে নিজের কাছে বসিয়ে খাবার খাইয়েছেন। প্রয়োজনে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। এমনকি ভালোবেসে লেখককে- ‘মৌলভী আহমদ ছফা’ বলে ডাকতেন এই শিক্ষাগুরু।

রাজ্জাক স্যার উল্লেখ করার মতো কিছু লেখেননি কেন? অনেক আলোচক-সমালোচকের মতো এমন প্রশ্ন বইটির লেখক আহমদ ছফারও। লেখক এ বিষয়ে এক যুক্তি খণ্ডন করেছেন। লেখক বলেন- যৌবনে যে মানুষ ট্রটস্কির থিয়োরি ওব পার্মানেন্ট রেভুলিউশনের বাংলা এবং অবন ঠাকুরের ইংরেজি অনুবাদ করেছেন, সেই মানুষের পক্ষে অন্য কোনো মামুলি বিষয়ে কাজ করা অসম্ভব।

‘১৯২১ সাল থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন ছাত্রও আইসিএস পাস করেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা বিষয়ে যে গবেষণা হয়েছে তার বেমিরভাগই চাকরির প্রমোশনের উদ্দ্যেশ্যে লেখা।’ ঢাবি শিক্ষকদের নিয়ে তার এরকম কঠিন সত্যির প্রকাশ ঘটেছে বইটিতে।

আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান নিয়ে আব্দুর রাজ্জাক স্যারের কথা মুদ্রণ করা হয়েছে যত্নসহকারে। পাকিস্তান আন্দোলনের মনস্তাত্ত্বিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত তৈরি করা, বাংলা ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বদান উঠে এসেছে বইয়ে। আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সংকল্প ও কর্মপন্থার দিক নির্দেশনাসমূহের আলোচনাও।

শুধু এতটুকুই নয়। আবদুর রাজ্জাক ও আহমদ ছফার কথাপোকথনে লেনিন-মার্ক্স, হেনরি কিসিঞ্জার আর ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে আলোচনাও বাদ যায়নি। শিল্প বিল্পব নিয়ে তার উক্তি- ‘কার্ল মার্ক্স- এর হিসাব মতো গ্রেট ব্রিটেন কিংবা শিল্পসমৃদ্ধ জার্মানিতেই বিল্পব হওয়ার কথা। রাশিয়াতে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে কিছুতেই সম্ভব নয়। লেলিন-মার্ক্সীয় চিন্তা-পদ্ধতিতে একটু অদলবদল ঘটিয়ে রাশিয়াতে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে একটা বিল্পব সম্পন্ন করার জন্যই রাশিয়ার অর্থনৈতিক ইতিহাসটি লিখেছিলেন।’

এই বইটি ইতিহাসে একটা জায়গা করে নিয়েছে। কারণ, তৎকালে আমেরিকান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে উল্লেখ করা, পাকিস্তানের ধর্মাতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার আলোচনা, জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ স্বাধীনে অবদান এসব বিষয়ে মূল্যবান মন্তব্য, জওহরলাল নেহেরুর ক্ষমতায় আরোহন, বাংলা একাডেমির আমলাতান্ত্রিক স্বভাবসহ মুক্তিযুদ্ধকালীন কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেশ ভালোভাবে উল্লেখ করা আছে বইটিতে।

কোনো জাতি কোন দিকে যাচ্ছে বোঝার জন্য দুটো জিনিস দেখতে হয়। এক, তাদের লাইব্রেরিতে কি ধরনের বই থাকে মানে কি বই পড়ে। আরেকটি হলো রান্নাঘর, তারা কী খায়। আবার রাজনীতিবিদ শহীদ সাহেব, শরৎ বোস, তাজউদ্দিন, সোহরাওয়ার্দীকে নিয়েও আলোচনা বাদ পড়েনি গুরু-শিক্ষকের।

বইটি জ্ঞানপিপাসুদের জ্ঞানতৃষ্ণা হাজারো গুণ বাড়িয়ে দেবে এটা বলা যায়। যে মানুষ জীবদ্দশায় কিছু লেখেননি। কিন্তু তাকে নিয়ে লেখক আহমদ ছফার এমন সুন্দর আবিস্কার সত্যিই চিন্তার জগতে সাড়া ফেলে। লেখক আহমদ ছফা ইহলোক ত্যাগের বছর তিনেক আগে ঢাকা থেকে ১৯৯৮ সালে মাওলা ব্রাদার্স প্রথম প্রকাশ করে ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইটি।

লেখক: সদস্য, রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি

রাজশাহী/মাহফুজ/মাহি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়