ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

মানুষ হিসেবে লিখছি, নারী হিসেবে নয়

উম্মে সাঈদা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৫৫, ২৭ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ১৮:০২, ২৭ অক্টোবর ২০২০
মানুষ হিসেবে লিখছি, নারী হিসেবে নয়

সম্প্রতি জ্যামিতিক হারে বেড়ে যাওয়া ধর্ষণের ঘটনায় আমরা জাতির অস্তিত্ব নিয়ে শঙ্কিত। আজ আমি মানুষ হিসেবেই লিখছি, নারী হিসেবে নয়। দিনে দিনে আমার দেশ ‘ধর্ষণের দেশ’ হয়ে ওঠার পেছনে দোষ কার? নির্মম ধর্ষণের অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা কীভাবে সামাজিক জীবনকে প্রভাবিত করছে ও ভবিষ্যতে করবে? এর পেছনের কারণগুলো কি কি? আমরা কোনোভাবেই ধর্ষণের মতো জীবননাশক ঘটনাকে রোধ করতে পারবো না? যদি সম্ভব হয়, তবে কীভাবে আমরা তা বাস্তবায়ন করতে পারি?

ফেসবুকে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। সেখানে কয়েকটি যুবক একজন বোনের সঙ্গে খুব খারাপভাবে যৌন হয়রানিমূলক আচরণ করছে। সিলেটের গণধর্ষণের আসামিরাও নাকি ভিডিও ধারণ করেছে। তথ্যটি সত্য নাও হতে পারে। অথচ বোনটি কালো বোরকা ও নিকাব পরিহিত ছিল। ভিডিওতে বোনটির আচরণ ছিল অত্যন্ত নম্র। এতকাল ধরে আমাদের সমাজ নানাভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে ধর্ষণের জন্য আসলে কারা দোষী। ধর্ষণের নির্মমতম দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা সিলেটের ঘটনাটিকে বিবেচনা করতে পারি। কারণ এ ঘটনাটি ধর্ষণ ও নারীর সম্ভ্রম রক্ষার সম্পর্কে আগেকার সব ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করেছে। 

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাটির প্রভাব আমাদের সামাজিক জীবনে সুদূরপ্রসারী। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে অপরাধীর শাস্তি বিধানের জন্য আন্দোলন শুরু হয়েছে। এটি সরকার বিরোধী প্রতিক্রিয়ায় রূপ নিতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদি প্রভাব হিসেবে আরও কিছু প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে পারি। যেসব পরিবারে মেয়ে সন্তান আছে, তারা সন্তানের নিরাপত্তাহীতার কারণে হীনমন্যতায় ভুগবে। নারীরা পর্দা প্রথার প্রতি অনাগ্রহী হয়ে উঠতে পারে। আত্মরক্ষার জন্য নারীরা উগ্রবাদী পন্থা বেছে নিতে বাধ্য হতে পারে। যা দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে সক্ষম। 

উগ্রবাদী ফেমিনিস্টরা এ পরিস্থিতির সুযোগ অবশ্যই নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। ‘এক্সট্রিমিস্ট ফেমিনিজম’ এর উদ্ভব দেশে চরম বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। নারী-পুরুষ সম্পর্কগুলোতে মারাত্মক বিশ্বাসহীনতার জন্ম দেবে, যা দেশকে সমকামিতা বৃদ্ধির দিকে ঠেলে দিতে পারে।

যেহেতু সমস্যার মূল চিহ্নিত করতে পারলেই তার সমাধান নিশ্চিত করা সহজ ও সম্ভব হয়, তাই কারণ ও সমাধান সম্পর্কে একই সঙ্গে বিশ্লেষণ করবো। ধর্ষণ সংস্কৃতির প্রভাব থেকে ভবিষ্যৎ ও বর্তমান প্রজন্মকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ ও প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণের তাৎপর্য অপরিসীম। আমি আলোচনা করবো কীভাবে শিক্ষাব্যবস্থার ‘প্রয়োজনীয় নতুনত্ব’ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে সক্ষম। আর আইন ও শাসন ব্যবস্থার সংশোধন ও যথোপযুক্ত কঠোরতা, নাগরিকের নিরাপত্তা ও ন্যায়ের সুষম বণ্টন ভবিষ্যৎ ও বর্তমান প্রজন্মকে বাঁচাতে ও সংশোধন করতে পারে। 

প্রতিরোধ ব্যবস্থার কথাই প্রথমে বলবো। সর্বপ্রথম শিক্ষাব্যবস্থাকে পুনরায় নকশা করা প্রয়োজন। ‘শিক্ষা’ ব্যাপারটি শিশুর জন্মের পর থেকে শুরু হয় বিধায় শিক্ষাব্যবস্থাকে আমি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পরিবার ও সমাজ পর্যন্ত প্রসারিত করে তুলে ধরতে চেস্টা করবো। প্রথম শিশুর শূন্য মগজটাকে নানা ধ্যানধারণা দিয়ে পূর্ণ করে পরিবার। আমাদের পরিবারগুলোর প্রথম ভুল; আমাদের শেখানোর কথা ছিল ‘মানুষ’ সামাজিক জীব। আর যুগ যুগ ধরে আমরা শিক্ষা পাই নারী’ ও ‘পুরুষ’ সামাজিক জীব। অর্থাৎ নারী ও পুরুষ হয়ে ওঠার গুরু দায়িত্ব আমাদের মানুষ হিসেবেই বেড়ে উঠতে বাঁধা দেয়। 

জেন্ডার বাইয়াসড জীবনব্যবস্থা নারীদের শেখায় সহনশীলতা ও নম্রতা, অপরদিকে পুরুষদের কর্তৃত্ববাদিতা শেখায়। ফলে, নারীরা অন্যায়কে মাথা পেতে নিতে ও পুরুষ সমাজ অন্যায়কে নেতৃত্ব দিতে শেখে। কেউ সমাজে ধর্ষক হয়, আবার কেউ ধর্ষিত। অর্থাৎ বীজকে কীভাবে বপন করা হলো, তার পরিচর্যা কীভাবে করা হলো তার উপর নির্ভর করে চারা গাছের বেড়ে ওঠা ও পরিণতিতে গাছটি কেমন ফল দেবে। ধর্ষণের মতো সামাজিক ব্যাধির প্রথম প্রতিরোধ ব্যবস্থা পরিবারেই প্রোথিত আছে। 

বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, অধিকাংশ ধর্ষকরা জানেন না যে, তারা কোন অপরাধ করেছেন, তারা কখনও জানতেন না, কোনো মানুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের পূর্বে ওই ব্যক্তির সম্মতির প্রয়োজন হয়। বরং নারীরা সমাজে যৌনবস্তু হিসেবেই আছে এমনটিই তাদের ধারণা। এই তথ্য উঠে এসেছে একটি ভারতীয় গবেষণায়। এখন আমরা এই প্রশ্নের সমাধান পেতে পারি যে, সমাজে এমন ধ্যানধারণা নিয়ে মানুষগুলো বেড়ে ওঠার পেছনে প্রকৃতপক্ষে দায় কার? 

একটা প্লে-নার্সারি পড়ুয়া বাচ্চা যখন ঘরের কর্মচারীদের সাহচর্যে পর্নোগ্রাফি ও অশ্লীল ভিডিও সম্পর্কে ইতিবাচকভাবে ও পরিপূর্ণভাবে অবহিত। তার ভবিষ্যত পর্ন আসক্তির জন্য ও পরিণতিতে ধর্ষক হিসেবে পরিচিতি লাভের জন্য কে দায়ী হবে? এই পর্নোগ্রাফি, মেয়েদেরকে পণ্য হিসেবে মিডিয়াতে চিত্রায়ন সবই পুরুষ সমাজ এমনকি নারী সমাজকেও বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। পারিপারিক সম্পর্কগুলোর মধ্যে দূরত্ব, মূল্যবোধের অভাব সবই সন্তানদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হিসেবে নানা ধরনের আসক্তি সৃষ্টি করে। তাদের বাস্তবতা আজ শুধুই শরীর-কেন্দ্রিক। 

সমাজের সব বয়সের মানুষের মাঝে পর্নো আসক্তি এমনরূপ ধারণ করেছে, যা সব লিঙ্গ, বর্ণ, সম্পর্ক, বয়স, পর্দা, আচরণ, সংস্কৃতি, ধর্মকেই ছাড়িয়ে গেছে। শিশুদের ক্ষেত্রে পরিবার ব্যবস্থা নিতে পারলেও সমাজের সব শ্রেণির মানুষের ক্ষেত্রে তা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ আন্তর্জাতিক পর্নো ইন্ডাস্ট্রিগুলোর কালো হাত বিশ্বায়নকেও ছাড়িয়ে গেছে। মানবের আত্মা মৃত্যুর পথযাত্রী, আর পুরো পৃথিবীজুড়ে ‘দেহের’ জয় জয়কার। 

বয়ঃসন্ধিকালের শুরুতে সন্তানের প্রতি পরিবারের সহায়তা ও সহনশীলতা তাদের সম্পূর্ণ জীবনে অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। এ সময়ে মেয়েরা পরিবার ও আত্মীয়দের কাছ থেকে তার শারীরিক, মানসিক পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে অনেক বেশি সহযোগিতা পেয়ে থাকে। কিন্তু অধিকাংশ ছেলেরাই এ ব্যাপারে পরিবারের সহযোগিতা পায় না। ফলে, এ সময়কালীন অভিযোজনের উপায় সম্পর্কে জানতে তারা ইন্টারনেটের সহায়তায় বিভিন্ন সাইটের দ্বারস্থ হয়। যেসব সাইটগুলোর বেশিরভাগই সেক্স এডুকেশনকে নেতিবাচকভাবে চিত্রিত করে। আর এভাবেই তারা নিজেদের অজান্তেই যৌন কার্যকলাপ সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচকতা নিয়েই বেড়ে ওঠে। তাই বয়ঃসন্ধিকালের সময়ে মেয়ে ও ছেলে সবারই যৌনতা সম্পর্কে উপযুক্ত জ্ঞান ও সহায়তার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে পরিবারের সহায়তা সর্বাগ্রে কাম্য। 

এরপর শিক্ষাব্যবস্থার দ্বিতীয় ধাপ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কথা বলবো। আমাদের পাঠ্যবইগুলো কিছু জেন্ডার অনিরপেক্ষ ধারণা জন্মানোর জন্য সহায়ক, এমন তথ্য প্রচার করে। যা জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার করা প্রয়োজন। স্কুল সিলেবাসে ‘সেক্স এডুকেশন’ নামে একটি সাবজেক্ট অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। আমাদের যেভাবে ধর্ম ক্লাস করানো হতো আলাদা ভাবে, সেভাবেই ছেলে মেয়েদের এই সাবজেক্টের ক্লাস করানো উচিত। যেখানে সহজ-সাবলীল ভাষায় শিক্ষক শিক্ষার্থীদের একটি মার্জিত পরিবেশে ‘সেক্স এডুকেশন’ সম্পর্কে ইতিবাচকভাবে বোঝাবেন।

ধর্ষণ যে যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে কতটা অনৈতিক ও নেতিবাচক তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বোধগম্য হবে। পরবর্তী শ্রেণিগুলোতে ‘জেন্ডার স্টাডিজ’ নামক একটি অধ্যায় পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এটির মাধ্যমে আমাদের প্রজন্ম জানতে পারবে, নারী বা পুরুষ হওয়ার পূর্বে আমাদের মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। 

এখন প্রতিকার ব্যবস্থার প্রসঙ্গে আসা যাক। যারা বর্তমানে আকাশ সংস্কৃতি, বিশ্বায়নের অপপ্রয়োগ, পর্নো আসক্তির প্রভাবে সমাজে ধর্ষক ও ধর্ষিতের প্রসার ঘটিয়ে বেড়াচ্ছে, মূলত তাদের জন্যই প্রতিকার ব্যবস্থার প্রয়োজন। এমনকি নারীদের ছাড়িয়ে এখন পুরুষরাও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। এ পরিস্থিতে সরকারের কঠোর থেকে কঠোরতর ব্যবস্থা ব্যতীত দেশের মাটিতে প্রত্যেকটি নারী, এমনকি পুরুষরাও অনিরাপদ। 

সরকারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও কঠোর অবস্থান একজন নারীকে যেমন ধর্ষিত হওয়া থেকে বাঁচাতে পারে, একজন পুরুষকে ধর্ষক হওয়া থেকেও রক্ষা করতে পারে। সরকার বা জনগণ যতই শাস্তির বিধান করুক,  বোনগুলোর সম্ভ্রমহানির সমপরিমাণ কোনো ক্ষতিপূরণ তাদের দ্বারা বিধান করা সম্ভব নয়। তাই সমাজের প্রত্যেকটি মানুষের চোখের সামনে এই নির্মম দুঃসাহসের নির্মম শাস্তির ব্যবস্থা করা আবশ্যক। যা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মেকে ধর্ষণের নামেও ভীতসন্ত্রস্ত করবে। ফলস্বরূপ, হয়তো স্বাধীন দেশে প্রতিটি নারী স্বাধীনভাবে পদচারণা করার মনোবল ও অধিকারটুকু অর্জন করতে পারবে। 

আগে চোখ বন্ধ করে দেশের জন্য কাজ করার স্বপ্ন দেখতাম, আর এখন আমার ধর্ষিত বোনগুলোর আর্তনাদ শুনতে পাই, এই বুঝি আমার পালা এসে গেলো। অনিরাপত্তা গ্রাস করেছে চারপাশ, আমাদের সব ইচ্ছে অঙ্কুরেই অস্তিত্ব হারাবে। প্রধানমন্ত্রী, সব আদর্শবান রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, সুশীল সমাজ সবার কাছেই আমাদের অনুরোধ, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান প্রজন্ম, দেশের জনশক্তিকে রক্ষা করতে আমাদের সহায়তা করুন। দেশ আমাদের নিরাপত্তা বিধান করতে পারলো না, এ ভাবনায় জীবন ধারণ করা আমাদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। আমাদের ও আমাদের দেশপ্রেমকে বাঁচিয়ে রাখুন, আমাদের জীবনকে বাঁচিয়ে রাখুন।

লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।  

চবি/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়