ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়: যাকে নিয়ে আমি গর্ব করি

কামারুজ্জামান শানিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩৩, ২০ অক্টোবর ২০২০  
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়: যাকে নিয়ে আমি গর্ব করি

‘এই মাম্মা একটু দাঁড়ান, লেজি বয় দৌঁড়ায়া আইতাছে। এসে বাসে পা দিতেই পুরো বাস কোলাহলে পরিপূর্ণ, ‘ব্যাটা সারাজীবন অলসই থাকবি? প্রতিদিন তোর দেরি হয় কেন?’ এভাবেই শুরু হয় একটি সকাল। 

দোতলায় জানালার পাশের সিটে বসে বাইরে তাকিয়ে স্নিগ্ধ আলোর রঙিন ভোরে, প্রশান্তিময় পরিবেশে নির্মল বাতাসে, তথাকথিত বখাটে ছেলেদের ন্যায় বড় বড় চুল উড়িয়ে, সকালটা উপভোগ করতে করতে লাল বাস এসে হাজির হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কাটানো প্রতিটি দিবস এভাবেই শুরু হয়। অতঃপর ক্লাস শুরু হওয়ার পূর্ব অবধি তো আড্ডা চলে শান্ত চত্বরে! 

কেউ কেউ ক্যাফেটেরিয়ায় খাবার নিয়ে খোশগল্পে নিমজ্জিত হয়ে যায়। কেউ টিএসসিতে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হাজারো দুষ্টুমিতে মাতিয়ে তুলে মুহূর্তগুলো। কেউ কাঁঠালতলায় রঙ-তুলি আর আর্টপেপার নিয়ে আপন চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে ছবি আঁকতে থাকে। আবার কেউ উসকো খুসকো চুল, সাদা পাঞ্জাবি, গোল চশমা পরিহিত অবস্থায় ভিসি ভবনের পেছনে ডায়েরি কলম হাতে নিয়ে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দূর আসমানের পানে।

হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই বলছি। সেই ছোট্ট ক্যাম্পাসটি যখন ভবিষ্যৎ গঠনের কারিগরদের পদচারণায় মস্ত কোলাহলে মুখরিত হয়, তখন মনে হয় এখানে কিছু সজীব প্রাণ রয়েছে, কিছু ভালোবাসায় সিক্ত মুহূর্ত, কিছু আবেগ, কিছু মায়া, কিছু সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকা।

ক্যাম্পাস হিসেবে হয়তো অনেকেরই পছন্দের তালিকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থাকে না। পুরান ঢাকার সেই প্রাচীন স্কুল থেকে কলেজ এবং পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর হওয়া এই ক্যাম্পাস হয়তো দিতে পারেনি আশানুরূপ খোলামেলা সুন্দর পরিবেশ। হয়তো অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় এখানে নেই সুবিশাল এলাকা। রয়েছে আবাসন সংকট, রয়েছে ক্লাসরুম সংকট, রয়েছে শিক্ষাউপকরণ সংকট। তবুও কেন এখানকার শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যাম্পাসকে এতটা ভালোবাসে? কেন এই সীমাবদ্ধতাকে এতটা আপন করে নিয়েছে?

কারণ, এই ক্যাম্পাসে রয়েছে প্রাণ, রয়েছে সাফল্য, রয়েছে ঐতিহ্য, রয়েছে নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে টিকে থাকার প্রেরণা। রাজনীতি কিংবা প্রভাবশালীদের দাপটে একে একে বিলীন হয়ে যাওয়া ১১টি আবাসিক হল ও তাদের শেওলা ধরা জীর্ণশীর্ণ দেয়াল যেন ফিসফিসিয়ে বলে দেয়, ‘আমিই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়’। 

হয়তো অর্থনৈতিক দূরাবস্থা মোকাবিলা করে মেসে বসবাস করা একজন দরিদ্র শিক্ষার্থী তার সাফল্য নিয়ে সবার সম্মুখে মাথা উঁচু করে বলে দেয়, ‘আমিই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়’। এ যেন সেই চার্লস ডারউইনের ‘সার্ভাইবল অব দ্য ফিটেস্ট’। ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেই যখন প্রাচীন নিদর্শনের ন্যায় ভিসি ভবন আর শীতল বাতাসে কৃষ্ণচূড়ার দোল খাওয়া লালচে পরিবেশ গোচরীভূত হয়, তখন যেকোনো ব্যক্তির কাছেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমাবদ্ধতাকে তুচ্ছ মনে হবে। মনে হবে প্রবেশ করেছে এক স্বপ্নের রাজ্যে। যেন প্রতিটি দিবসই মেতে ওঠে উৎসবে।

বেলা গড়াতেই দেখা যায় শহীদ মিনারের সামনে কেউ গিটার হাতে টুংটাং করছে আর গলা ছেড়ে গান গাইছে। কেউ ইনডোর গেমে মেতে উঠছে। দাবা, ক্যারাম কিংবা টেবিল টেনিসে। আবার কেউ দলবল নিয়ে ক্রিকেট কিংবা ফুটবল খেলতে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে (ধুপখোলা মাঠে)। এ যেন এক উৎফুল্ল পরিবেশ। যেখানে নেই কোনো হতাশা, নেই কোনো গ্লানি। 

বিকেলে আবার সেই লাল বাসে বাসায় ফিরে আসার আনন্দ যেন নতুন মাত্রা যোগ করে। যাত্রাপথে বাসে জমে ওঠে দারুণ আড্ডা। কেউ পেছনের দরজায় গলা ছেড়ে গান গেয়ে উপভোগ করে ভ্রমণটা। ভালো লাগে, যখন বেসুরা গলায় সম্মিলিত কণ্ঠে গানের শব্দ শুনে মানুষ ঊঁকি দেয় লাল বাসটার দিকে। ভালো লাগে, যখন দূর থেকে কোনো এক বয়স্ক লোক ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে কল্পনায় ফিরে যায় তার যৌবনে কাটানো সময়গুলোতে।

শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়কে কতটা ভালোবাসে তা ব্যাখ্যা করা দায়। বলা হয়ে থাকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রত্যেকে একেকজন উন্মাদ। এরা ক্যাম্পাসের তুচ্ছ বালুকণাকেও আপন করে নেয়, যেন পবিত্র ধুলিতে মাখিয়ে নেয় নিজেকে। আবার এদের দ্বারাই গড়ে ওঠে অন্যায়ের প্রতিবাদ। এরা কখনও অন্যায়কে মেনে নিতে পারে না। কারণ, সংকট কিংবা সীমাবদ্ধতার মাঝে বেড়ে ওঠা মানুষগুলো অনেক বাস্তববাদী এবং প্রতিবাদী হয়। তাইতো এরা কর্মক্ষেত্রেও এতটা সফল হয়।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার সদরঘাটে অবস্থিত একটি স্বায়ত্তশাসিত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। পূর্বতন জগন্নাথ কলেজকে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঘোষণার মাধ্যমে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু। 

অধ্যাপক ড. এ কে এম সিরাজুল ইসলাম খান এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে ১৮৫৮ সালে এবং ২০০৫ সালে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫ পাস করার মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নেয়।

উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে যাত্রা শুরু হয় ব্রাহ্ম স্কুল নামের একটি পাঠশালার। ব্রাহ্ম আন্দোলনের নেতা দীননাথ সেন, অনাথবন্ধু মৌলিক, পার্বতী চরণ রায়, ব্রজসুন্দর মিত্র প্রমুখের ঐকান্তিক চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় এই স্কুল।

উচ্চমানের পার্থিব শিক্ষার সঙ্গে ব্রাহ্ম ধমের্র মূল মতবাদ সম্পর্কে সাধারণ ছাত্রদের জানানোর জন্য আরমানিটোলায় ব্রাহ্ম সমাজের নিজস্ব প্রাঙ্গণে চালু করা হয় এই অবৈতনিক স্কুল। ব্রাহ্ম স্কুলের প্রতিষ্ঠাকাল সম্পর্কে কিছুটা বিতর্ক রয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠাতা অনাথবন্ধু মৌলিক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যালেন্ডারের তথ্যমতে ১৮৫৮ সালকে সঠিক হিসাবে ধরা হয়।

আর্থিক সংকটের কারণে ১৮৭২ সালে মালিকানা পরিবর্তন করে ব্রাহ্ম স্কুলের ভার তুলে দেওয়া হয়েছিল বালিয়াদির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরীর হাতে। তখন জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরী ব্রাহ্ম স্কুলের নাম পরিবর্তন করে তাঁর বাবা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে জগন্নাথ স্কুল নামকরণ করেন। এরপর থেকেই জগন্নাথ স্কুলের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। পরবর্তী সময়ে ১৮৮৪ সালে এটি দ্বিতীয় শ্রেণির কলেজ এবং ১৯০৮ সালে প্রথম শ্রেণির কলেজের মর্যাদা লাভ করে।

১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ সময় স্নাতক কার্যক্রম বন্ধ করে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে অবনমন করা হয় জগন্নাথ কলেজকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার সাজাতে নিজেদের গ্রন্থাগারের ৫০ ভাগ বই দান করে জগন্নাথ কলেজ। নিউমার্কেট এলাকায় জগন্নাথের সম্পত্তির ওপর নির্মিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল।

১৯৪৯ সালে এ কলেজে আবারও স্নাতক পাঠ্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬৩ সালে অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান পুনরায় কো-অ্যাডুকেশন চালু করেন। এর আগে ১৯৪২ সালে কো-অ্যাডুকেশন চালু হলেও ১৯৪৮ সালে তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

১৯৬৮ সালে পাক সামরিক বাহিনী জগন্নাথ কলেজকেন্দ্রিক স্বাধিকার আন্দোলনকে দমানোর জন্য জগন্নাথ কলেজকে সরকারিকরণ করে শুধু বিজ্ঞান কলেজে রূপান্তরিত করে। এর বাণিজ্য ও মানবিক বিভাগকে সরিয়ে মহাখালীতে নতুন জিন্নাহ কলেজ খোলা হয় (বর্তমান তিতুমীর কলেজ)।

১৯৭২ সালে জগন্নাথে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু হয়। সে সময় দেশের অন্য অনেক কলেজের মতো এই কলেজও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কলেজ ছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ১৯৯১-৯২ শিক্ষাবর্ষ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শিক্ষাকার্যক্রম চলতে থাকে।

জগন্নাথ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করতে ২০০৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ৮ম জাতীয় সংসদের ১৮তম অধিবেশনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০০৫ সংসদে উত্থাপিত হয় এবং ২০ অক্টোবর একটি সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজকে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এখানে বর্তমানে মোট ৬টি অনুষদে ৩৬টি বিভাগ ও ২টি ইনস্টিটিউট রয়েছে।

শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। একটি আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নিজেদের জানান দিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে জবির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।

বিসিএসসহ দেশের বড় বড় চাকরি ক্ষেত্রে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম সর্বোপরি সমাদৃত। আশাকরি আমাদের এই প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয় একদিন অধিষ্ঠিত হবে আরও উচ্চ মঞ্চে। একদিন সমগ্রবিশ্ব জানবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে। স্বপ্ন দেখি একদিন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড না হলেও প্রাচ্যের হার্ভার্ড হবে আমাদের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। হয়ত সেদিন বুকে হাত রেখে বলবো, ‘আমি একজন গর্বিত জবিয়ান।’

একদিন এই আবাসন সংকট থাকবে না। হয়তো শতভাগ শিক্ষার্থীর জন্য আবাসন ব্যবস্থা হবে। একদিন এই ক্লাসরুম সংকট থাকবে না। হয়তো একেকটি ডিপার্টমেন্টের জন্য থাকবে একেকটি কমপ্লেক্স। হয়তো কোনো শিক্ষা উপকরণ সংকট কিংবা ল্যাবরেটরি সংকট থাকবে না। হয়তো সুবিশাল গ্রন্থাগারে অগণিত বই অধ্যয়ন করবে শিক্ষার্থীরা। হয়তো এত সরু সংকীর্ণ পথের পরিবর্তে থাকবে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত পথ। হয়তো থাকবে এঁকে-বেঁকে চলা হ্রদ আর পাখির কলকাকলিতে মুখরিত প্রাঙ্গণ। তখন আর ধুপখোলা মাঠে টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে হবে না, তখন হয়তো থাকবে স্টেডিয়াম। 

দুইশ একরের নতুন ক্যাম্পাসে হয়তো থাকবে না কোনো সীমাবদ্ধতাই, তৈরি হবে এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে উন্নত ও আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়, যা দেখার জন্য পর্যটকরা ভ্রমণ করবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

হয়তো কোনো এক বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই প্রাণপ্রিয় বন্ধুদের নিয়ে চলে যাব নতুন ক্যাম্পাসে। হয়তো কোনো এক হ্রদের পাড়ে বসে নির্মল বাতাসের ছোঁয়ায় শিউরে ওঠবে শরীর। পাখিদের কলকাকলীতে পরিপূর্ণ অপরাহ্ণে স্মৃতিচারণ করবো আর বলবো, ‘দেখ, এইতো আমার পরিপূর্ণতায় গড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।’ একটা দীর্ঘ প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে সেই কাঁঠালতলার আড্ডার কথা স্মরণ করবো।

লেখক: শিক্ষার্থী, পরিসংখ্যান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

জবি/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়