ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

সুবর্ণগ্রাম: যেখানে রূপের চাষ হয়

রাইয়ান জিহাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:১৮, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০  
সুবর্ণগ্রাম: যেখানে রূপের চাষ হয়

সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ। এর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নানা বৈচিত্র্য। যেমন ঈশা খাঁর স্মৃতিবিজড়িত প্রাচীন সুবর্ণগ্রাম সোনারগাঁও। নারায়ণগঞ্জ জেলার অন্তর্গত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মোগড়াপাড়া ক্রসিং থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার উত্তরে সোনারগাঁও অবস্থিত। সবুজ বন-বনানী আর অনুপম স্থাপত্যশৈলীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য়ের নান্দনিক ও নৈসর্গিক পরিবেশে ঘেরা বাংলার প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁও। মনে হয়, যেখানে প্রতিনিয়ত রূপের চাষ হয়। 

পুরো পৃথিবী যেমন করোনা মহামারিতে স্তব্ধ আমরাও এর বিপরীত নই। গত সাত মাস ধরে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আমাদের জীবন যেন অসল হয়ে পড়েছে। তাই আমরা একটু আনন্দময় সময় কটানোর জন্য সোনারগাঁও যাব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম।   

গত ২০ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টায় আমরা পাঁচ বন্ধু সোনারগাঁওয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। আমরা সকাল সাড়ে ১০টায় পৌঁছে যাই মোগড়াপাড়া বাস স্টেশনে। ওখান থেকে খাওয়া-দাওয়া শেষে বেরিয়ে পড়ি সোনারগাঁও জাদুঘরের উদ্দেশ্যে। ১০ মিনিট পর পৌঁছে গেলাম সোনারগাঁও জাদুঘরে। সেখানে টিকেট কাউন্টার থেকে জন প্রতি ৫০ টাকা করে টিকেট কিনে চলে গেলাম জাদুঘরের ভেতরে।  

ভেতরে ঢুকতেই চোখ পড়ে যায় একটা গরুর গাড়ির ভাস্কর্যের উপর। শুধু এই ভাস্কর্য নয়, এখানে রয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ভাস্কর্য এবং জয়নুল আবেদিন ভাস্কর্য, সংগ্রাম ভাস্কর্য, বনজ, ফলজ ও শোভাবর্ধনকারী বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ, লোকজ রেস্তোরাঁ, কারুপল্লী, বিক্রয়কেন্দ্র, বিনোদন স্পট, পাঠাগার এবং নৌকাভ্রমণের ব্যবস্থাসহ আরও নানা আয়োজন।

আর এসব দেখেই আমরা সবাই ব্যস্ত হয়ে যাই ছবি তুলতে। সোনারগাঁও জাদুঘরের প্রধান বৈশিষ্ট্য গ্রামীণ সব আসবাবপত্র, ঘর-বাড়ি, কৃষি যন্ত্রপাতি, নকশি কাঁথা, হাড়ি-পাতিল, নারীদের অলঙ্কার প্রভৃতি। প্রবেশ পথের মুখেই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের বিখ্যাত চিত্রকর্ম অবলম্বনে বানানো গরুর গাড়ির ভাস্কর্য। তিন তলা বিশিষ্ট জাদুঘরের বিভিন্ন নিদর্শন দেখতে দেখতে দর্শনার্থীরা হারিয়ে যান গ্রামবাংলার চিরচেনা ঐতিহ্যে। তিন তলা জাদুঘর দেখে যেন মন ভরে না। বার বার দেখতে মনে চায়।

জাদুঘর থেকে অল্প একটু দূরেই রয়েছে পাঠাগার। পাঠাগারের পরিবেশটা ছিল আনেক নিরব। নিরব থাকার কারণ হচ্ছে পাঠাগারে ঢোকার দরজায় একটা নোটিশ ঝুলানো ছিল। নোটিশে বলা হয়েছিল পাঠাগারের ভেতর কোনো প্রকার কথা বলা যাবে না। মোবাইল বন্ধ করে প্রবেশ করার জন্য বলা হয়েছিল। তাই পাঠাগারে বেশি মানুষ দেখতে পাইনি। বিভিন্ন ধরনের বই দিয়ে পাঠাগারটাকে সাজিয়েছে। এইরকম নীরব আর মনোরম পরিবেশে বই পড়ার মজাই আলাদা। যদিও সময়ের অভাবে বেশিক্ষণ থাকতে পারিনি পাঠাগারে। 

পাঠাগারের একটু সামনে যেতেই চোখে পড়ল একটা শাড়ির দোকান। ঐ শাড়িগুলো এত সুন্দর ছিল যে, আমার মনে হয় কোনো মহিলা দেখলে না নিয়ে আসবেই না। যদিও শাড়ির দাম একটু চওড়া। শুধু শাড়ি না, ঐ খানের সব কিছুর দামই দ্বিগুন।      

জাদুঘর চত্বর এলাকা ঘুরে সবাই চলে যাই জাদুঘরের সামনের একটা রেস্তোরাঁয়। সেখানে দুপুরের খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে পড়ি পানাম নগরের উদ্দেশ্যে। জাদুঘরের সামনে থেকে একটা গাড়ী দিয়ে চলে যাই পানাম নগর। বাংলার ঐতিহ্যের স্মারক মধ্যযুগীয় শহর পানাম নগরী। লোনা ইট-কালো পাথরের টেরাকোটা ধূসর স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঈশা খাঁর প্রতিষ্ঠিত বাংলার প্রথম রাজধানী সোনারগাঁর উপশহর ‘পানাম নগরী’ বড় নগর, খাস নগর, পানাম নগর-প্রাচীন সোনারগাঁওয়ের এই তিন নগরের মধ্যে পানাম ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। 

এখানে কয়েক শতাব্দী পুরনো অনেক ভবন রয়েছে, যা বাংলার বারো ভূঁইয়াদের ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত। সোনারগাঁওয়ের ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই নগরী গড়ে ওঠে। ঔপনিবেশিক ধাঁচের সারি-সারি দোতলা ও একতলা বাড়ি। আছে নিখুঁত নকশার উপাসনালয়, গোসলখানা, পান্থশালা, দরবার হল ও নাচঘরের অবশিষ্টাংশ। ইতিহাস থেকে জানা যায়, পানাম নগরী পৃথিবীর ১০০টি ধ্বংসপ্রায় ঐতিহাসিক শহরের একটি।

পানাম নগর ঘোরাঘুরির শেষে রওনা হলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। তখন বাজে সন্ধ্যা সাতটা মোগড়াপারা বাস স্টেনে আসতেই শুরু হয় মুশলধারা বৃষ্টি। অল্প কিছুক্ষণ পরেই দেখি বৃষ্টি একটু কমতে লাগল। সারাদিন রৌদ্রে থাকার পর আমরা সবাই একটু ক্লান্ত হয়ে পড়ি। তাই আশেপাশের একটা হোটেলে হাল্কা নাস্তা করেই অপেক্ষা করতে লাগলাম বাসের জন্য। অনেকক্ষণ পরে একটা বাস এসে দাঁড়ায় আমাদের সামনে। ঐ বাসে করেই আমরা চলে আসি। 

সব মিলিয়ে সোনারগাঁওয়ের সৌন্দর্য ও গুরুত্ব কতটা সেটা সেখানে না গেলে কখনোই অনুধাবন করা সম্ভব হতো না। সত্যি বলতে, ভ্রমণ শুধু আনন্দই দেয় না, অনেক কিছুই শেখায় এবং আমাদের জ্ঞান ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে। তাই সবারই উচিৎ বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণ করা।

লেখক: শিক্ষার্থী, মোল্লাকান্দি লালমিয়া পাইলট হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ, দাউদকান্দি। 

কুমিল্লা/মাহি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়