ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

যেভাবে রোধ হবে ধর্ষণ

মিরাজ উদ্দীন সিফাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২৬, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৬:০৩, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০
যেভাবে রোধ হবে ধর্ষণ

বর্তমানে দেশ তথা পুরো বিশ্ব গ্রাস করেছে প্রত্যক্ষ এক মহামারি করোনা। কিন্তু পরোক্ষভাবে আমাদের বিবেকবোধের আড়ালে এক মহামারি আমাদের গ্রাস করেছে, সেটা ‘ধর্ষণ’। এ ধর্ষণের ভয়ানক থাবা থেকে রেহাই পাচ্ছে না কন্যা শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধা নারীও। 

আগেকার দিনে ধর্ষণ নামক শব্দটা শুনলেই যেখানে শরীর শিউরে উঠত, বর্তমান সময়ে সেটাতো পত্রিকায় নিয়মিত প্রতিবেদন ছাপানোর অন্যতম খোরাক। পত্রিকার পাতা উল্টালেই দেখা যায় এসব বিভৎস নিউজ। এ অপরাধের জন্য ধর্ষকদের যথাযথ বিচার না হাওয়ায় তারা দিন দিন সাহস পাচ্ছে এবং অপরাধের মাত্রাও ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের সমাজ ও সভ্যতার ভাবধারাকে পাল্টে দিতে এসব ধর্ষকরা আসন পেতে বসেছে। 

ধর্ষণ আইনে ধর্ষণকে সংজ্ঞায়িত করা হয় ঠিক এভাবে, যদিও নারী সংস্থাগুলো এই সংজ্ঞা নিয়ে আদৌ সন্তুষ্ট নয়। এই আইনে বলা হয়েছে, পুরুষাঙ্গ নারী-যৌনাঙ্গের ভেতরে প্রবেশ না করলে সেটি ধর্ষণ বলে গণ্য হবে না। অথচ পুরুষ বহুভাবেই নারীর উপর যৌন অত্যাচার (sexual assault) করতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত, ধর্ষণ আইনের আওতায় এগুলো পড়বে না। ধর্ষণ (Rape) আইন (Penal Code) একজন পুরুষ তখনই ধর্ষণ করেছে বলে গণ্য হবে, যখন দুজনেরই যৌন-সংসর্গ ঘটেছে; (১) সেই নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে,(২) সেই নারীর সম্মতি ছাড়া, (৩) সেই নারীর সম্মতি নিয়ে, কিন্তু সেই সম্মতি আদায় করা হয়েছে তাকে বা তার কেন প্রিয়জনকে হত্যা বা আঘাত করা হবে বলে ভয় দেখিয়ে, (৪) নারীটি সম্মতি দিয়েছে এই বিশ্বাসে যে, পুরুষটি তার স্বামী, যদিও পুরুষটি জানে সে মহিলাটির স্বামী নয়, (৫) নারীটি যখন সম্মতি দিয়েছে, তখন সে প্রকৃতিস্থ ছিল না অথবা পুরুষটি বা অন্য কারো দেওয়া হতবুদ্ধিকর বা বাজে কোনো বস্ত খেয়ে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ছিল- ফলে এই সম্মতি দানের পরিমাপ বোঝার ক্ষমতা তার ছিল না, (৬) নারীটির সম্মতি থাকুক বা না থাকুক তার বয়স ১৬ বছরের কম। এ ব্যাপারে ব্যতিক্রম আছে, (ক) স্বামী-স্ত্রীর যৌন মিলনকে কোনো ক্ষেত্রেই ধর্ষণ বলে ধরা হবে না, যদি না স্ত্রীর বয়স ১৫ বছরের কম হয়, অথবা আদালতের নির্দেশে স্বামী-স্ত্রী আলাদাভাবে না থাকে।

যৌন হয়রানি শুধু নারীর বিরুদ্ধে নয়, মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপরাধ। বিশ্বের যেসব দেশে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ বেড়ে চলেছে, সেখানে এশিয়ায় ভারত ও বাংলাদেশর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা হয়ে থাকে। খুন, ধর্ষণ আজকাল এই আধুনিক পৃথিবীর নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হলেও আমাদের দেশে এর মাত্রা যেন সব সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরাধীর যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত না হাওয়া। আবার অনেকাংশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্লিপ্ততা ও তাদের তৎপরতাও দায়ী। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে যথেষ্ট শক্তিশালী আইন থাকা সত্ত্বেও নির্যাতনকারী বিভিন্ন উপায়ে পার পেয়ে যায়। এমনকি ধর্ষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আইন ভারতের চেয়েও শক্তিশালী। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) এর ৯(১)ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে, তবে সে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। একই আইনের ৯(২) ধারায় বলা আছে, ধর্ষণ বা ধর্ষণ পরবর্তী কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। একই সঙ্গে জরিমানার কথাও বলা হয়েছে। সর্বনিম্ন ১ লক্ষ টাকা। ৯(৩) ধারায় আছে, যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং ঐ ধর্ষণের ফলে নারী বা শিশু মারা যায়, তাহলে প্রত্যেকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড, কমপক্ষে ১ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হবে। ধর্ষণের ক্ষেত্রে ভারতের চেয়েও বাংলাদেশের আইন শক্তিশালী বলার কারণ হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে  ভারতের আইন হলো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

মহিলা আইনজীবী সমিতির এক জরিপে জানা যায়, নানা কারণে ধর্ষণ মামলার ৯০ শতাংশ আসামি খালাস পেয়ে থাকে। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রশাসনে দলীয় লোক থাকার কারণে এসব ঘটনার অপরাধীরা প্রায় ধরা- ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় পার পেয়ে যাওয়ার আরেক কারণ। সেই কারণে আমাদের শুনতে হচ্ছে তনুদের আর্তচিৎকার, এই তো গত ২৫ তারিখের ঘটনা, খাগড়াছড়িতে এক উপজাতি মেয়ে ধর্ষণ এবং তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে তার মা-বাবা, তার কাপড়ের পেছনটায় লেগে আছে রক্তের দাগ। এই আপমান শুধু তার এবং তার পরিবারের নয়, দেশের মানুষের জন্যও অপমান ও লজ্জাজনক। সুতরাং এ বিষয়ে জনগণকে প্রতিরোধ গড়ে তোলতে হবে এবং ধর্ষকদের সামাজিকভাবে বর্জন করতে হবে। তাহলেই ধর্ষকদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে। 

আইনে যাই থাকুক না কেন আমাদের সমাজের অতি রক্ষণশীলতা এবং পারিবারিক সমস্যাকে গোপন রাখাই ধর্ষণকারীদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে বিরাট অন্তরায়। যৌন নির্যাতন তথা ব্যভিচার সর্বযুগে সর্বধর্মমতে নিকৃষ্টতম পাপাচার। 

কোনো অপরাধ কখনো নিঃশেষ করা যায় না কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সেটাই আমাদের করতে হবে, যেকোনো মূল্যে ধর্ষণের মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের বানিয়েছি ভোগের বস্তু। এ মন-মানসিকতা দূর করতে হবে। আর আমরা প্রায়ই বলে থাকি পোশাকই ধর্ষণের জন্য দায়ী, কিন্তু এ কথাটা পুরোপুরিভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ অনেক শিশুওতো ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে তো নারীরা বোরকা পরিধান করার পরও ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। আমাদের দেশে অনেক নারী কর্মী আছেন, যারা এখানে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এসব ঘটনাকে কীভাবে বলবেন পোশাকের কারণে ঘটেছে। তাই পুরুষকে মন মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। 

ধর্ষণরোধে আমাদের সমাজকে সচেতন হতে হবে। আমাদের মানবিক গুণাবলী জাগ্রত করতে হবে। অবাধ মেলামেশা, পর্নো সংস্কৃতির নামে অশ্লীল নাটক-সিনেমা, নাচ-গান, বই-ম্যাগাজিন ইত্যাদি মানুষকে প্রবলভাবে ব্যভিচারে প্ররোচিত করে এবং তা বর্জন করতে হবে। ধর্মীয় ও যৌন শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি, সমাজ থেকে খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন যদি রোধ করতে চাই, তাহলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ঢাকা/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়