ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

দুর্গোৎসব: যেভাবে হয়ে উঠলো সর্বজনীন 

অয়ন চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৪৭, ২০ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ১৬:৪৯, ২০ অক্টোবর ২০২০
দুর্গোৎসব: যেভাবে হয়ে উঠলো সর্বজনীন 

ছবি: অয়ন চক্রবর্তী, স্থান: বরিশাল, দিয়াপাড়া, স্বর্গীয় দক্ষিণা চক্রবর্তীর বাড়ির পূজা মণ্ডপ

‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’-আবহমানকাল ধরে এই মূলমন্ত্রকে ধারণ করে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত বাঙালি ঈদ, পূজা, বড়দিন, বৌদ্ধপূর্ণিমা এবং অন্য ধর্মীয় পালাপার্বণগুলোকে সর্বজনীন উৎসবে পরিণত করেছে। তাই এসব উৎসব আর ধর্মীয় পরিচয়ে সীমাবদ্ধ নেই; সর্বজনীন উৎসবে একে-অন্যের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আনন্দে মেতে ওঠেন। 

যত দিন যাচ্ছে, ততই বাড়ছে দুর্গোৎসবের রোশনাই। আর সেই রোশনাইতে গোটা দেশ ঝলমলিয়ে ওঠে। যদিও অদৃশ্য অণুজীব করোনার কারণে এ বছর দুর্গোৎসব পরিহার করে সাত্ত্বিক দুর্গাপূজার আয়োজন করছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। 

শাস্ত্রে ‘দুর্গা’ নামের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে-

‘দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্তিত।
উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত।।
রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ।
ভয়শত্রুঘ্নবচনশ্চাকারঃ পরিকীর্তিত।।’

‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, উ-কার বিঘ্ননাশক, ‘রেফ’ রোগনাশক, ‘গ’ অক্ষর পাপনাশক ও অ-কার ভয়-শত্রুনাশক। অর্থাৎ দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। শব্দকল্পদ্রুম অনুসারে, ‘দুর্গং নাশয়তি, যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা’-অর্থাৎ, দুর্গ নামক অসুরকে যিনি বধ করেন, তিনিই নিত্য দুর্গা নামে অভিহিত। আবার শ্রীশ্রীচণ্ডী অনুসারে এই দেবীই ‘নিঃশেষদেবগণশক্তিসমূহমূর্ত্যাঃ’ বা সব দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডজুড়ে সর্বত্রই দেবী মহামায়ার অস্তিত্ব। দেবীর মায়াবলেই চলছে গোটা জগৎসংসার। 

দেবী ভগবতে বলা হয়েছে, 

‘সদৈকত্বং ন ভেদোহস্তি সর্বদৈব মমাস্য চ 
যোহসৌ সাহম্ অহং যাসৌ ভেদোহস্তি মতিবিভ্রমাৎ।’

অর্থাৎ, ‘আমি ও ব্রহ্ম এক। উভয়ের মধ্যে ভেদ নেই। যিনি ব্রহ্ম তিনিই আমি। আমি যাহা, তিনিও তাহাই। এই ভেদ ভ্রমকল্পিত, বাস্তব নহে।’ ‘আমি’-ই দুর্গা বা শক্তি। মাতৃ উপাসক ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছেন, ‘তোমরা যাকে ব্রহ্ম বলো, আমি তাকে মা বা ব্রহ্মময়ী বলি। ব্রহ্ম ও ব্রহ্মময়ী এক ও অভিন্ন।’ বিশ্ববরেণ্য দার্শনিক ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী বলেছেন, ‘ব্রহ্মময়ী মহাশক্তিকে আমরা জড় বলতে পারি না। তিনি স্বয়ম্ভু, স্বপ্রকাশ ও চৈতন্যময়ী। তাকেই তো ধর্মাচার্যরা পরমেশ্বর বলে উপাসনা করেন। ঈশ্বর ও ঐশী শক্তির মধ্যে কোনো তফাৎ নেই।’

দুর্গাপূজার বাংলাদেশের সঙ্গে দুর্গোৎসবের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। মার্কন্ডেয় পুরাণ এবং শ্রীশ্রীচণ্ডী গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে ঋষি মেধসের আশ্রমের কথা। মার্কন্ডেয় পুরাণ অনুযায়ী, দেবী দুর্গা মর্ত্যলোকে সর্বপ্রথম এই ঋষি মেধসের আশ্রমে অবতীর্ণ হন। এই মেধস মুনির আশ্রম চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলায় করলডেঙ্গা পাহাড়ে অবস্থিত। আবার, বর্তমানে প্রচলিত শারদীয় দুর্গাপূজার প্রথম প্রচলন করেছিলেন প্রাচীন জনপদ বরেন্দ্র অর্থাৎ রাজশাহীর বাগমারা থানার তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ। 

জানা যায়, ১৫৮০ সালে তিনি প্রথম বর্তমানে প্রচলিত শারদীয় দুর্গাপূজার সূত্রপাত করেছিলেন।  বারণই নদের পূর্ব তীরে রামরামায় গ্রামে ছিল তাহিরপুর (বর্তমান লোকমুখে প্রচলিত তাহেরপুর) রাজবংশের আদি নিবাস। নদীভাঙনের কারণে পরবর্তীকালে নদীর অপর তীরে গড়ে তোলেন বর্তমান রাজবাড়িটি। রাজবাড়ি প্রাঙ্গণেই প্রতিষ্ঠা করা হয় দুর্গামন্দির, শিবমন্দির, গোবিন্দ মন্দিরসহ অন্যান্য স্থাপনা। 

ইতিহাসখ্যাত এই রাজবংশের প্রথম পুরুষ ছিলেন সংস্কৃত বেণী সংহার রচয়িতা ভট্টনারায়ণ বা নারায়ণ ভট্ট নামক সংস্কৃতজ্ঞ এক ব্রাহ্মণ। নাটোরের দীঘাপতিয়া, রাজশাহীর পুঠিয়া, দিনাজপুরের রাজবংশের চেয়েও পুরোনো এই রাজবংশটি বাংলার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে নানা কারণে। জানা যায়, বিজয় লস্কর থেকে এ বংশের সুখ্যাতি ও সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাজা কংসনারায়ণের সময় তাহিরপুর রাজবংশের প্রভাব-প্রতিপত্তি সবচেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছিল। জাতিতে তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণ। যজ্ঞ বা হোম করে পূজা অনুষ্ঠানের অধিকার তাঁর ছিল। তাই তিনি স্বজাতি বরেন্দ্রী ব্রাহ্মণদের দিয়েই শাস্ত্রসম্মতভাবে দুর্গাপূজার সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেছিলেন। 

মাসব্যাপী প্রজাসাধারণের ভোজসহ বিপুল আয়োজন করেছিলেন। সব অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে তিনি ব্যয় করেছিলেন সে সময়ই প্রায় নয় লাখ টাকা, যা বর্তমানের টাকার অঙ্কে কয়েক শ কোটি টাকা। বিপুল এ খরচের পুরোটাই নিজে বহন করেছিলেন। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের উদ্দেশ্যে এবং সমসাময়িক কুলীন ব্রাহ্মণদের বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার জন্যই মূলত রাজা কংসনারায়ণ শরৎকালে রাজা রামচন্দ্র প্রবর্তিত দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন। তাঁর পূজার জাঁকজমকের কথা আজও লোকমুখে প্রচারিত। 

বাংলার সব জনপদে ছড়িয়ে আছে রাজা কংসনারায়ণের দুর্গোৎসবের কথা। তাঁর দেখানো পথে পরবর্তীকালে অন্য রাজা ও জমিদারগণ হাঁটেন। ১৬০৬ সালে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদার মহাসমারোহে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন নিজ বাড়িতে। প্রায় একই সময় ১৬১০ সালে কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশের অন্যতম পুরুষ লক্ষ্মীকান্ত মজুমদারও নিজ বাড়িতে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। এর মাধ্যমে কলকাতায় সূত্রপাত হয় দুর্গাপূজার। এভাবেই রাজা-জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলার হিন্দুদের প্রধান এ উৎসবের বৈভব ছড়িয়ে পড়তে থাকে সমগ্র বাংলাদেশে।

মর্ত্যলোকে দুর্গাদেবীর প্রথম আবির্ভাবস্থল এবং জনসাধারণের মাঝে শারদীয় দুর্গোৎসব প্রচলনস্থল দুটোই বাংলাদেশে। যে দুর্গাপূজা বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উৎসব বলে ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃত, সেই দুর্গাপূজার উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশ! এই নাড়ির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। তাই তো মহাসমারোহে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া মেতে ওঠে শারদোৎসবে। গত কয়েকবছর ধরে পূজামণ্ডপের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে যাচ্ছিল। গত বছর ৩১ হাজার ৩৯১টি পূজামণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৮ সালে সারা দেশে ৩১ হাজার ২৭২টি মন্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। 

২০১৭ সালে সারাদেশে ২৯ হাজার ৭৪টি মন্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তবে করোনা পরিস্থিতির জন্য এবার সারা দেশে পূজার সংখ্যা কমছে। মোট ৩০ হাজার ২৩১টি পূজা অনুষ্ঠিত হবে এবছর।

সর্বমঙ্গলা দেবী দুর্গার করুণাবারিতে গোটা বিশ্ব করোনামুক্ত হোক-এ বছরের দুর্গাপূজায় এটাই গোটা বিশ্বের শতকোটি সনাতন ধর্মাবলম্বীর প্রার্থনা। এবছর সকল প্রকার স্বাস্থ্যবিধি পালন করে সংক্ষিপ্ত পরিসরে দুর্গাবন্দনা করে আসছে বছর দ্বিগুণ উৎসাহে দুর্গোৎসবে আবার আমরা মেতে উঠব-এই কামনা নিয়েই হোক এবারের দুর্গাপূজা।

লেখক: শিক্ষার্থী, একাদশ শ্রেণি, অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়। 

বরিশাল/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়