ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

জয়-পরাজয়ের গল্পে অপ্রতিরোধ্য জেসমিন 

সিজুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩৬, ২৯ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ১১:৫২, ২৯ অক্টোবর ২০২০
জয়-পরাজয়ের গল্পে অপ্রতিরোধ্য জেসমিন 

দুই সন্তানের জননী জেসমিন বেগম। পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার চন্দনবাড়ি ইউনিয়নের সরকারপাড়া গ্রামের পুত্রবধূ। বোদা শহরে বাবা-মায়ের সংসারে তারা তিন বোন এক ভাই। ২০০২ সালে এসএসসি পাস করলেও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেননি। বোনদের মধ্যে ছোট তিনি। ২০০৫ সালে সহপাঠী এক বন্ধুর সঙ্গে ঘর বাঁধেন জেসমিন। 

পরিবারের অমতে বিয়ে করায় দুই পরিবারেই তারা প্রথমদিকে উপেক্ষিত হোন। এরপর সব স্বাভাবিক হলেও শুরু হয় জীবন সংগ্রাম। বাবার বাড়িতে দুইবছর সংসার করেন তারা, তারপর আবার শ্বশুরবাড়িতে চলে আসেন। স্বামী জুলফিকার আলম তেপুকুরিয়া বাজারে ব্যবসা শুরু করেন। জেসমিন বেগম দুই বছরের জন্য ২০০৭ সালে স্থানীয় এনজিও সূচনার সহযোগিতায় চন্দনবাড়িতে এলাকার ঝরে পড়া ৩০ জন কিশোরীকে পড়ানো শুরু করেন। ২০০৮ সালে জাপান ভিত্তিক এনজিও হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ডের কর্মকর্তা এস এম শাহীনের সহযোগিতায় মুষ্টি চাল সঞ্চয়ের মাধ্যমে এলাকার আরও কিছু মহিলাদের নিয়ে তারা সরকারপাড়ায় গড়ে তোলেন ‘দোয়েল মহিলা উন্নয়ন সমিতি’। সেখানে তারা লটারির মাধ্যমে চাল বণ্টন করতেন। 

জেসমিন বলেন, যেদিন আমি প্রথম ৪ কেজি চাল লটারিতে পেয়েছিলাম, সেদিন আমার রান্না করার মতো কোনো চাল ছিল না ঘরে। এরপর ৫ টাকা করে আমরা সঞ্চয় রাখতাম। একসময় সমিতির ২০ হাজার টাকা মূলধন হলে হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড থেকে আরও ২০ হাজার টাকা অনুদান দেয়। এই ৪০ হাজার টাকায় ৬টি গরু কিনে প্রথম গরুর প্রকল্প শুরু করে এই সমিতি। 

জেসমিন ২০১০ সালে দুই বছরের জন্য স্থানীয় এনজিও পরস্পরের সহযোগিতায় আবার ইউনিয়নের নতুন হাটে বয়স্ক শিক্ষাকার্যক্রমে আত্মনিয়োগ করেন, সেখানেও শিক্ষার্থী ছিল ৩০ জন। বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে পড়াতে যেতেন। শিক্ষাকার্যক্রমের পাশাপাশি পুরো সরকারপাড়া গ্রামের গর্ভবতী নারীদের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ডের একটি প্রকল্পে প্রতিদিন দুপুরে রান্না করা খাবার আসতো ভ্যানে করে, অ্যানিমেটর হিসেবে যুক্ত হয়ে সেটি নিয়ে তাদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে খিচুড়ি, দুধসহ পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার কাজটিও তদারকি করতেন। সেইসব নারীদের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্যও দুইবছর পর প্রকল্প শেষে অর্থ অনুদান ও ৩০টি করে মুরগী, মুরগীর ঘর প্রদান করলে সেগুলোও তদারকি করেছেন। তাদের অনেকেই এখন নিজেদের পরিবারের স্বচ্ছলতা আনতে সক্ষম হয়েছেন। ইতোমধ্যে নিজের কোলেও একটি ছেলে সন্তান আসে জিসান আফরোজ জীম সে এখন ৪র্থ শ্রেণীতে পড়ে। ছোট্ট শিশু কিংবা সাংসারিক প্রতিবন্ধকতাও কখনই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি এই জীবন সংগ্রামী নারীর। মেনে নিতে হয়েছে আরেকটি সংসার। 

এলাকার নারীদের উন্নয়নে হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ডের করা দোয়েল মহিলা উন্নয়ন সমিতির প্রকল্প নিয়ে তাকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হয়েছে। তাদের উন্নতির কারণে অনুপ্রেরণার ফলস্বরূপ সমিতিকে ১০ হাজার টাকা অনুদান দেয় হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড। তাদের স্বপ্নও তখন আরও বড় হয় তারা পরিকল্পনা করেন সরকারি খাস পুকুর লিজ নেবেন। স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে সাহস দিতে পাশে এসে দাঁড়ান হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড কর্মকর্তা মালেকা বেগম। 

এরপর তারা ২ লক্ষ ৯২ হাজার টাকায় তিন বছরের জন্য এলাকার সবচেয়ে বড় পুকুরটি লিজ নেয় সরকারের কাছ থেকে। সরকারিভাবেও তারা প্রশিক্ষণ ও মাছ পায়। সমিতির একজন সদস্যের স্বামীকে নৈশ প্রহরী হিসেবে নিয়োগ দেয় তারা। সমিতির সদস্যরা প্রতিদিন পালা করে মাছকে খাবার দিতে যায়। মাছ কেনা, মাছের খাবার কেনা মাছ বিক্রির জন্যও তারা হাটে-বাজারে নিজেরা গিয়েছেন। একসময় তারা শেয়ার বিক্রি করা শুরু করলেন। তারা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, এনজিও এবং সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে যেয়ে যেয়ে তাদের উদ্যোগ সম্পর্কে জানাতে শুরু করলেন। উদ্যমী এই নারীদের প্রকল্পে তখন সবাই উদ্বুদ্ধ হয়ে শেয়ার ক্রয় করা শুরু করলেন। শেয়ার ক্রয়কারী প্রতিজন হাজারে চারশ টাকা করে লাভ পেয়েছেন। মৃত শেয়ার হোল্ডারদের পরিবারের সদস্যদের বাড়ি গিয়ে প্রকল্প শেষে তারা লভ্যাংশ ও মূলধন দিয়ে এসেছেন। এই মাছের প্রকল্প শেষে এক লক্ষ পনের হাজার টাকা তারা লাভ করেন। তাদের এমন সততা ও নিষ্ঠার কারণে এলাকার মানুষের কাছে একটি  উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছেন তারা। তাদের সমিতির জন্য তারা স্থানীয় সংসদ সদস্য বর্তমান রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের কাছেও যান। তিনি বিষয়টি অবহিত হলে ৪০ হাজার টাকা অনুদানের ব্যবস্থা হয়। 

বোদা উপজেলা মহিলা বিষয়ক অফিসের অধীনে ২০১২ সমিতিরি রেজিস্ট্রেশনও করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ সহায়তা পেয়ে যাচ্ছেন তারা এখান থেকে অব্যাহতভাবে, তবে প্রতিবছর আবেদন করলেও মহিলা বিষয়ক থেকে কোনো সরকারি অনুদান তারা পাননি। ২০১৭ সালে সংগ্রামী দোয়েল মহিলা উন্নয়ন সমিতি সরকারপাড়ায় নিজেদের জন্য এক শতক জমিও ক্রয় করে ঘর তুলে স্থায়ী অবকাঠামো তৈরি করেছে। ২০১৮ সালে দ্বিতীয় সন্তান কন্যা তাবাসসুম জান্নাত হুমায়রার জন্মের পরেও জেসমিন বেগম হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ডের ‘নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা প্রকল্প’র আওতায় এলএসপি (লোকাল সার্ভিস প্রোভাইডার) হিসেবে কাজ শুরু করেন এলাকার ১২ জন অতিদরিদ্র লক্ষিত নারীদের নিয়ে। জরিপের মাধ্যমে নির্বাচিত এসব অতিদরিদ্র নারীদের অফিসের সমন্বয়ে প্রতিমাসে দুই দিন নির্দিষ্ট বিষয়ে উঠান বৈঠক করে খাদ্য, পুষ্টি,পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন সচেতনতামূলক তথ্য দিয়ে পুষ্টি শিক্ষার কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। প্রত্যেক মাসে তাদের বাড়ি পরিদর্শন করে উঠান বৈঠকে শেখা বিষয়গুলো চর্চা করছে কিনা সে বিষয়েও অগ্রগতি প্রতিবেদন তৈরি করে অফিসে জমা দেন। 

কোভিড-১৯ মহামারীর প্রার্দুভাবে যখন সবাই বিপর্যস্থ, তখন এসব নারীদের জন্য অফিস থেকে খাদ্য সহায়তা এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী প্রতি ইঞ্চি জমি ব্যবহারের উদ্দেশ্যে তারা এসব লক্ষিত নারীদের বাড়ির উঠানে নিজেদের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তার জন্য লাউ, সিম, বরবটি, চাল কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, মরিচ, বেগুনসহ বিভিন্ন সবজি উৎপাদনের পরামর্শ ও তদারকি করে আসছেন। আগ্রহীদের অফিস থেকে এসব সবজির চারা বিনামূল্যে উপহার প্রদান করা হয়। 

এছাড়া কখন স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্য পরামর্শের জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে হবে সে ব্যাপারেও মহিলাদের উদ্বুদ্ধ করেন। জেসমিন বেগম করোনা পরবর্তীকালে এসব লক্ষিত নারীদের উন্নয়নের জন্য তাদের সঞ্চয়ী দল গঠন করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। উঠান বৈঠক শেষে রেজিস্ট্রার খাতা ও পাস বইতে সঞ্চয় হিসাব রেকর্ড করার কাজও করছেন তিনি । ইতোমধ্যে এই দলটিও প্রায় পাঁচ হাজার টাকা সঞ্চয় করে ফেলেছে। পূর্বের দল দোয়েল মহিলা উন্নয়ন সমিতি শুরুতে ৩০ জনের মতো সদস্য থাকলেও বর্তমানে সদস্য ২২ জন, যারা প্রায় প্রত্যেকেই পরিবারে স্বচ্ছলতা আনতে সক্ষম হয়েছেন। নিজেরাও হয়েছেন সফল নারী। 

বর্তমানেও দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন জেসমিন বেগম। তিনি জানান, সাপ্তাহিক সভার পাশাপাশি প্রতিবছরই সাধারণ সভার মাধ্যমে তারা লাভ ক্ষতির হিসাব করে টাকা বণ্টন করেন। এ বছর তাদের করোনার কারণে খানিকটা থমকে যেতে হয়েছে মূলধন ৮০ হাজার টাকা ব্যাংকে রাখা আছে দ্রুত তারা আবার গরু কিনে বর্গা দিবে সদস্যদের মধ্যে। করোনা পরবর্তী নয়া স্বাভাবিকতায় নারীদের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার লক্ষ্যে সমিতির সভাপতি রুনা বেগম ও সাধারণ সম্পাদক জেসমিন বেগমের উদ্যোগে নিজেদের সমিতির ঘরে প্রশিক্ষক এনে দর্জি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন তারা। লক্ষিত নারী, দলের সদস্য, শিক্ষার্থী ও এলাকার মহিলাদের ১৪ জন এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন। 

সংগ্রামী জেসমিন বেগম তাঁর প্রত্যন্ত গ্রামে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের উন্নয়নের জন্য কখনও কিশোরী স্কুল, কখনও বয়স্ক শিক্ষা স্কুল, কখনও গর্ভবতী নারীদের পুষ্টি নিশ্চিত করা, কখনও সঞ্চয়ী দল করে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার ক্ষেত্রে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছেন ও বর্তমানেও করছেন, হয়তো ভবিষ্যতেও করবেন। করোনাকালে স্বামীর কাপড়ের দোকানটি বন্ধ থাকায় খানিকটা ছন্দপতন হলেও নিজের সঞ্চয় নিয়ে মাথা উচু করে দাঁড়িয়েছেন নিজের পরিবারে। একইভাবে দলের অন্য নারীরাও পরিবারে নিজেদের সঞ্চয় নিয়ে জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। যা সত্যিকার অর্থেই দেশের অনেক নারীদের জন্যই একটি দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করা যেতেই পারে।

বোদা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মরিয়ম খানম বলেন, জেসমিন বেগম আমাদের সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ নিয়ে উদ্যম নিয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো একটি উদাহরণ সৃষ্টি করা নারী। তার স্বীকৃতিস্বরূপ এই নারী উপজেলায় ‘জয়িতা’ হিসেবে সম্মানিত হয়েছেন। তিনি ও তার দলকে আমরা বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানাই।

তিনি সম্প্রতি একটি সেলাই মেশিনও পেয়েছেন মহিলা বিষয়ক অফিস থেকে। নিজ ঘরে সেলাই মেশিনের চাকার সঙ্গে নিজের ভাগ্যের চাকা ঘুরাচ্ছেন জেসমিন বেগম। তার মতো সংগ্রামী ও উদ্যমী নারী যদি প্রতিটি গ্রামে একজন করে তৈরি হয়, তাহলে সেই এলাকার নারীদের গল্পগুলো বদলে যাবে। তৈরি হবে এক একটি দারিদ্র্য জয় করা জয়িতার গল্প। 

প্রত্যন্ত গ্রামে অবদান রাখা এসব নারীদের জন্যই স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে অপ্রতিরোদ্ধ বাংলাদেশের। প্রতিটি নারীর জীবন সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে পুরুষদেরও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। অশিক্ষা, কুসংস্কার, দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে মুক্ত হোক প্রতিটি নারীর সংসার।

লেখক: প্রোগ্রাম অফিসার, হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড, বোদা। 

পঞ্চগড়/শান্ত/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়